নির্মলকুমার সাহা
ইউজেন স্যান্ডোকে বলা হয়ে থাকে ‘আধুনিক বডি বিল্ডিংয়ের জনক’। জার্মানি ছেড়ে বেশ কিছু দেশ ঘুরে একটা সময়ে তিনি ইংল্যান্ডে স্থায়ী আস্তানা গড়েছিলেন। মন দিয়েছিলেন বডি বিল্ডিং ও ভারোত্তোলনে নতুন প্রজন্ম খোঁজার কাজে। ১৮৮৭ সালের শেষ দিকে এসেক্সে একটা প্রশিক্ষণ শিবির করেছিলেন স্যান্ডো। সেই শিবিরে আসা ১৩ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীর শারীরিক গঠন দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ছেলেটিকে আলাদা ট্রেনিং দিতে শুরু করেছিলেন। তখনই ইউজেন স্যান্ডো বলেছিলেন, ‘ভারোত্তোলনে ছেলেটা একদিন অনেক নাম করবে। অনেক সাফল্য পাবে।’ ইউজেন স্যান্ডোর ভবিষ্যদ্ববাণী বিফলে যায়নি। সেদিনের সেই ছোট ছেলেটিই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক অলিম্পিকের আসরে গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম সোনাজয়ী। যাঁর নাম লনসেসটন এলিয়ট। অলিম্পিকে গ্রেট ব্রিটেনের ওই প্রথম সোনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের নামও। কারণ লনসেসটন এলিয়টের জন্ম ভারতে।
অলিম্পিকে একবারই ভারোত্তোলনে ‘ওয়ান হ্যান্ড লিফট’ হয়েছিল। সেটা একেবারে আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরে, এথেন্সে ১৮৯৬ সালে। আর সেই ‘ওয়ান হ্যান্ড লিফট’-এই সোনা জিতেছিলেন লনসেসটন। এথেন্সে ভারোত্তোলনের ‘টু হ্যান্ড লিফট’-এও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ‘ওয়ান হ্যান্ড লিফট’-এর আগেই হয়েছিল ‘টু হ্যান্ড লিফট’। যাতে লনসেসটন জিতেছিলেন রুপো। ওই ইভেন্টের ফলাফল নিয়ে কিছুটা বিতর্কও হয়েছিল। সোনা জিতেছিলেন ডেনমার্কের ভিগো জেনসেন। দু’জনই তুলেছিলেন ১১১.৫ কেজি। কিন্তু প্রধান বিচারক প্রিন্স জর্জ বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন ভিগো জেনসেনকে। যুক্তি ছিল, ভিগোর ওজন তোলার স্টাইল ভালো। প্রধান বিচারকের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হলেও এতে লনসেসটন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের আরও এক ভারোত্তোলক লরেন্স লেভিও গিয়েছিলেন এথেন্সে। কিন্তু ওখানে পৌঁছে একটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় তিনি অংশ নিতে পারেননি। তাঁকে করে দেওয়া হয়েছিল জাজ। তিনিও প্রধান বিচারকের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। ‘টু হ্যান্ড লিফট’-এ ভিগোর আগে ওজন তুলেছিলেন লনসেসটন। ‘ওয়ান হ্যান্ড লিফট’ শুরুর আগে জাজদের কাছে লনসেসটন অনুরোধ জানিয়েছিলেন, এবার যেন ভিগোর পরে তাঁকে ওজন তুলতে দেওয়া হয়। বিচারকরা সেই অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। লনসেসটন ৭১.০ কেজি তুলে সোনা জিতেছিলেন। ভিগো রুপো জিতেছিলেন ৫৭.০ কেজি তুলে।
এথেন্সে অলিম্পিকের সেই প্রথম আসরে আরও অনেক খেলায়ও অংশ নিয়েছিলেন লনসেসটন। সেগুলোতে অবশ্য ভাল ফল হয়নি। শুরু থেকেই অলিম্পিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ১০০ মিটার দৌড়। সেই ১০০ মিটার দৌড়েও তিনি নেমেছিলেন। অলিম্পিকে ওটাই ছিল তাঁর প্রথম ইভেন্ট। বিদায় নিয়েছিলেন হিট থেকেই। হিটে নিজের গ্রুপে তৃতীয় (সময় ১২.৯ সেকেন্ড) হয়েছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন গ্রেকো রোমান কুস্তি, রোপ ক্লাইম্বিংয়েও। কুস্তিতে জার্মানির কার্ল সুমানের কাছে প্রথম রাউন্ডেই হেরে গিয়েছিলেন। রোপ ক্লাইম্বিংয়েও ফল খুব খারাপ। লড়াই ছিল পাঁচজনের। লনসেসটন শেষ করেছিলেন সবার শেষে।
