Thursday, April 30, 2020

গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম সোনাজয়ীর জন্ম ভারতে, মৃত্যু অস্ট্রেলিয়ায়


নির্মলকুমার সাহা 


ইউজেন স্যান্ডোকে বলা হয়ে থাকে ‘‌আধুনিক বডি বিল্ডিংয়ের জনক’‌। জার্মানি ছেড়ে বেশ কিছু দেশ ঘুরে একটা সময়ে তিনি ইংল্যান্ডে স্থায়ী আস্তানা গড়েছিলেন। মন দিয়েছিলেন বডি বিল্ডিং ও ভারোত্তোলনে নতুন প্রজন্ম খোঁজার কাজে। ১৮৮৭ সালের শেষ দিকে এসেক্সে একটা প্রশিক্ষণ শিবির করেছিলেন স্যান্ডো। সেই শিবিরে আসা ১৩ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীর শারীরিক গঠন দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। ছেলেটিকে আলাদা ট্রেনিং দিতে শুরু করেছিলেন। তখনই ইউজেন স্যান্ডো বলেছিলেন, ‘‌‌ভারোত্তোলনে ছেলেটা একদিন অনেক নাম করবে। অনেক সাফল্য পাবে।’‌ ইউজেন স্যান্ডোর ভবিষ্যদ্ববাণী বিফলে যায়নি। সেদিনের সেই ছোট ছেলেটিই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক অলিম্পিকের আসরে গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম সোনাজয়ী। যাঁর নাম লনসেসটন এলিয়ট। অলিম্পিকে গ্রেট ব্রিটেনের ওই প্রথম সোনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের নামও। কারণ লনসেসটন এলিয়টের জন্ম ভারতে।
অলিম্পিকে একবারই ভারোত্তোলনে ‘‌ওয়ান হ্যান্ড লিফট’‌ হয়েছিল। সেটা একেবারে আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরে, এথেন্সে ১৮৯৬ সালে। আর সেই ‘‌ওয়ান হ্যান্ড লিফট’‌-‌এই সোনা জিতেছিলেন লনসেসটন। এথেন্সে ভারোত্তোলনের ‘‌টু হ্যান্ড লিফট’‌-‌এও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ‘‌ওয়ান হ্যান্ড লিফট’‌-‌এর আগেই হয়েছিল ‘‌টু হ্যান্ড লিফট’‌। যাতে লনসেসটন জিতেছিলেন রুপো। ওই ইভেন্টের ফলাফল নিয়ে কিছুটা বিতর্কও হয়েছিল। সোনা জিতেছিলেন ডেনমার্কের ভিগো জেনসেন। দু’‌জনই তুলেছিলেন ১১১.‌৫ কেজি। কিন্তু প্রধান বিচারক প্রিন্স জর্জ বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন ভিগো জেনসেনকে। যুক্তি ছিল, ভিগোর ওজন তোলার স্টাইল ভালো। প্রধান বিচারকের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হলেও এতে লনসেসটন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। গ্রেট ব্রিটেনের আরও এক ভারোত্তোলক লরেন্স লেভিও গিয়েছিলেন এথেন্সে। কিন্তু ওখানে পৌঁছে একটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় তিনি অংশ নিতে পারেননি। তাঁকে করে দেওয়া হয়েছিল জাজ। তিনিও প্রধান বিচারকের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। ‘‌টু হ্যান্ড লিফট’‌-‌এ ভিগোর আগে ওজন তুলেছিলেন লনসেসটন। ‘‌ওয়ান হ্যান্ড লিফট’‌ শুরুর আগে জাজদের কাছে লনসেসটন অনুরোধ জানিয়েছিলেন, এবার যেন ভিগোর পরে তাঁকে ওজন তুলতে দেওয়া হয়। বিচারকরা সেই অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন। লনসেসটন ৭১.‌০ কেজি তুলে সোনা জিতেছিলেন। ভিগো রুপো জিতেছিলেন ৫৭.‌০ কেজি তুলে।
এথেন্সে অলিম্পিকের সেই প্রথম আসরে আরও অনেক খেলায়ও অংশ নিয়েছিলেন লনসেসটন। সেগুলোতে অবশ্য ভাল ফল হয়নি। শুরু থেকেই অলিম্পিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ১০০ মিটার দৌড়। সেই ১০০ মিটার দৌড়েও তিনি নেমেছিলেন। অলিম্পিকে ওটাই ছিল তাঁর প্রথম ইভেন্ট। বিদায় নিয়েছিলেন হিট থেকেই। হিটে নিজের গ্রুপে তৃতীয় (‌সময় ১২.‌৯ সেকেন্ড)‌ হয়েছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন গ্রেকো রোমান কুস্তি, রোপ ক্লাইম্বিংয়েও। কুস্তিতে জার্মানির কার্ল সুমানের কাছে প্রথম রাউন্ডেই হেরে গিয়েছিলেন। রোপ ক্লাইম্বিংয়েও ফল খুব খারাপ। লড়াই ছিল পাঁচজনের। লনসেসটন শেষ করেছিলেন সবার শেষে।
লনসেসটন এলিয়টের জন্ম ভারতে। এখনকার কর্ণাটকের কালাদগিতে ১৮৭৪ সালের ৯ জুন। স্কটল্যান্ডের এক অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। কিন্তু একসময় ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সঙ্গে ওই পরিবারের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেটা অবশ্য কর্মসূত্রেই। একদা তখনকার মাদ্রাজের গভর্নর ছিলেন লনসেসটনের প্রপিতামহ। সেন্ট হেলেনার গভর্নর ছিলেন ওঁর ঠাকুর্দা স্যর চার্লস এলিয়ট। পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে একসময় লনসেসটনের বাবা গিলবার্ট রে এলিয়ট পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের আধিকারিক হিসেবে। ওঁরা যখন কর্ণাটকের কালাগদিতে ছিলেন, তখনই জন্ম লনসেসটনের।
অলিম্পিকে গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম সোনাজয়ীর নাম ‘‌লনসেসটন’‌ হওয়ার পেছনে রয়েছে অন্য এক কাহিনী। অস্ট্রেলিয়ার নর্দার্ন তাসমানিয়ার উত্তরের এক ছোট শহর লনসেসটন। নদীর কূলের ওই ছোট শহরটা খুব প্রিয় ছিল গিলবার্টের স্ত্রী অ্যান ম্যাসনের। তিনি সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন তাঁর ওই প্রিয় শহরেই। স্বামীর চাকরির জন্য সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেই অস্ট্রেলিয়ার ওই প্রিয় শহর ছেড়ে অ্যান ম্যাসনকে চলে আসতে হয়েছিল ভারতে। কিন্তু ভুলতে পারেননি নিজের প্রিয় শহরকে। তাই ছেলের জন্মের পর নাম রেখেছিলেন ‘‌লনসেসটন’‌। প্রিয় শহরের স্মৃতিটা জিইয়ে রেখেছিলেন ছেলের নামের মধ্য দিয়েই।
১৮৮৭ সালে ভারত ছেড়ে পরিবার নিয়ে গিলবার্ট পাকাপাকি চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের এসেক্সে। লনসেসটনের বয়স তখন ১৩ বছর। শৈশব থেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লনসেসটন। ছিল খেলাধুলোয় আগ্রহ। সেই আগ্রহটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ইউজেন স্যান্ডো। ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম প্রতিযোগিতায় নামার সুযোগ। সেটাই ছিল ভারোত্তোলনে প্রথম ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ। সেবার চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও সবার নজর কেড়েছিলেন ইউজেন স্যান্ডোর প্রিয় ছাত্রটি। ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম খেতাব জয় তিনবছর পর। তারপর শুধুই সাফল্য, এগিয়ে যাওয়া। পরপর সাফল্যের মাঝেই জানতে পারেন ১৮৯৬ সালে এথেন্সে প্রথম অলিম্পিক হবে। ঠিক করেন সেখানে অংশ নিতে যাবেন। কয়েকজন বন্ধুও পেয়ে যান। যাঁরাও অলিম্পিকে অংশ নিতে যেতে আগ্রহী ছিলেন। অলিম্পিক সবে শুরু, তখন তো আর এখনকার মতো নিয়মকানুন ছিল না। বন্ধুরা মিলে পাড়ি দিয়েছিলেন এথেন্স। প্রস্তুতির সময়ই ঠিক করে ফেলেছিলেন, যাবেনই যখন তখন আর শুধু ভারোত্তোলনে কেন। অংশ নেবেন আরও কিছু খেলায়। তার অনুশীলনও করেছিলেন বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু সাফল্য এসেছিল শুধু ভারোত্তোলনেই। সোনা ১, রুপো ১।
অলিম্পিকের প্রথম আসরের ওই সাফল্য উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। দেশে ফিরেই শুরু করে দিয়েছিলেন পরের অলিম্পিকের প্রস্তুতি। লক্ষ্য ছিল ১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে ভারোত্তোলনের জোড়া সোনা। কিন্তু ওই প্রস্তুতির মাঝেই একসময় জানতে পারেন প্যারিস অলিম্পিকের সূচিতে ভারোত্তোলন নেই। কিন্তু অলিম্পিকের স্বাদ যিনি একবার পেয়েছেন, তিনি কী করে ঘরে বসে থাকবেন!‌ লনসেসটনও ঘরে বসে থাকতে চাইছিলেন না। ঠিক করেন অ্যাথলেটিক্স শুরু করবেন। কিন্তু কী ইভেন্ট?‌ এথেন্সে ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েই বুঝে গিয়েছিলেন, ওঁর যা শারীরিক গঠন তাতে দৌড়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন না। কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এথেন্সের মতো একাধিক নয়, প্যারিসে শুধু কোনও একটা থ্রো ইভেন্টে অংশ নেবেন। সেই মতো শুরু করেন ডিসকাস থ্রো অনুশীলন। প্যারিস অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন ওই ডিসকাস থ্রোতেই। ফল অবশ্য একেবারেই ভালো হয়নি। ছুঁড়েছিলেন ৩১ মিটার। পেয়েছিলেন হাঙ্গেরির আর্তুর কোরের সঙ্গে যুগ্মভাবে একাদশ স্থান। ওখানে ডিসকাস থ্রোতে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটেছিল। ৪ বছর আগে এথেন্সে ডিসকাস থ্রোয় সোনা জিতেছিলেন আমেরিকার রবার্ট গ্যারেট। প্যারিসেও তিনিই ছিলেন ফেবারিট। কিন্তু প্যারিসে তাঁর সেরা থ্রোটাই বাতিল হয়েছিল। কারণ তাঁর ছোঁড়া ডিসকাস গিয়ে পড়েছিল মাঠের ধারের এক গাছে। ফলে তিনি ফাইনাল রাউন্ডেই পৌঁছতে পারেননি।
প্যারিসই ছিল লনসেসটনের শেষ অলিম্পিক। ইচ্ছা থাকলেও পরে আর তিনি অলিম্পিকে অংশ নিতে পারেননি।
আসলে অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও ততোদিনে ওঁদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করেছিল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা সামাল দিতে কয়েকজনের পরামর্শে লনসেসটন তাই পেশাদার হয়ে গিয়েছিলেন। ফলে তখনকার নিয়মে অলিম্পিকে নামার আর সুযোগ ছিল না। অর্থের খোঁজেই ১৯০৫ সাল থেকে শুধু ব্রিটেনেই আটকে ছিলেন না, বিশ্বের নানা দেশে ‘‌শো’‌ করতে যেতেন। দেহসৌষ্ঠব ও শক্তি প্রদর্শন করতেন। অংশ নিতেন সার্কাসেও। সেখানে কখনও কখনও আরোহী-‌সহ বাইক কাঁধে তুলে নিতেন। এরকম আরও অনেক ঝুঁকির খেলা দেখাতেন। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স পর্যন্ত এরকম চালিয়ে গিয়েছিলেন। লনসেসটন পাকাপাকি ব্রিটেন ছাড়েন ১৯২৩ সালে। পরিবার নিয়ে চলে যান তাঁর মায়ের প্রিয় দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। বাকি জীবনটা কাটিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। তখন তিনি শিরদাঁড়ার ক্যান্সারে আক্রান্ত। পেশাদার শো করার সময় শিরদাঁড়ায় মারাত্মক চোট পেয়েছিলেন। তারই পরিণতি ওই ক্যান্সার। মেলবোর্নেই মারা গিয়েছিলেন মাত্র ৫৬ বছর বয়সে, ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট।

জন্ম:‌ ৯ জুন ১৮৭৪
মৃত্যু:‌ ৮ আগস্ট ১৯৩০‌‌‌‌‌‌‌‌

Wednesday, April 29, 2020

শঙ্কর লক্ষ্মণকে পান-‌বিড়ির দোকান খুলতে হয়েছিল!‌

নির্মলকুমার সাহা


৩৬ বছর আগে, ১৯৮৪ সালে একবারই কাছ থেকে দেখেছিলাম তাঁকে। ইন্দোর শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে মউয়ের বাড়িতে। আর্থিক অসচ্ছলতা, তবু ছোট বাড়িটিকে যতটা সম্ভব সাজিয়ে রাখার চেষ্টা। ৮ ফুট বাই ৮ ফুট, একটি ঘরে বসতে দিয়েছিলেন। ফ্যান ছিল না। অত্যধিক গরমে ঘামছিলাম। ভেতর থেকে নিজেই একটি হাতপাখা এনে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‌খরচ বেড়ে যাবে, তাই ঘরে ফ্যান লাগাতে পারিনি!‌’‌
ছোট ঘরটির তিন দেওয়াল ঘেঁষা শো-‌কেসে অজস্র ট্রফি, পদক। দেখাচ্ছিলেন কোনটা কবে কোথায় পেয়েছেন। বোঝা যাচ্ছিল, শান্ত, অন্তর্মুখী লোকটাও খেলার মাঠ থেকে পাওয়া ওই পুরস্কারগুলো দেখাতে দেখাতে বেশ গর্ব অনুভব করছিলেন।
১৯৫৬, ১৯৬০ ও ১৯৬৪। তিনটি অলিম্পিকে খেলেছেন। এর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টিতে সোনা জিতেছেন। মাঝেরটিতে রুপো। এশিয়ান গেমসে ভারত প্রথম হকির সোনা জিতেছিল ১৯৬৬ সালে, ব্যাঙ্ককে। সোনাজয়ী সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন শঙ্কর লক্ষ্মণ। তিনিই প্রথম ভারতীয় দলের গোলকিপার-‌অধিনায়ক। অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন, হয়েছেন পদ্মশ্রী। এত সাফল্যের পর, এটাও সত্যি, সংসার চালাতে একসময় মউতে তাঁকে খুলতে হয়েছিল পান, বিড়ি, সিগারেটের দোকান!‌ ট্রফি, পদক, স্মারক, শংসাপত্র তাঁর ছোট ঘরের শোভা বাড়িয়েছে, কিন্তু পেট ভরানোর নির্ভরতা দিতে পারেনি।
আর্থিক অনটনের পাশাপাশি, একসময় সঙ্গী হয় নানারকম অসুখ। রীতিমতো কষ্টে ছিলেন। সব কিছুর অবসান ১৪ বছর আগে ২০০৬ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে। সেদিন জীবনাবসান হয় হকির চিরকালের অন্যতম সেরা গোলকিপার শঙ্কর লক্ষ্মণের। ভারতীয় হকির মূল স্রোত থেকে অনেকটা দূরেই ছিলেন। চিরবিদায়ও নীরবেই।
১৯৮৪ সালে দেখা হওয়ার পর ২২ বছরে তিন-‌চারবার ফোনে কথা হয়েছে। শেষ কথা বলেছিলাম ১৯৯৮ সালে ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে হকিতে ভারত সোনা জেতার পর। তখনই শুনেছিলাম, তিনি বেশ অসুস্থ। ক্রমশঃ সেই অসুস্থতা বেড়েই চলে। মারা যাওয়ার এক মাস ৬ দিন আগে (‌২৩ মার্চ)‌ ইন্দোরের এক হাসপাতালে দু-‌পায়েই অস্ত্রোপচার হয়। ডায়াবেটিস থেকেই পায়ে পচন ধরে। সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না হওয়াতেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। অস্ত্রোপচারের কয়েকদিন পর ফোনে শঙ্কর লক্ষ্মণের ছেলে মনোহর জানান, পায়ের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় অস্ত্রোপচারের পরই। এতটাই খারাপ হয় যে ডাক্তাররা পা কেটে বাদ দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন।
রমেশ পারমার একসময় ক্রিকেট খেলতেন। মধ্যপ্রদেশের হয়েও খেলেছেন। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ইন্দোরের হাসপাতালে ভারতের প্রাক্তন গোলকিপারকে দেখতে গিয়ে তিনি পরামর্শ দেন, হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানোর। শঙ্কর লক্ষ্মণের স্ত্রী শান্তাকে তিনি বলেন, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় শঙ্কর লক্ষ্মণকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি!‌
হকি খেলে বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি কুড়োলেও শঙ্কর লক্ষ্মণের শুরুটা ছিল ফুটবল দিয়ে। একসময় সার্ভিসেসের হয়ে নিয়মিত ফুটবল খেলেছেন। ছিলেন স্টপার। দু’‌পায়েই প্রচণ্ড জোরে শট নিতে পারতেন। ওই শট দেখে, ১৯৫৩ সালে মেজর সনভান সিং পরামর্শ দেন হকিতে গোলে খেলতে। ওই পরামর্শ মনে ধরে যায় শঙ্কর লক্ষ্মণের। হকি খেলা শুরু করে দেন। তখন বয়স ২০ বছর। শুরুটা দেরিতে হলেও হকিতে সাফল্য এসেছে খুব দ্রুত। ঝড়ের গতিতে। হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সেই সময়ের সেরা গোলকিপার। চাকরি করতেন মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রিতে। ওই বছরই ১৯৫৩ সালে তাদের হয়ে হকি খেলেন। পরের বছর ঢুকে পড়েন সার্ভিসেস দলে। ১৯৫৫ সালে ভারতের হয়ে যান পোল্যান্ড সফরে। জাতীয় দলে সেই প্রথম ঢোকা। খেলেছেন টানা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৬ সালে অলিম্পিকে প্রথম খেলেন। ভারত সোনা জিতেছিল। পুরো প্রতিযোগিতায় লক্ষ্মণ খেয়েছিলেন মাত্র একটি গোল। ১৯৬০ সালের অলিম্পিকেও খান মাত্র একটি গোল। কিন্তু ওই একটি গোলই ভারতের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল অলিম্পিক হকির সোনা। নাসের বুন্দার সেই গোলেই সোনা জিতেছিল পাকিস্তান। পুরোনো দিনের খেলোয়াড়দের কাছ শুনেছি, ফাইনালের শেষে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলেন শঙ্কর লক্ষ্মণই। পরের চার বছর ভালোভাবে হাসতে পারেননি। হেসেছিলেন ১৯৬৪-‌তে অলিম্পিকের সোনা পুনরুদ্ধার করে। টোকিওর সেই ফাইনালের পর পাকিস্তানের ম্যানেজার এ আই এস দারা বলেছিলেন, ‘‌ভারত নয়, আমাদের ফাইনালটা খেলতে হল শঙ্কর লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে। ভারত নয়, আমরা হারলাম শঙ্কর লক্ষ্মণের কাছে।’‌
তিনটি অলিম্পিকের মতো খেলেছেন তিনটি এশিয়ান গেমসেও। ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে রুপো জিতেছেন। ১৯৬৬ সালে সোনা, তাঁরই নেতৃত্বে।
আরও একটি অলিম্পিক খেলতে পারতেন ১৯৬৮ সালে। নেতৃত্বও দিতে পারতেন দেশকে। এর কোনওটাই হয়ে ওঠেনি। কেন?‌ ভারতীয় হকির সেই চিরাচরিত রাজনীতি। নিজের কথা বিশেষ বলতে চাইতেন না। ৩৬ বছর আগে অনেক পীড়াপীড়ির পর বাড়িতে বসে বলেছিলেন, ‘‌হ্যাঁ, রাজনীতির জন্যই ওটা হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৮-‌র মেক্সিকো অলিম্পিকের দল গড়ার ট্রায়ালে আমাকে ডাকা হয়নি। ট্রায়ালের পর দল গড়াও হয়ে যায়। অবশিষ্ট ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে তিনটি ম্যাচ খেলে ওই দল। দুই গোলকিপারই আশানুরূপ খেলতে ব্যর্থ হয়। তখন আমাকে বলা হয় দলে যোগ দিতে। আমি যাইনি। আসলে আমাকে ট্রায়ালে না ডাকার বড় কারণ ছিল নেতৃত্ব। আমাকে দলে নিলে অধিনায়ক করতে হত। তাই ট্রায়ালেই ডাকা হয়নি। সেবার ওই নেতৃত্ব নিয়ে কতটা রাজনীতি হয়েছিল, তা তো সবাই জানেন। যুগ্ম অধিনায়ক!‌ কোথাও কখনও শুনেছেন!‌’‌
খেলা ছাড়ার পর কিছুদিন কোচিংও করিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে সার্ভিসেস জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তাঁর কোচিংয়েই। মউতে ছোটদেরও খেলা শিখিয়েছেন। ১৯৮১ সালে একবার ডাক পেয়েছিলেন ভারতের জুনিয়র দলকে প্রশিক্ষণ দিতে। চারজন কোচের একজন ছিলেন তিনি। বাকিরা বেশ ভালো অঙ্কের মাইনে পেলেও শঙ্কর লক্ষ্মণকে দেওয়া হয়েছিল মোট মাত্র ৫০০ টাকা। রীতিমতো অপমানিত হয়েছিলেন। আর যাননি। ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়াডের সময়ও তাঁকে কম অপমানিত হতে হয়নি। এশিয়ান গেমসের সংগঠন কমিটি তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল উদ্বোধনের আগে মশাল দৌড়ে অংশ নিতে। তিনি চিঠি পেয়েছিলেন ইন্দোরের কালেক্টরের মাধ্যমে। দিল্লি যেতে টাকা দরকার। কে দেবেন টাকা?‌ ট্রেনের টিকিট?‌ ১৯৭৯ সালে আর্মির চাকরি থেকে অবসর নেওযার পরই অর্থের টানাটানি। তিনি ঠিক করেছিলেন দিল্লি যাবেন না। শুভানুধ্যায়ী, বন্ধুরা মিলে তাঁকে তুলে দিয়েছিলেন দিল্লির ট্রেনে। রাজধানী পৌঁছেও মহা সমস্যা। মাপ নিয়েও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একদিন আগে যে পোশাক দেওয়া হল তা তাঁর দ্বিগুণ সাইজের। কী আর করা যাবে, নিজের পোশাক পরেই তিনি অংশ নিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বেশ কয়েকদিন দিল্লিতে থাকলেন, খেলা দেখলেন। প্রতিশ্রুতি মতো খরচ কিন্তু দিলেন না সংগঠকেরা। ফিরে গেলেন মউতে। পরে একাধিকবার চিঠি পাঠিয়েও ২ হাজার টাকা পাননি শঙ্কর লক্ষ্মণ। ক্ষোভ, অভিমানের এরকম টুকরো টুকরো ঘটনা আরও অনেক। কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক শঙ্কর লক্ষ্মণ এ সব নিয়ে কখনও তীব্র ক্ষোভপ্রকাশ করেননি। নিজেকে আরও অনেক বেশি আটকে রেখেছিলেন মউয়ের গণ্ডিতেই। নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন ভারতীয় হকির, ভারতের খেলাধুলোর বৃহৎ জগৎ থেকে। যেন উপেক্ষার জবাব আরও বেশি উপেক্ষায়।

জন্ম:‌ ৭ জুলাই, ১৯৩৩।
মৃত্যু:‌ ২৯ এপ্রিল, ২০০৬।   

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...