লনসেসটন এলিয়টের জন্ম ভারতে। এখনকার কর্ণাটকের কালাদগিতে ১৮৭৪ সালের ৯ জুন। স্কটল্যান্ডের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। কিন্তু একসময় ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সঙ্গে ওই পরিবারের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেটা অবশ্য কর্মসূত্রেই। একদা তখনকার মাদ্রাজের গভর্নর ছিলেন লনসেসটনের প্রপিতামহ। সেন্ট হেলেনার গভর্নর ছিলেন ওঁর ঠাকুর্দা স্যর চার্লস এলিয়ট। পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে একসময় লনসেসটনের বাবা গিলবার্ট রে এলিয়ট পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের আধিকারিক হিসেবে। ওঁরা যখন কর্ণাটকের কালাগদিতে ছিলেন, তখনই জন্ম লনসেসটনের।
অলিম্পিকে গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম সোনাজয়ীর নাম ‘লনসেসটন’ হওয়ার পেছনে রয়েছে অন্য এক কাহিনী। অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ন তাসমানিয়ার উত্তরের এক ছোট শহর লনসেসটন। নদীর কূলের ওই ছোট শহরটা খুব প্রিয় ছিল গিলবার্টের স্ত্রী অ্যান ম্যাসনের। তিনি সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন তাঁর ওই প্রিয় শহরেই। স্বামীর চাকরির জন্য সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেই অস্ট্রেলিয়ার ওই প্রিয় শহর ছেড়ে অ্যান ম্যাসনকে চলে আসতে হয়েছিল ভারতে। কিন্তু ভুলতে পারেননি নিজের প্রিয় শহরকে। তাই ছেলের জন্মের পর নাম রেখেছিলেন ‘লনসেসটন’। প্রিয় শহরের স্মৃতিটা জিইয়ে রেখেছিলেন ছেলের নামের মধ্য দিয়েই।
১৮৮৭ সালে ভারত ছেড়ে পরিবার নিয়ে গিলবার্ট পাকাপাকি চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের এসেক্সে। লনসেসটনের বয়স তখন ১৩ বছর। শৈশব থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লনসেসটন। ছিল খেলাধুলোয় আগ্রহ। সেই আগ্রহটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ইউজেন স্যান্ডো। ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম প্রতিযোগিতায় নামার সুযোগ। সেটাই ছিল ভারোত্তোলনে প্রথম ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ। সেবার চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও সবার নজর কেড়েছিলেন ইউজেন স্যান্ডোর প্রিয় ছাত্রটি। ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম খেতাব জয় তিনবছর পর। তারপর শুধুই সাফল্য, এগিয়ে যাওয়া। পরপর সাফল্যের মাঝেই জানতে পারেন ১৮৯৬ সালে এথেন্সে প্রথম অলিম্পিক হবে। ঠিক করেন সেখানে অংশ নিতে যাবেন। কয়েকজন বন্ধুও পেয়ে যান। যাঁরাও অলিম্পিকে অংশ নিতে যেতে আগ্রহী ছিলেন। অলিম্পিক সবে শুরু, তখন তো আর এখনকার মতো নিয়মকানুন ছিল না। বন্ধুরা মিলে পাড়ি দিয়েছিলেন এথেন্স। প্রস্তুতির সময়ই ঠিক করে ফেলেছিলেন, যাবেনই যখন তখন আর শুধু ভারোত্তোলনে কেন। অংশ নেবেন আরও কিছু খেলায়। তার অনুশীলনও করেছিলেন বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু সাফল্য এসেছিল শুধু ভারোত্তোলনেই। সোনা ১, রুপো ১।
অলিম্পিকের প্রথম আসরের ওই সাফল্য উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। দেশে ফিরেই শুরু করে দিয়েছিলেন পরের অলিম্পিকের প্রস্তুতি। লক্ষ্য ছিল ১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে ভারোত্তোলনের জোড়া সোনা। কিন্তু ওই প্রস্তুতির মাঝেই একসময় জানতে পারেন প্যারিস অলিম্পিকের সূচিতে ভারোত্তোলন নেই। কিন্তু অলিম্পিকের স্বাদ যিনি একবার পেয়েছেন, তিনি কী করে ঘরে বসে থাকবেন! লনসেসটনও ঘরে বসে থাকতে চাইছিলেন না। ঠিক করেন অ্যাথলেটিক্স শুরু করবেন। কিন্তু কী ইভেন্ট? এথেন্সে ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েই বুঝে গিয়েছিলেন, ওঁর যা শারীরিক গঠন তাতে দৌড়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না। কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এথেন্সের মতো একাধিক নয়, প্যারিসে শুধু কোনও একটা থ্রো ইভেন্টে অংশ নেবেন। সেই মতো শুরু করেন ডিসকাস থ্রো অনুশীলন। প্যারিস অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন ওই ডিসকাস থ্রোতেই। ফল অবশ্য একেবারেই ভালো হয়নি। ছুঁড়েছিলেন ৩১ মিটার। পেয়েছিলেন হাঙ্গেরির আর্তুর কোরের সঙ্গে যুগ্মভাবে একাদশ স্থান। ওখানে ডিসকাস থ্রোতে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটেছিল। ৪ বছর আগে এথেন্সে ডিসকাস থ্রোয় সোনা জিতেছিলেন আমেরিকার রবার্ট গ্যারেট। প্যারিসেও তিনিই ছিলেন ফেবারিট। কিন্তু প্যারিসে তাঁর সেরা থ্রোটাই বাতিল হয়েছিল। কারণ তাঁর ছোঁড়া ডিসকাস গিয়ে পড়েছিল মাঠের ধারের এক গাছে। ফলে তিনি ফাইনাল রাউন্ডেই পৌঁছতে পারেননি।
প্যারিসই ছিল লনসেসটনের শেষ অলিম্পিক। ইচ্ছা থাকলেও পরে আর তিনি অলিম্পিকে অংশ নিতে পারেননি।
আসলে অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও ততোদিনে ওঁদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা সামাল দিতে কয়েকজনের পরামর্শে লনসেসটন তাই পেশাদার হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে তখনকার নিয়মে অলিম্পিকে নামার আর সুযোগ ছিল না। অর্থের খোঁজেই ১৯০৫ সাল থেকে শুধু ব্রিটেনেই আটকে ছিলেন না, বিশ্বের নানা দেশে ‘শো’ করতে যেতেন। দেহসৌষ্ঠব ও শক্তি প্রদর্শন করতেন। অংশ নিতেন সার্কাসেও। সেখানে কখনও কখনও আরোহী-সহ বাইক কাঁধে তুলে নিতেন। এরকম আরও অনেক ঝুঁকির খেলা দেখাতেন। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স পর্যন্ত এরকম চালিয়ে গিয়েছিলেন। লনসেসটন পাকাপাকি ব্রিটেন ছাড়েন ১৯২৩ সালে। পরিবার নিয়ে চলে যান তাঁর মায়ের প্রিয় দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। বাকি জীবনটা কাটিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। তখন তিনি শিরদাঁড়ার ক্যান্সারে আক্রান্ত। পেশাদার শো করার সময় শিরদাঁড়ায় মারাত্মক চোট পেয়েছিলেন। তারই পরিণতি ওই ক্যান্সার। মেলবোর্নেই মারা গিয়েছিলেন মাত্র ৫৬ বছর বয়সে, ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট।