Monday, June 22, 2020

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও অলিম্পিকের সোনা!‌




ভেঙে পড়া বাইপ্লেনের ভেতর থেকে এলিজাবেথকে যখন বের করে আনা হয় সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর বেঁচে নেই!‌‌ ভেবেছিলেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জায়গা হবে মরদেহ রাখার ঠাণ্ডা ঘরে। উদ্ধারকারীদের একজন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুলে নেন তাঁর গাড়ির পেছনে।



মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও
অলিম্পিকের সোনা!‌


নির্মলকুমার সাহা


(১৮৯৪ সালের ২৩ জুন প্যারিসে গঠিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি। ১৯৪৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে ওই দিনটি পালিত হয়ে আসছে ‘‌অলিম্পিক ডে’‌ হিসেবে। আজ এই বিশেষ দিনে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে অলিম্পিকের প্রথম সোনাজয়ীকে স্মরণ।)‌


বাইপ্লেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন এলিজাবেথ রবিনসন। অনুশীলন শেষে অন্যরা সাঁতার কাটতে গেলেও ওঁর যাওয়া হয়নি। শারীরিক কিছু সমস্যার জন্য কোচ বারণ করেছিলেন। সেটা ১৯৩১ সালের ২৮ জুনের ঘটনা। সেদিন এলিজাবেথ ঠিক করেন আকাশে উড়বেন। ওঁর এক তুতো দাদা উইলসন পালমারের বাইপ্লেন ছিল। কিছুদিন আগে বিমান চালানোর লাইসেন্সও পেয়েছেন। মাঝেমধ্যে দাদার সঙ্গে সেই বাইপ্লেনে আকাশে উড়তেন। সেদিনও এলিজাবেথ ডেকে আনেন সেই তুতো দাদাকে। তারপর দু’‌জনে সেই বাইপ্লেনে চেপে আকাশ ভ্রমণে যান। কিন্তু কিছুটা ওঠার পরই যান্ত্রিক বিভ্রাট। ভেঙে পড়ে সেই বাইপ্লেন। ছুটে আসেন আশপাশের লোকজন। তাঁরা ভেঙে পড়া বাইপ্লেনের ভেতর থেকে এলিজাবেথকে যখন বের করে আনেন, ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর বেঁচে নেই!‌‌ সবাই ভেবেছিলেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জায়গা হবে মরদেহ রাখার ঠাণ্ডা ঘরে। ওই উদ্ধারকারীদের একজন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুলে নেন তাঁর গাড়ির পেছনে। কাছাকাছি এক ছোট হাসপাতালে (‌স্থানীয়রা যাকে ‘‌Poor Hospital‌‌‌’‌ বলতেন)‌ পৌঁছে গাড়ি থেকে নামানোর পরও প্রাথমিকভাবে সবার মনে হয়েছিল, মৃত!‌ কিন্তু ডাক্তার দেখে জানান, সজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকলেও তখনও প্রাণ আছে। ১১ সপ্তাহ হাসপাতালে সজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন এলিজাবেথ। শরীরের নানান অংশে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর হুইলচেয়ারে বসানো হয়। সেই থেকে প্রায় ২ বছর ওই হুইলচেয়ারই ছিল সঙ্গী। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেন।
কে এই এলিজাবেথ রবিনসন?‌
আধুনিক অলিম্পিক শুরু ১৮৯৬ সালে। প্রথম আসরে ছিল শুধুই পুরুষদের খেলা। মহিলাদের অলিম্পিকে প্রবেশ ১৯০০ সালের দ্বিতীয় আসর থেকে। কিন্তু অলিম্পিকে মহিলাদের অ্যাথলেটিক্স শুরু আরও ২৮ বছর পর, ১৯২৮ সালে আমস্টারডামে। এই দুর্ঘটনার ৩ বছর আগে সেই অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন এলিজাবেথ রবিনসন। যিনি পরিচিত বেটি রবিনসন নামেও। তিনি তখন স্কুলছাত্রী (Thornton Township High School‌)‌‌‌‌। ৩১ জুলাই সোনা জিতেছিলেন বয়স ১৭ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে সবচেয়ে কম বয়সে (‌১৬ বছর ৩৪৩ দিন)‌ সোনা জেতার রেকর্ডটা এখনও তাঁর নামের পাশে। অলিম্পিকের ইতিহাসে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ের প্রথম সোনার পদকটি গলায় তুলতে তিনি সময় নিয়েছিলেন ১২.‌২ সেকেন্ড। আমস্টারডাম অলিম্পিকে ওই সোনার সঙ্গে একটি রুপোও জিতেছিলেন তিনি। সেটি ৪x‌‌১০০ মিটার রিলের। যখন নিজের দেশে পরের অলিম্পিকে (‌১৯৩২, লস এঞ্জেলস)‌ আরও ভাল ফলের আশায় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই ওই দুর্ঘটনা। লস এঞ্জেলসে যখন অলিম্পিক চলছে, তখন তিনি হুইলচেয়ারে!‌ আদৌ কি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন, এই আলোচনায় সবাই তখন ব্যস্ত। এলিজাবেথ কিন্তু হুইলচেয়ারে বসেই অলিম্পিকে আবার সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।
শুধু স্বপ্ন দেখা নয়। সেই স্বপ্নকে বাস্তব‌‌‌‌ও করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে তাঁর গলায় আবার উঠেছিল সোনার পদক। তবে সেটা ১০০ মিটারের নয়, ৪x‌‌১০০ মিটার রিলের। বার্লিন অলিম্পিকে তিনি যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়েই তো তৈরি হয়েছিল সংশয়। ওই দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচারের পর তাঁর একটা পা সামান্য ছোট হয়ে গিয়েছিল। ছিল পায়ের আরও কিছু সমস্যা। যেমন হাঁটু মুড়তে বা ভাঁজ করতে পারতেন না। কী করে নেবেন স্প্রিন্টের স্টার্ট?‌ কী করে দৌড়বেন ১০০ মিটার?‌ পায়ের জন্য স্প্রিন্টের স্টার্ট নেওয়ায় সমস্যা সত্ত্বেও তখনও কিন্তু তিনি দুর্দান্ত দৌড়তেন। আগের সেই গতিও অনেকটাই ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু স্টার্টিংয়ের সমস্যার জন্য তাঁকে ১০০ মিটারে নামাতে পারেনি আমেরিকা। রেখেছিল রিলে দলে, তিন নম্বর রানার হিসেবে।
বার্লিনে মহিলাদের ৪x‌‌১০০ মিটার রিলেতে ফেবারিট ছিল সংগঠক জার্মানি। হিটে জার্মানির রিলে দল বিশ্বরেকর্ড (‌৪৬.‌৫ সেকেন্ড)‌ গড়েছিল। কিন্তু ফাইনালে তাদের শেষ রানার ব্যাটন নেওয়ার সময় ফেলে দেন। ফলে বাতিল হয়ে যায় জার্মানি। সোনা জেতে আমেরিকা, ৪৬.‌৯ সেকেন্ডে।
এলিজাবেথ বা বেটি রবিনসনের অ্যাথলেটিক্সে আসাটাও গল্পের মতো এবং আমস্টারডাম অলিম্পিকের কয়েকমাস আগে। এলিজাবেথকে স্কুলে যেতে হত ট্রেনে। বাড়ি থেকে ট্রেনের সময়ানুযায়ী বেরোতেন। একদিন সামান্য দেরি হয়ে যায়। অনেকটা দূর থেকেই দেখতে পান প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে। শুরু হয় দৌড়। যে করেই হোক ট্রেনে উঠতেই হবে। ওই ট্রেনে তখন বসেছিলেন এলিজাবেথের স্কুলের বায়োলজি শিক্ষক চার্লস প্রাইস। যিনি একসময় অ্যাথলিট ছিলেন। বায়োলজি পড়ানোর পাশাপাশি ওই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলোও তিনিই দেখতেন। চার্লস প্রাইস ধরেই নিয়েছিলেন এলিজাবেথ ট্রেনটা ধরতে পারবেন না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দৌড়ে এসে ট্রেন ছাড়ার মুখে উঠে পড়েন এলিজাবেথ। ট্রেন ধরার জন্য এলিজাবেথের ওই দৌড় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান চার্লস প্রাইস। স্কুলে পৌঁছে তিনি ওঁকে পরামর্শ দেন অ্যাথলেটিক্স করার। বলেন, ছুটির পর মাঠে চলে আসতে। এভাবেই অ্যাথলেটিক্স শুরু বেটি রবিনসনের।
আমস্টারডাম অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেওয়ার আগে তিনি মাত্র দুটি স্বীকৃত প্রতিযোগিতায় দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। ওই বছর ৩০ মার্চ একটা ইনডোর মিটে প্রথম অংশ নেন, ৬০ গজের দৌড়ে। ওটাই ছিল সরকারিভাবে কোনও স্বীকৃত প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রথম অংশ নেওয়া। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন হেলেন ফিলকে। দ্বিতীয় এলিজাবেথ। দ্বিতীয় দৌড়টা ছিল আউটডোরে, ১০০ মিটারের। প্রথম স্থান পেয়েছিলেন এলিজাবেথ। তারপরই লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে অংশ নেওয়া।
বার্লিন অলিম্পিকের পরই প্রতিযোগিতামূলক অ্যাথলেটিক্স থেকে অবসর নেন। তবে তারপরও অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কর্মকর্তা হিসেবে। অনেক প্রতিযোগিতায় তাঁকে টাইমকিপার ও জাজ হিসেবেও দেখা গিয়েছে।
জন্ম ১৯১১ সালের ২৩ আগস্ট ইলিনয়ের রিভারডেলে। ১৯৩৯ সালে বিয়ে করেন (‌স্বামী Richard Schwartz)‌। তারপর ঘরসংসারে মন দেন। দীর্ঘদিন একই সঙ্গে ক্যান্সার ও অ্যালজাইমার্সে ভোগার পর এলিজাবেথ বা বেটি রবিনসনের জীবনাবসান ১৯৯৯ সালের ১৮ মে। 

জন্ম:‌ ২৩ আগস্ট, ১৯১১
মৃত্যু:‌ ১৮ মে, ১৯৯৯ 

Friday, June 19, 2020

হোম কোয়ারান্টিনে থেকেই চাকরির খোঁজে অলিম্পিয়ান ভগীরথ




গুলি, বন্ধুকের আকর্ষণেই আর্মির চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন ভগীরথ সামই। সেকেন্দ্রাবাদে চাকরিতে যোগ দিয়েই শুটিং শুরু করেন।‌ শুটিংয়ে পেয়েছেন অনেক সাফল্য। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৭, জাতীয় প্রতিযেগিতায় টানা অংশ নিয়েছেন। জাতীয় প্রতিযোগিতায় জিতেছেন মোট ৮৭ টি সোনা।



হোম কোয়ারান্টিনে
থেকেই চাকরির খোঁজে
অলিম্পিয়ান ভগীরথ 



নির্মলকুমার সাহা



১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যা এখনও কষ্ট দেয় অলিম্পিয়ান ভগীরথ সামইকে। মেদিনীপুরের চাঁইপাট গ্রামটাই তো সেই বন্যার জলে তলিয়ে গিয়েছিল। ভগীরথদের দুটো কুঁড়ে ঘর আর কী করে রেহাই পাবে!‌ ওরই একটি ঘরে জলবন্দী হয়ে মারা গিয়েছিলেন ভগীরথের বাবা গোপীনাথ সামই।
সামনের ১১ আগস্ট ভগীরথের বয়স ৬৩ পূর্ণ হবে। এই অলিম্পিয়ান শুটার করোনার জেরে এখন দুর্গাপুরের বাড়িতে হোম কোয়ারান্টিনে। দু’‌বছরের চুক্তিতে ঝাড়খন্ড স্টেট স্পোর্টস প্রোমোশন সোসাইটির শুটিংয়ের চিফ কোচ হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন। রাঁচিতে ছিলেন। লকডাউন চলার সময় চাকরির মিয়াদ শেষ হওয়ার পর ২ মাসেরও বেশি আটকে ছিলেন রাঁচিতেই। ফিরতে পারছিলেন না বাড়িতে। অবশেষে ৮ জুন দুর্গাপুরের বাড়িতে ফিরেছেন। ডাক্তারি পরীক্ষার পর ১৫ দিনের হোম কোয়ারান্টিন। ২৩ জুন আবার ডাক্তারি পরীক্ষা হবে। ‌
ভগীরথ চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন আর্মিতে ১৯৭৫ সালে, শুটিংয়ে আসার আগেই। বললেন, ‘গ্রামের ছেলে ছোটবেলায় গ্রামের মাঠে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছি। আর পুকুরে, নদীতে সাঁতার কেটেছি। ফুটবল, সাঁতারে অনেক প্রাইজও পেয়েছি। নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতা তখন আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু ওসবে আমার পুরোপুরি মন ভরেনি। শখ ছিল বন্দুক কাঁধে ঘুরে বেড়ানোর। ওই গুলি, বন্ধুকের আকর্ষণেই আর্মির চাকরিতে যোগ দিই। সেকেন্দ্রাবাদে (‌আর্মি অর্ডন্যান্স কোর)‌ গিয়েই শুটিং শুরু করি।’‌ শুটিংয়ে পেয়েছেন অনেক সাফল্য। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৭, জাতীয় প্রতিযেগিতায় টানা অংশ নিয়েছেন। জাতীয় প্রতিযোগিতায় জিতেছেন মোট ৮৭ টি সোনা। রুপো ২৮, ব্রোঞ্জ ১৯। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাঁর পদক পাঁচটি। ১৯৯১ সালে কলম্বোয় সাফ গেমসে একটি করে সোনা, রুপো ও ব্রোঞ্জ। ১৯৮৬-‌এর সিওল এশিয়ান গেমসে ও ১৯৯০ সালের অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমসে ব্রোঞ্জ। ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে বিশিষ্ট সেবা পদক পেয়েছেন ১৯৮৭ সালে। আর্মির খেলোয়াড় হিসেবে দু’‌বার (‌১৯৮৮, ১৯৮৯)‌ পেয়েছেন ‘‌কিং অফ দ্য রাইফেল’‌ পুরস্কার।
আর্মিতে ছিলেন ২০ বছর। ১৯৯৫-‌এ আর্মির চাকরি ছাড়েন। তারপর আবার ফিরে আসেন বাংলায়। দুর্গাপুরে অমরাবতী ডিফেন্স কলোনিতে বাড়ি করেন। তারপর ১৯৯৭ থেকে ২০১১, আসানসোলে একটি সংস্থায় সিকিউরিটি অফিসারের চাকরি করেন। ২০১২ থেকে ২০১৮ ছিলেন হলদিয়ায় ইন্ডিয়ান পাওয়ার কর্পোরেশনের সিকিউরিটি অফিসার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। সেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ওই ২০১৮ সালেই চলে যান ঝাড়খন্ডে। ওখান থেকে ফিরে হোম কোয়ারান্টিনের মাঝেই দেশের হয়ে একটি করে সোনা ও রুপো এবং তিনটি ব্রোঞ্জজয়ী ৬৩ ছুঁই ছুঁই বয়সের প্রাক্তন তারকা আবার চাকরি খুঁজছেন। এই বয়সে কেন চাকরির খোঁজ?‌ দুটি এশিয়ান গেমস (‌১৯৮২ দিল্লি, ১৯৮৬ সিওল)‌, দুটি কমনওয়েলথ গেমস (‌১৯৮২ ব্রিসবেন, ১৯৯০ অকল্যান্ড)‌ ও একটি অলিম্পিকে (‌১৯৮৪ লস এঞ্জেলস)‌ দেশের হয়ে অংশ নেওয়া শুটার দুর্গাপুর থেকে ফোনে বললেন, ‘এখনও শক্তপোক্ত আছি। কর্মক্ষমতাটা ধরে রাখতে চাই। তাই একটা ‌চাকরি খুঁজছি। সেটা শুটিং কোচের হতে পারে বা অন্য কিছু।’

Thursday, June 18, 2020

চাষ বন্ধ,‌ করোনার প্রভাবে দারিদ্র‌্য বেড়েছে বিশ্বকাপারের





পেটের জ্বালায়, সংসার চালাতে এখনও নিয়ম করে চাষ করতে যেতে হয়। ‘‌বিশ্বকাপার’‌ এই পরিচয়টা দিয়ে তিনি এখনও গর্ববোধ করেন। কিন্তু তাতে পেট ভরে না। এক ডজন লোকের সংসার ঠিকঠাক টানতে পারেন না।


চাষ বন্ধ,‌ করোনার প্রভাবে
দারিদ্র‌্য বেড়েছে বিশ্বকাপারের 


নির্মলকুমার সাহা


বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। বছর খানেক আগে একবার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। তবু পেটের জ্বালায়, সংসার চালাতে এখনও নিয়ম করে চাষ করতে যেতে হয়। ‘‌বিশ্বকাপার’‌ এই পরিচয়টা দিয়ে তিনি এখনও গর্ববোধ করেন। কিন্তু তাতে পেট ভরে না। এক ডজন লোকের সংসার ঠিকঠাক টানতে পারেন না। ছত্তিশগড়ের রায়গড় জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শিথরা থেকে ফোনে ভিনসেন্ট লাকরা বলছিলেন, ‘‌স্ত্রী, ছেলে, মেয়েদের নিয়ে ১২ জনের সংসার। বিশ্বকাপার হিসেবে সরকারের কাছ থেকে সামান্য পেনশন পাই। তাতে কী করে এত বড় সংসারটা চলবে?‌ নিজের অল্প কিছু জমি আছে। ছেলেদের নিয়ে সেখানে চাষ করে কোনও মতে সংসার চালাই।’‌ কিন্তু ওই ‘‌কোনও মতে’‌ও এখন আর চলছে না। কারণ করোনা আতঙ্ক। সারা দেশের সঙ্গে যার প্রভাব পড়েছে ওই প্রত্যন্ত গ্রামেও।
আতঙ্ক থাকলেও কয়েকদিন আগে পর্যন্তও শিথরা গ্রামে একজনও করোনা পজিটিভ ছিলেন না। শিথরা গ্রামে দরিদ্র উপজাতিদের বাস। একসময় চাষই ভরসা ছিল গ্রামের মানুষের। কিন্তু তাতে এখন আর অধিকাংশ পরিবারেরই চলছে না। ভারতীয় হকি দলের প্রাক্তন ফরোয়ার্ড ভিনসেন্ট জানালেন, ‘‌কয়েক বছর আগে থেকেই পরিস্থিতি বদলেছে। এখন গ্রামের অনেক ছেলেকেই বাইরে কাজ করতে যেতে হচ্ছে। অন্য রাজ্যেও। করোনার জন্য তারা এখন ফিরে এসেছে। ওরা ফিরে আসার পর আমাদের গ্রামেও করোনায় আক্রান্ত পাওয়া গেছে। লকডাউনের জন্য একসময় ক্ষেতে যাওয়া বন্ধ ছিল। পরে মাঝেমধ্যে যাচ্ছিলাম। এখন গ্রামে করোনা আক্রান্ত পাওয়ায় তো ভয়ে বেরোতেই পারছি না। সবাই বারণ করছে। কী হবে জানি না!‌ কী করে সংসার চলবে বুঝতে পারছি না!‌’‌ তিনি অবশ্য শুধু নিজের পরিবার নয়, গ্রামের অন্যদের নিয়েও চিন্তিত। বললেন, ‘‌আমাদের গ্রাম গরীব মানুষে ভরা। সবারই এক অবস্থা।’‌
১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ হকিতে ভারতীয় দলে ৪ জন আদিবাসী খেলোয়াড় ছিলেন। গোপাল ভেঙ্গরা, জন কারকেট্টা, সিলভানাস ডুংডুং এবং ভিনসেন্ট লাকরা। তার আগে একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যক আদিবাসী খেলোয়াড় কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতীয় হকি দলের হয়ে খেলেননি। ‌ভিনসেন্ট বললেন, ‘‌ওই বিশ্বকাপের অনেক আগেই ভারতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছি। বিভিন্ন টেস্ট সিরিজে ভারতের হয়ে খেলেছি। লক্ষ্য ছিল অলিম্পিকে ভারতের হয়ে খেলা। ১৯৭৬ সালে অলিম্পিকের দলে ঢোকার খুব চেষ্টা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত পারিনি। অলিম্পিকটা আমার কাছে স্বপ্নই থেকে গেছে। তাই আমার হকি জীবনের সেরা ঘটনা আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপে খেলাটাই।’‌
আগে দেখেছি দারিদ্র‌্যের মাঝেও তিনি সবসময় হাসিখুশি। করোনার জেরে এখন সেই দারিদ্র‌্য আরও বেড়েছে। বয়সের ভার কিছুটা ক্লান্ত করেছে। আর আছে করোনা আতঙ্ক। এসবের মাঝেও দেখলাম পুরনো গল্প করার অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি। বললেন, ‘‌যা হওয়ার হবে। সারাক্ষণ ওসব নিয়ে চিন্তা করলে তো অসুস্থই হয়ে পড়তে হবে। তাই কথা বলে, গল্প করে নিজেকে হালকা রাখার চেষ্টা করি।’‌ আগে ওঁর কাছ থেকে অনেকবার শুনেছি, আবার শোনালেন, ‘‌সুনীল দত্ত হকির ভক্ত ছিলেন। হকি খেলা নিয়মিত দেখতেন। হকির সব খবর রাখতেন। তিনি আমাকে খুব ভালবাসতেন। আমার সংসারের খারাপ অবস্থার কথা তিনি জানতেন। আমাকে বলেছিলেন, মুম্বইয়ে চলে যেতে। ওখানে গিয়ে যাতে ভালভাবে থাকতে পারি, সেই ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। শুধু গ্রামের টানেই যাইনি। জন্ম থেকে এই গ্রামে। এই গ্রামের মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমার নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে মন সায় দেয়নি।’‌
গ্রাম নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ নেই। পাশাপাশি দুঃখও রয়েছে। বললেন, ‘ছোটবেলায় আমরা দলে দলে হকির টানে মাঠে যেতাম। এখন আর গ্রামের ছেলেরা হকি খেলে না। আমার ছেলেদেরও তো হকি খেলাতে পারিনি!‌’‌

Tuesday, June 16, 2020

পেটের টানে, রুটির খোঁজে শৈশবে ঝাড়ুদার!‌ যৌবনে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন




পেট্রোসিয়ান বিয়েও করেছিলেন দাবা বোর্ডে বাজি ধরে। পেট্রোসিয়ান ও এফিম গেলার, দু’‌জনের সঙ্গেই মন দেওয়া-‌নেওয়া করে চলছিলেন রোনা আভিনেজার। রোনা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইন্টার জোনালে পেট্রোসিয়ান ও গেলারের মধ্যে যিনি ভাল ফল করবেন, তাঁকেই বিয়ে করবেন। গেলারের চেয়ে আধ পয়েন্টে বেশি করেছিলেন পেট্রোসিয়ান। রোনা বিয়ে করেছিলেন তাঁকেই। 


পেটের টানে, রুটির
খোঁজে শৈশবে ঝাড়ুদার!‌
যৌবনে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন


নির্মলকুমার সাহা


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবা-‌মা দুজনই মারা যান। সেই শৈশবেই পেটের টানে, রুটির খোঁজে রোজগারের পথ খুঁজতে হয়েছিল টাইগ্রান পেট্রোসিয়ানকে। রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজ। ১৯৬৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনে একটি সাক্ষাৎকারে পেট্রোসিয়ান বলেছিলেন, ‘‌রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজটা আমি শুরু করেছিলাম শীতকালের মাঝামাঝি। করুণ অভিজ্ঞতা!‌ তখন রাস্তা পরিষ্কারের কোনও মেশিন ছিল না। হাত আর ঝাঁটাই সম্বল। লোকজন বেরনোর আগে রাস্তা যখন ফাঁকা থাকত, সেই ভোরে প্রবল শীতের মধ্যে ওই কাজ করতে হত। বড়রা কয়েকজন অবশ্য আমাকে সাহায্য করতেন। কখনও কখনও লোকজন বেরিয়ে পড়লে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম। তখন ওই কাজটাকে আমি ঘৃণা করতাম। তবু করতে হত!‌ পেটের টানে। একসময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। এক বছর স্কুলেও যেতে পারিনি। আমার এক পিসি ছিলেন। ওই সময়ে তিনি আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন। আমি যখন অসুস্থ হয়ে রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজ করতে পারছিলাম না, ওই পিসিই আমাকে রুটি খেতে দিতেন। প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমার কানের বেশ ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক চিকিৎসায়ও সেই রোগ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। সারাজীবন কানে যন্ত্র লাগিয়ে কাটাতে হয়েছে।’‌
টাইগ্রান পেট্রোসিয়ানের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৭ জুন, জর্জিয়ার টিপলিসের মুলকি গ্রামে। জর্জিয়া তখন ছিল সোবিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গ। পরে মস্কোতেই পাকাপাকি থাকতেন। টাইগ্রানের বাবা ভারতানোভিচ ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু তিনি চাইতেন ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে বড় হোক। তাই খেলাধুলো করতে গিয়ে লেখাপড়ার ক্ষতি তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। ফলে অন্য বড় বড় দাবা খেলোয়াড়দের তুলনায় টাইগ্রানকে দাবা খেলা শিখতে হয়েছে একটু দেরিতেই। ৮-‌৯ বছর বয়সে। তাও সেটা শুধু শিখে রাখাই। নিয়মিত দাবা নিয়ে চর্চার কোনও সুযোগ ছিল না। সেই সুযোগ আসে আরও দেরিতে, ১২ বছর বয়সে, মা-‌বাবার মৃত্যুর পর।
পুরো নাম টাইগ্রান ভারতানোভিচ পেট্রোসিয়ান। দাবা মহলে পরিচিত ছিলেন ‘‌আয়রন টাইগ্রান’‌ নামে। তাঁর রক্ষণ এতই শক্তিশালী ছিল যে, তাঁকে হারানো ছিল খুবই কঠিন কাজ। তাই পেট্রোসিয়ানকে ওই নামে ডাকা হত।  ‌
পেট্রোসিয়ান ছিলেন নিমজোভিচের (Aron Nimzowitsch‌‌‌)‌ ভক্ত। তাঁর লেখা ‘‌Chess Praxis‌‌’‌ বইটি ছিল পেট্রোসিয়ানের কাছে বাইবেলের মতো। পেট্রোসিয়ান লিখেছেন, ‘‌রাতে যখন ঘুমোতে যেতাম, বালিশের তলায় থাকত ওই বই। বাচ্চারা যেমন প্রিয় গল্পের বই রেখে দেয়।’‌ আরও একটি বই পেট্রোসিয়ানের খুব প্রিয় ছিল। রুদলফ স্পিলম্যানের (Rudolf  Spielmann‌)‌ ‘‌দ্য আর্ট অফ স্যাক্রিফাইস ইন চেস’‌ (The Art of Sacrifice in Chess‌)‌।
প্রথমে নিজে নিজেই বই পড়ে দাবা খেলা। ১২ বছর বয়সে ভর্তি হন টিফলিসের প্যালেস অফ পাইওনিয়ার্সে। আর্চিল এব্রালিজের (Archil Ebralidze) কাছে নিজেকে দাবা খেলোয়াড় হিসেবে গড়তে শুরু করেন। সেখানে একবছর ট্রেনিং নেওয়ার পরই পেট্রোসিয়ান প্রদর্শনী সিমিউলটেনিয়াস দাবায় হারিয়ে দেন সোবিয়েত ইউনিয়নের গ্র‌্যান্ড মাস্টার সালো ফ্লোহরকে (Salo Flohr)। ১৯৪৬ সালে জর্জিয়ান চেস চ্যাম্পিয়নশিপে গ্র‌্যান্ড মাস্টার পল কেরেসের সঙ্গে ড্র করেন। তার পরই টিফলিস ছেড়ে চলে যান ইরেভানে। সেখানে আর্মেনিয়ান চেস চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব জেতেন। সোবিয়েত ইউনিয়নের জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হন। তখনই পেট্রোসিয়ানের মনে হয়, আরও উন্নতির জন্য পাকাপাকি মস্কোয় চলে যাওয়া উচিত। ১৯৪৯ সালে ২০ বছর বয়সে পাকাপাকি চলে যান মস্কোয়। ১৯৫১ সালে সোবিয়েত ইউনিয়ন চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় স্থান পান। ওই চ্যাম্পিয়নশিপেই প্রথম মুখোমুখি হন বিশ্বচ্যাম্পিন মিখাইল বটভিনিকের। সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলতে বসে প্রথমেই কিছুটা সমস্যায় পড়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে গেমমটা ড্র করেন। সোবিয়েত ইউনিয়নের দাবায় তখন তারকার মেলা। সেই সময় ৪ বার সোবিয়েত ইউনিয়ন চ্যাম্পিয়ন পন পেট্রোসিয়ান। ১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬৯ ও ১৯৭৫ সালে।
দাবার নবম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান। প্রথম তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন ১৯৬৩ সালে। তিনি সেবার আগের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল বটভিনিকের চ্যালেঞ্জার ছিলেন। এই চ্যালেঞ্জার হওয়া নিয়ে অবশ্য বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন ববি ফিশার। ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে ৮ প্রতিযোগী ছিলেন সোবিয়েত ইউনিয়নের মিখাইল তাল, ভিক্টর করশনয়, টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান, এফিম গেলার, পল কেরেস, আমেরিকার ববি ফিশার, পল বেঙ্কো, চেকোস্লোভাকিয়ার মিরোস্লাভ ফিলিপ। খেলা হয়েছিল Quadruple Round-robin ‌‌‌পদ্ধতিতে। অর্থাৎ প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ৪ বার করে খেলেছিলেন। ১৭.‌৫ পয়েন্ট করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন পেট্রোসিয়ান। ১৭ পয়েন্টে ছিলেন গেলার ও কেরেস। আমেরিকার ববি ফিশার করেছিলেন ১৪ পয়েন্ট। ফিশারের অভিযোগ ছিল, সোবিয়েত ইউনিয়নের খেলোয়াড়রা গড়াপেটা করেছেন। ফিশার যাতে চ্যাম্পিয়ন না হতে পারেন, সে জন্য নিজেদের মধ্যে অসংখ্য গড়াপেটা গেম খেলেছেন। উদাহরণ হিসেবে ফিশার দেখিয়েছিলেন পেট্রোসিয়ান, গেলার ও কেরেস নিজেদের মধ্যে যে ১২টি গেম খেলেছিলেন তার সবই ড্র, এবং তা খুব অল্প চালেই। তা যাই হোক, খেতাবি লড়াই ছিল দীর্ঘ ২৪ গেমের। প্রথম গেমে সাদা ঘুঁটি নিয়ে হেরে শুরু করলেও শেষ হাসি হেসেছিলেন পেট্রোসিয়ান। ২৪ গেমের লড়াই শেষ করে দিয়েছিলেন ২২ গেমেই। পেট্রোসিয়ান জিতেছিলেন ১২.‌৫-‌৯.‌৫ পয়েন্টে। পেট্রোসিয়ানের জয় ৫। ড্র ১৫। বটভিনিক জিতেছিলেন ২টিতে। মস্কোতে ওই খেতাবি লড়াই চলেছিল প্রায় ২ মাস। ২৩ মার্চ থেকে ২০ মে। বটভিনিক পরে জানিয়েছিলেন, ‘‌ওই দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য শুধু দাবা বোর্ডের প্রস্তুতিতে নয়, আমি মন দিয়েছিলাম শারীরিক সক্ষমতা ধরে রাখার দিকেও। প্রতিদিন নিয়মিত কয়েক ঘণ্টা স্কি করতাম।’‌
৩ বছর পর খেতাব রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল পেট্রোসিয়ানকে। চ্যালেঞ্জার ছিলেন বরিস স্প্যাসকি। যিনি ক্যান্ডিডেটস দাবার ফাইনালে মিখাইল তালকে হারিয়ে চ্যালেঞ্জার হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে মস্কোতে বরিস স্প্যাসকিকে হারিয়ে বিশ্ব খেতাব নিজের দখলেই রেখে দিয়েছিলেন পেট্রোসিয়ান। তবে ওই খেতাব রক্ষা সহজে করতে পারেননি। খেলতে হয়েছিল পুরো ২৪ গেমই। শেষ গেম ড্র করে ১২.‌৫-‌১১.‌৫ পয়েন্টে জিতেছিলেন পেট্রোসিয়ান। ৯ এপ্রিল থেকে ৯ জুন, সেই দীর্ঘ লড়াইয়ে ১৭ টি গেমই ড্র। পেট্রোসিয়ান জিতেছিলেন ৪ টিতে। স্প্যাসকির জয় ৩।
ফের ৩ বছর পর ১৯৬৯-‌এ সেই বরিস স্প্যাসকিরই মুখোমুখি। এবারও খেলা সেই মস্কোতেই। ১৪ এপ্রিল থেকে ১৭ জুন। এবার আর পারেননি। স্প্যাসকির কাছে ১২.‌৫-‌১০.‌৫ পয়েন্টে হেরে বিশ্ব দাবার সিংহাসন হারাতে হয়েছিল পেট্রোসিয়ানকে। কিন্তু তারপরও খেতাব ফিরে পাওয়ার লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। মোট ৮ বার তিনি ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে ৪ বার ১৯৫৩, ১৯৫৬, ১৯৫৯ ও ১৯৬২ সালে। বিশ্ব খেতাব হাতছাড়া হওয়ার পর আরও ৪ বার ১৯৭১, ১৯৭৪, ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে।
দাবা অলিম্পিয়াডেও দুর্দান্ত পারফরমেন্স পেট্রোসিয়ানের। তিনি মোট ১০ টি দাবা অলিম্পিয়াডে সোবিয়েত ইউনিয়নের হয়ে খেলেছেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৪ ও ১৯৭৮। ওই ১০ টি দাবা অলিম্পিয়াডের মধ্যে ৯ টিতেই সোনা জিতেছিল সোবিয়েত ইউনিয়ন। শেষবার ১৯৭৮-‌এ রুপো। পেট্রোসিয়ান ৬ বার জিতেছিলেন বোর্ডের সোনা। ওই ১০ টি দাবা অলিম্পিয়াডে তাঁকে খেলতে হয়েছিল ১২৯ টি গেম। যার মধ্যে জিতেছিলেন ৭৮ টিতে। ড্র ৫০ টি। হেরেছিলেন মাত্র একটিতে।
পেট্রোসিয়ান বিয়েও করেছিলেন দাবা বোর্ডে বাজি ধরে। পেট্রোসিয়ান ও এফিম গেলার, দু’‌জনের সঙ্গেই মন দেওয়া-‌নেওয়া করে চলছিলেন রোনা আভিনেজার (Rona Avinezer‌)‌। ‌তিনি ছিলেন ইংরেজির শিক্ষিকা। পাশাপাশি করতেন দোভাষীর কাজ। কাকে বিয়ে করবেন রোনা ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না। ১৯৫২ সালে পেট্রোসিয়ান ও গেলার, দু’‌জনেই সুইডেনে ইন্টার জোনাল খেলতে গিয়েছিলেন। সেখানে রোনাও হাজির। রোনা ওখানে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইন্টার জোনালে পেট্রোসিয়ান ও গেলারের মধ্যে যিনি ভাল ফল করবেন, তাঁকেই বিয়ে করবেন। ওখানে গেলারের চেয়ে আধ পয়েন্টে বেশি করেছিলেন পেট্রোসিয়ান। ফলে রোনা বিয়ে করেছিলেন তাঁকেই।
জীবনের শেষ কয়েক মাস গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। তার মধ্যেও দাবার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। ১৯৮৪ সালে দু’‌বার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন গ্যারি কাসপারভ। কথা হয়েছিল আনাতলি কারপভের বিরুদ্ধে বিশ্ব দাবার খেতাবি লড়াইয়ে কাসপারভের সেকেন্ড হিসেবে কাজ করবেন পেট্রোসিয়ান। উল্লেখ্য, ১৯৬৩ সালে পেট্রোসিয়ান যখন প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য বটভিনিকের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন, তার মাঝেই জন্ম (‌১৩ এপ্রিল)‌ কাসপারভের। তা যাই হোক, কাসপারভের সেকেন্ড হিসেবে কাজ করার সুযোগ অবশ্য আর হয়নি পেট্রোসিয়ানের। ১৯৮৪ সালের ১৩ আগস্ট মারা যান টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান, পাকস্থলীর ক্যান্সারে।
এখন আর্মেনিয়ায় আরও একজন বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড় রয়েছেন ওই নামে, টাইগ্রান এল পেট্রোসিয়ান। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টাইগ্রান ভি পেট্রোসিয়ানের মৃত্যুর ১ মাস ৪ দিন পর (‌১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪)‌ যাঁর জন্ম। এই জুনিয়র পেট্রোসিয়ানের বাবা ছিলেন দাবাপ্রেমী। টাইগ্রান পেট্রোসিয়ানের ভক্ত। টাইগ্রান পেট্রোসিয়ান যখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন, তখনই তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন তাঁর পুত্রসন্তান হলে নাম রাখবেন টাইগ্রান। তাই ওই নাম রেখেছিলেন।
আরও নানাভাবে আর্মেনিয়ায় ধরে রাখা হয়েছে পেট্রোসিয়ানের স্মৃতি। তিনি মারা যাওয়ার তিন বছর পর, ১৯৮৭ সালে বসানো হয় পেট্রোসিয়ানের মূর্তি। যা উন্মোচন করেছিলেন গ্যারি কাসপারভ। ২০০৬ সালের ৭ জুলাই ইরেভানের দাবতাসেন জেলায় একটি রাস্তা পেট্রোসিয়ানের নামে করা হয়। সেই রাস্তার ধারে তৈরি হয় একটি স্মৃতি স্মারকও। মুলকিতে তাঁর জন্মভিটেয়ও রয়েছে স্মৃতিস্মারক। আর পরের প্রজন্মের দাবা খেলোয়াড়দের হাতে হাতে স্মৃতি হিসেবে রয়েছে পেট্রোসিয়ান ও তাঁর খেলা নিয়ে লেখা একগুচ্ছ বই।
আজ জন্মদিনে দাবার নবম বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে শ্রদ্ধা, প্রণাম।


জন্ম:‌ ১৭ জুন, ১৯২৯।
মৃত্যু:‌ ১৩ আগস্ট, ১৯৮৪। ‌‌

Saturday, June 13, 2020

‘‌নো মুস্তাক, নো টেস্ট’‌ ইডেনে হেনস্থা করা হয়েছিল দলীপকে!‌




টেস্টে সর্বোচ্চ ১৭৩ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন ১৯৩০ সালে লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ওটাই ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দলীপের প্রথম টেস্ট। উল্লেখ্য, রণজিও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন। তবে রণজির ওটা ছিল জীবনেরও প্রথম টেস্ট।



‘‌নো মুস্তাক, নো টেস্ট’‌
ইডেনে হেনস্থা করা
হয়েছিল দলীপকে!‌


নির্মলকুমার সাহা


তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্রিকেটার, তখনই নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, ‘‌গত দু-‌বছরের সবচেয়ে সম্ভাবনাপূর্ণ ব্যাটসম্যান দলীপ সিংজি। এটা এই তরুণ ভারতীয়র প্রতি অশোভন ও অবান্তরও যে প্রতি ক্ষেত্রেই তার খেলা নিয়ে আলোচনায় রণজির নাম টেনে আনা হয়।’‌
গুজরাটের কাথিয়াবাড় অঞ্চলের নবনগরে সরোদর গ্রামে দলীপ সিংজির জন্ম, ১৯০৫ সালের ১৩ জুন। এমন একটি রাজ পরিবারে দলীপের জন্ম, যেখানে সব খেলার আগে ছিল ক্রিকেট। ওই পরিবারেরই রণজি সিংজি ক্রিকেট খেলে বিশ্ববন্দিত। প্রতি বছরই ইংল্যান্ড থেকে রণজি নিজের দেশে যখন আসতেন, সঙ্গে থাকতেন সে দেশের অনেক ক্রিকেটার-‌বন্ধুও। সরোদরে গ্রামের বাড়িতেও সেই ব্রিটিশ বন্ধুদের নিয়ে কয়েকদিনের জন্য যেতেন। গ্রামের বাড়ির সামনের মাঠে তাঁবু টাঙানো হত। বসত ক্রিকেটের আসর। দলীপের দাদা হিম্মত সিংজির একটা পুরনো লেখা থেকে জানা যায়, গ্রামের মাঠের সেই ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিতেন ইংল্যান্ডের নামী টেস্ট তারকারাও। যেমন আর্চি ম্যাকলরেন, উইলফ্রেড রোডস, সি বি ফ্রাই, লর্ড হক।
দলীপ ছিলেন ৪ ভাইয়ের মধ্যে ছোট। ভাইদের মধ্যে দলীপের ক্রিকেটপ্রেমই ছিল বেশি। রণজির কাছেই দলীপের ক্রিকেটে হাতেখড়ি। রণজির লেখাতেই রয়েছে, ‘‌দলীপের বয়স যখন আট বছর, তখন আমি ওকে কোচিং দেওয়া শুরু করি। তেরো বছর বয়স পর্যন্ত ও আমার কোচিংয়ে ছিল। তখনই লক্ষ্য করেছিলাম, নিখুঁত রক্ষণাত্মক ব্যাটমস্যান হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা ওর রয়েছে।’‌ ‌
১৯১৯-‌এর এপ্রিলে দলীপ চলে যান ইংল্যান্ডে। তার আগেই এদেশে ক্রিকেট সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে যান। রাজকোটে রাজকুমার কলেজের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্কুলে। রাজকুমার কলেজেই নর্থ উইং বনাম সাউথ উইংয়ের একটি ম্যাচে মাত্র ১৩ বছর বয়সে শতরান করেন। খেলাটি যে ছোটদের ছিল, তা নয়। কলেজের বড়দের বিরুদ্ধে খেলেই শতরান করেছিলেন দলীপ। ইংল্যান্ডে গিয়েও স্কুল পর্যায়ের খেলায় শুরুতেই কয়েকটি শতরান হাঁকান।
১৯২১ সালে কেলটেনহামের হয়ে কলেজ ক্রিকেটের প্রথম বছরে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৩১। আর ১৭ গড়ে পেয়েছিলেন ৩৯ টি উইকেট। পরপর তিন বছর কলেজ দলে ছিলেন অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। এরপর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ। সেখানেও ক্রিকেটার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তারপর ধাপে ধাপে সাসেক্স হয়ে ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেট দলে ঢুকে পড়া। ইংল্যান্ডের হয়ে ১২ টি টেস্টের ১৯ ইনিংসে দলীপের রান ৯৯৫। গড় ৫৮.‌৫২। শতরান ৩। টেস্টে সর্বোচ্চ ১৭৩ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন ১৯৩০ সালে লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ওটাই ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দলীপের প্রথম টেস্ট। উল্লেখ্য, রণজিও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন। তবে রণজির ওটা ছিল জীবনেরও প্রথম টেস্ট। দলীপের সংক্ষিপ্ত অথচ ঊজ্জ্বল ক্রিকেট জীবনের প্রথম টেস্টটা অবশ্য মনে রাখার মতো নয়। ১৯২৯ সালে এজবাস্টনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে রান করেছিলেন মাত্র ১২ ও ১। তা যাই হোক, লর্ডসে দলীপের ওই ১৭৩ রানের ইনিংসটি মাঠে বসে দেখেছিলেন রণজি। নেভিল কার্ডাস লিখেছেন, "...he hit too soon and was caught Bradman, bowled Grimmet. His uncle (Ranji) was present, watching from a box. Duleep, after removing his pads, went into the presence. And Ranji greeted him with a severe ‘‌My boy, that was a very careless stroke‌‌’‌.‌‌‌" 
দলীপের ‌‌ঊজ্জ্বল ক্রিকেট জীবনকে সংক্ষিপ্ত করেছিল অসুস্থতা। টেস্ট অভিষেকের ২ বছর আগেই ১৯২৭ সালে তিনি প্রথম অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্লুরিসিতে আক্রান্ত হন। যদিও ওই বছরের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। কেমব্রিজের হয়ে ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে ১০১ এবং মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে ৪৩ ও অপরাজিত ২৫৪। ওই মরশুমে মাত্র ৫ টি ইনিংস খেলে ৪৩৪ রান করেন। গড় ১০৮.‌৫। তারপরই অসুস্থতা। এরপরই চিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য চলে যেতে হয়েছিল সুইৎজারল্যান্ডে। ক্রিকেটে ফিরেছিলেন পরের মরশুমের কিছু খেলা হয়ে যাওয়ার পর। এবং ছিলেন রানের মধ্যেই। সাসেক্সের হয়ে ১৯ ইনিংসে ১০৮২ রান। গড় ৬০.‌১১। মাঝেমধ্যে অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি খেলে চলেছিলেন। ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলার ডাকও পান তারই মধ্যে। ১৯২৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। 
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ‌দলীপের সর্বোচ্চ রান ৩৩৩। ১৯৩০ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে সাসেক্সের হয়ে নর্দামটনশায়ারের বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় (‌৩৩০ মিনিট)‌ ওই রান করেছিলেন। দীর্ঘ ৭৩ বছর ওটা ছিল  কাউন্টিতে সাসেক্সের কোনও ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ২০০৩ সালে ওই রেকর্ড ভেঙে ৩৩৫ করেন মারে গুডউইন। ১৯৩২ সালেও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দলীপের রানের গড় ছিল ৫২.‌১৭। কিন্তু ওখানেই শেষ। চিকিৎসকের নির্দেশে বিদায় জানাতে হয় ক্রিকেটকে। শেষ টেস্ট ১৯৩১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। বৃস্টিতে ভেস্তে যাওয়া সেই টেস্টে একটি ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে দলীপ করেছিলেন ৬৩ রান।
১৯৩১ সালের শেষ দিকে কিছুদিনের জন্য দলীপ যখন ভারতে আসেন তখনও অমর সিং পরিচিত বোলার নন। কিন্তু দলীপের নজরে পড়ে যান। ১৯৩২ সালে ভারতের প্রথম ইংল্যান্ড সফরের জন্য দল নির্বাচন কমিটিতে ‘‌কো-‌অপ্ট’‌ করে রাখা হয়েছিল দলীপকে। তাঁর মনে হয়েছিল, ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় অমর সিং সাফল্য পাবেন। দলীপের প্রস্তাবেই ১৯৩২ সালে ভারতের প্রথম ইংল্যান্ড সফরের দলে ঢুকেছিলেন অমর সিং। দলীপ যে তখন ভুল করেননি, তা পরে প্রমাণিত হয়েছিল। ওই সফরে ভারতের বিরুদ্ধে সাসেক্সের হয়ে খেলেওছিলেন দলীপ। তবে সাফল্য পাননি। অধিনায়ক দলীপ করেছিলেন মাত্র ৭ রান।
আরও পরে ভারতের জাতীয় দল নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময়েই তো কলকাতায় পোস্টার পড়েছিল ‘‌নো মুস্তাক, নো টেস্ট’‌। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পরেপরেই লিন্ডসে হ্যাসেটের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দল ভারত সফরে এসেছিল ‘‌বেসরকারি টেস্ট’‌ খেলতে। যে দলের সহ-‌অধিনায়ক ছিলেন কিথ মিলার। কলকাতা ‘‌টেস্ট’‌-‌এ দলে ছিলেন না মুস্তাক আলি। যার ফলে ‘‌টেস্ট’‌ শুরুর দু’‌দিন আগে ইডেনে কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমীরা হেনস্থা করেছিলেন দলীপকে। চাপে পড়ে মুস্তাক আলিকে দলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আত্মজীবনী ‘‌Cricket Delightful‌‌’‌-‌এ মুস্তাক আলি ওই ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, "‌I was really ashamed and extremely aggrieved at the way they behaved with that great cricketer and a very fine gentleman too. Duleepsinhji was pushed and pulled, even though I had intervened unavailangly, until he had given an assurance that he would try his best to have Mushtaq in the team for the 'Test' due to begin the day after."
ইংল্যান্ড থেকে পাকাপাকি দেশে ফেরার পর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ভারতের রাষ্ট্রদূতও হয়েছিলেন। সফল ক্রিকেটার দলীপ রাষ্ট্রদূত হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আরও পরে সৌরাষ্ট্রের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা কখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ১৯৫৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ঘুমের মধ্যেই মুম্বইয়ে জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পর ওঁর নামে দলীপ ট্রফি চালু হয় ১৯৬১-‌৬২ মরশুম থেকে।
আজ জন্মদিনে দলীপসিংজিকে প্রণাম।  ‌

জন্ম:‌ ১৩ জুন, ১৯০৫
মৃত্যু:‌ ৫ ডিসেম্বর, ১৯৫৯

Thursday, June 11, 2020

চিরশ্রেষ্ঠ সমুদ্র অভিযাত্রী




প্রথম ভারতীয় হিসেবে সাঁতরে পার হয়েছিলেন ইংলিশ চ্যানেল। পাঁচ মহাদেশের সাত সমুদ্র সাঁতরে পার হওয়ার নজিরও রয়েছে তাঁর। ‘‌গিনেস বুক অফ রেকর্ডস’‌-‌এ দুঃসাহসিক মিহির সেনের পরিচয় দেওয়া আছে ‘‌বিশ্বের চিরশ্রেষ্ঠ দূরপাল্লার সাঁতারু’‌।



চিরশ্রেষ্ঠ সমুদ্র
অভিযাত্রী


নির্মলকুমার সাহা


(‌আজ ১১ জুন। ১৯৯৭ সালের এই দিনেই জীবনাবসান হয়েছিল চিরশ্রেষ্ঠ সমুদ্র অভিযাত্রী মিহির সেনের। আজ মৃত্যু দিনে তাঁকে স্মরণ, একটি পুরনো লেখায়।)‌

সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে এখনও তাঁর নাম ঊজ্জ্বল। তিনি মিহির সেন। প্রথম ভারতীয় হিসেবে যিনি সাঁতরে পার হয়েছিলেন ইংলিশ চ্যানেল। পাঁচ মহাদেশের সাত সমুদ্র সাঁতরে পার হওয়ার নজিরও রয়েছে তাঁর। ‘‌গিনেস বুক অফ রেকর্ডস’‌-‌এ দুঃসাহসিক মিহির সেনের পরিচয় দেওয়া আছে ‘‌বিশ্বের চিরশ্রেষ্ঠ দূরপাল্লার সাঁতারু’‌।
মিহির সেনের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর পুরুলিয়ার ছোট এক গ্রামে। বাবা ডাঃ রমেশ সেন, মা লীলাবতী। বাবা চিকিৎসক হলেও ওখানে বিশেষ আয় ছিল না। গ্রামের গরীব রুগিদের বিনা পয়সায় দেখতেই চলে যেত অনেকটা সময়। এদিকে জন্মের পর থেকেই মিহির রুগ্ন, অসুস্থ। একসময় মা-‌বাবা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন গ্রামে থেকে ওই রুগ্ন ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন কিনা!‌ ফলে সিদ্ধান্ত নেন গ্রাম ছাড়ার। পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামের পরিচিত ‘‌ডাক্তার বাবু’‌ চলে যান কটকে। সেখানেই লেখাপড়া, বেড়ে ওটা। ছেলের ভবিষ্যৎ ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য মা লীলাবতী কটকে যাওয়ার পর বাড়ির সামনের ঘরে খুলে ফেলেছিলেন একটি ছোট দোকানও। যেখানে বিক্রি করতেন মুরগির ডিম ও দুধ। কটকেই স্কুলের পড়া শেষ করার পর উৎকল ইউনিভার্সিটি থেকে ল পাস করেন মিহির। এরপর পরিকল্পনা করেন ব্রিটেনে আইন নিয়ে উচ্চ শিক্ষার। কিন্তু ছেলেকে ব্রিটেনে পাঠানোর মতো আর্থিক অবস্থা মা-‌বাবার ছিল না। বিজু পটনায়েক তখন ওড়িশার তরুণ নেতা। তাঁর কাছে যান মিহির। প্রথমে সাড়া না পেলেও ৬ মাস পর বিজু পটনায়েক কিছুটা সাহায্য করেন। এভাবেই ব্রিটেনে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়া মিহিরের।
সেখানে গিয়েও অসহায় অবস্থা। খরচ চালাবেন কীভাবে?‌ প্রথমে এক রেল স্টেশনে রাতে মালবাহকের কাজ শুরু করেন। কিন্তু কয়েকদিন পর তাঁকে ওখান থেকে বিতাড়িত হতে হয়। খবর পান ভারতীয় হাই কমিশনে এদেশ থেকে যাওয়া ছাত্রদের কাজ দেওয়া হয়। সেখানে ঢুকে পড়েন। চলতে থাকে সেই কাজ ও ব্যারিস্টারি পড়া। ওই সময়ই জলের নেশায় পড়ে যান। ঠিক করেন সাঁতার শিখে ইংলিশ চ্যানেল পার হবেন। ব্যাপারটা যে সহজ নয়, তা বুঝতে পারেন চ্যানেলের জলে নেমে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮, চার বছরে ব্যর্থ হন ৭ বার। চ্যানেলের টানে তিনি এতটাই বঁুদ হয়ে পড়েছিলেন যে ব্যারিস্টারি পাস করে ভারতে চলে এসে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করার পরও সেই জলের নেশা থেকে বের হতে পারেননি। তাই প্রতি বছরই চলে যেতেন ইংলিশ চ্যানেলর টানে। আরও একবার চেষ্টা করতে। ব্যর্থতার সাতবারই তিনি চেষ্টা করেছিলেন ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে আসার। এরপর ঠিক করেন ইংল্যান্ডে থেকে ফ্রান্সে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই চেষ্টায় সফলও হন। ১৯৫৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার হন। সময় লাগে ১৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট।
শুধু ইংলিশ চ্যানেল জয়ের ক্ষেত্রে নয়, অভিযান সাঁতারের আরও অনেক ব্যাপারেও ভারতে তিনি পথপ্রদর্শক। শ্রীলঙ্কা থেকে ভারত, বিপদসঙ্কুল পক প্রণালী তিনিই প্রথম সাঁতার কেটে পার হয়েছিলেন, ১৯৬৬ সালের ৫-‌৬ এপ্রিল। সময় লেগেছিল ২৫ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। পক প্রণালীতে সাঁতার কাটা যায়, মিহির সেনের আগে কোনও মানু্ষ ভাবতেই পারেননি। ওই ১৯৬৬ সালটা সমুদ্র অভিযানের ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় বছর। যাঁর নায়ক ছিলেন মিহির সেন। পক প্রণালীর পর জিব্রাল্টার। এশিয়ার প্রথম মানুষ হিসেবে মিহির জিব্রাল্টার পার হয়েছিলেন ওই বছর ২৪ আগস্ট। সময় ৮ ঘণ্টা ১ মিনিট। এর ১৯ দিন পর, ১২ সেপ্টেম্বর পার হয়েছিলেন দারদানেল প্রণালী। বিশ্বে তিনিই প্রথম। সময় লেগেছিল ১৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। রাশিয়ার ব্ল্যাক সি থেকে ইস্তানবুলের গোল্ডেন হর্ন, যার নাম বসফরাস প্রণালী। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ২১ সেপ্টেম্বর পেরিয়ে যান সেটাও। সময় ৪ ঘণ্টা। ওখানেই থেমে যাননি। এবার পানামা চ্যানেল। ২৯-‌৩১ অক্টোবর, ৩৪ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে জয় করেছিলেন পানামা চ্যানেল। এই চ্যানেল জয়ের ক্ষেত্রে মিহির সেন বিশ্বের তৃতীয় মানুষ। আমেরিকার বাইরে তিনিই প্রথম।
এই সব সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন নানা পুরস্কার, সম্মান। উল্লেখযোগ্য হল ১৯৫৯ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৬৭-‌তে পদ্মভূষণ।
সমুদ্র অভিযানের এরকম একজন সফল নায়ককে শেষ জীবনটা কাটাতে হয়েছে জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে। কারণ অনেকটাই রাজনৈতিক। যার চাপে তাঁর ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষ ১০ বছর কেটেছে কখনও হাসপাতালে, আবার কখনও বাড়ির বিছানায় শুয়ে। অ্যালজাইমার্স ও পার্কিনসনে আক্রান্ত ছিলেন। সল্টলেকের আনন্দলোক হাসপাতালে জীবনাবসান ১৯৯৭ সালের ১১ জুন, রাতে।

Tuesday, June 9, 2020

অলিম্পিকে আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা জন্মেছিলেন কলকাতায়




অলিম্পিকে আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা মার্গারেট অ্যাবট। সেই প্যারিস অলিম্পিকের ৫৫ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়, তখনও জেনে যেতে পারেননি যে তিনি অলিম্পিকে সোনাজয়ী!‌ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি স্বীকৃতি দিয়েছিল আরও অনেক পরে। 



অলিম্পিকে আমেরিকার
প্রথম সোনাজয়ী মহিলা
জন্মেছিলেন কলকাতায় 


নির্মলকুমার সাহা


চার্লস অ্যাবট ছিলেন আমেরিকান ব্যবসায়ী। একসময় আমেরিকার ব্যবসার পাট চুকিয়ে পরিবার নিয়ে শিকাগো থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। এই শহরেই শুরু করেছিলেন নতুন করে ব্যবসা। কলকাতাতেই ১৮৭৮ সালের ১৫ জুন জন্ম তাঁর মেয়ে মার্গারেটের। কিন্তু মার্গারেটের শৈশবেই হঠাৎ মারা যান চার্লস। স্বামীর মৃত্যুর পর কলকাতায় আর থাকতে চাননি চার্লসের স্ত্রী মেরি। সন্তানদের নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন শিকাগোয়। বিয়ের আগে থেকেই মেরি গল্ফ খেলতেন। অন্য একটি নেশাও ছিল, লেখালেখি। কলকাতা থেকে শিকাগোয় ফিরে গিয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওই লেখালেখিকেই। ওখানকার পত্রপত্রিকায় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখতেন। ‘‌Chicago Tribune’‌ ও অন্য কিছু সংবাদপত্রে লিখতেন, বুক রিভিউ করতেন। পরে ‘‌Chicago Tribune‌‌’‌-‌এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকও হয়েছিলেন। পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছিলেন গল্ফ খেলাও। মেয়ে মার্গারেটকেও নিয়ে এসেছিলেন গল্ফে। মা-‌মেয়ে একসঙ্গে গল্ফ খেলতে যেতেন সি বি ম্যাকডোনাল্ডস গল্ফ ক্লাবে। সেখানে ওঁদের কোচ ছিলেন এডওয়ার্ড ফ্রস্ট। পরে ওই কলকাতা-‌জাত মার্গারেট অ্যাবটই অলিম্পিকে আমেরিকার হয়ে গল্ফে সোনা জিতেছিলেন, ১৯০০ সালে। অলিম্পিকে তিনিই আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা। 
উল্লেখ করার মতো ব্যাপার, ওই প্যারিস অলিম্পিকে কলকাতা-‌জাত আরও একজন পদক জিতেছিলেন। তিনি নর্মান প্রিচার্ড। যিনি অলিম্পিকে পদকজয়ী প্রথম ভারতীয়। নর্মান প্রিচার্ড সেই অলিম্পিকে অ্যাথলেটিক্সে জোড়া রুপো জিতেছিলেন। ২০০ মিটার দৌড় ও ২০০ মিটার হার্ডলস (‌এখন অলিম্পিকে এই ইভেন্টটি নেই)‌।
১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরে মহিলাদের কোনও খেলা ছিল না। অলিম্পিকে মহিলাদের প্রবেশ ১৯০০ সালে প্যারিসে। ওই একই সময়ে প্যারিসে চলেছিল তৃতীয় বিশ্ব প্রদর্শনী (Exposition Universelle‌)‌। সব মিলিয়ে সেই প্যারিস অলিম্পিকে সাংগঠনিক ব্যর্থতা চূড়ান্ত আকার নিয়েছিল। নানা কারণে সেবার অলিম্পিকে সব খেলা একই সময়ে করা যায়নি। সেই প্যারিস অলিম্পিক চলেছিল পাঁচ মাস ধরে। আলাদা আলাদা সময়ে আলাদা আলাদা খেলা। তার মধ্যে আবার বেশ কিছু খেলা মূল অলিম্পিকের তালিকায় ছিল না। যা ছিল ‘‌প্রদর্শনী’‌ হিসেবে চিহ্নিত। ফলে অনেক খেলোয়াড়ই জানতেন না, তাঁরা অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছেন, নাকি সেই প্রদর্শনীতে। অনেকে বহু বছর পর জেনেছিলেন, তাঁরা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন বা অলিম্পিক পদক জিতেছিলেন। আবার কয়েকজন তো তা জেনেও যেতে পারেননি। সেই স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই তাঁদের জীবনাবসান হয়েছিল। ওইরকমই একজন অলিম্পিকে আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা মার্গারেট অ্যাবট। সেই প্যারিস অলিম্পিকের ৫৫ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়, তখনও জেনে যেতে পারেননি যে তিনি অলিম্পিকে সোনাজয়ী!‌
মার্গারেট অলিম্পিকে সোনা জিতেছিলেন গল্ফের নাইন হোল ইভেন্টে ৪৭ পয়েন্ট করে। ৪ অক্টোবর ওই ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন মার্গারেটের মা মেরি পার্কিন্স ইভস অ্যাবটও। মেয়ের সঙ্গে লড়াইয়ে মা অবশ্য পেরে ওঠেননি। তিনি পেয়েছিলেন সপ্তম স্থান। কিন্তু অলিম্পিকে মা ও মেয়ের একই সঙ্গে একই ইভেন্টে অংশ নেওয়াটা নজির হয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছিলেন যথাক্রমে পৌলিন উইটিয়ার ও ডারিয়া প্রাট। ওই দু’‌জনও আমেরিকার।
অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্য নয়, মা ও মেয়ে প্যারিসে গিয়েছিলেন একবছর আগেই, ১৮৯৯ সালে। মার্গারেট প্যারিসে গিয়েছিলেন ওখানকার দু’‌জন (Edgar Degas and Auguste Rodin) ‌বিখ্যাত শিল্পীর কাছে Art and Sculpture শেখার জন্য। সঙ্গে ছিলেন মা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ওখানে বসে উপন্যাস, গল্প লিখবেন। পাশাপাশি ভ্রমণ নিয়ে গবেষণা করবেন। শিকাগোয় থাকার সময় দু’‌জনই কিছু গল্ফ প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেয়েছিলেন। ভালই গল্ফ খেলতেন। তাই প্যারিসে গিয়েও গল্ফ খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মা-‌মেয়ে। প্যারিস অলিম্পিকের আমেরিকার সরকারি দলে মা-‌মেয়ের নাম ছিল না। প্যারিসে যে ক্লাবে ওঁরা গল্ফ অনুশীলন করতেন, সেখান থেকেই জানতে পেরেছিলেন একটি আন্তর্জাতিক গল্ফ প্রতিযোগিতা হবে। দু’‌জনই ওই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলেন। শুধু ওঁরা কেন, সবাই জানতেন একটি আন্তর্জাতিক গল্ফ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। আমেরিকা ও ফ্রান্স, দুই দেশের মাত্র ১০ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিলেন। যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন কারও কাছেই ওই গল্ফ প্রতিযোগিতার গুরুত্ব স্পষ্ট ছিল না। বিশেষ করে ফ্রান্সের মহিলাদের কাছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মার্গারেট অ্যাবট বলেছিলেন, ‘‌আমার চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা অনেক সহজ হয়েছিল, কারণ ফরাসি মেয়েরা টুর্নামেন্টটাকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। ওরা খেলতে এসেছিল হাই হিল জুতো, টাইট স্কার্ট পরে, সাজগোজ করে। মনে হচ্ছিল বেড়াতে এসেছে।’‌
১৯০২ সালে মা ও মেয়ে আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন। সেই বছরই মার্গারেট বিয়ে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিনলি পিটার ডুনেকে। ডুবে যান ঘরসংসারে। প্যারিসের সেই গল্ফ চ্যাম্পিয়নশিপ অলিম্পিকের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ১৯৫৫ সালের ১০ জুন মার্গারেটের জীবনবসান হয়। অর্থাৎ মার্গারেট জেনেই যেতে পারেননি যে তিনি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন, তিনিই অলিম্পিকে আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা। তাঁর মৃত্যুর পরও পরিবারের লোকদের ‘‌সোনার খবর’‌ পেতে লেগে গিয়েছিল আরও অনেক বছর। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ওই গল্ফ প্রতিযোগিতাকে অলিম্পিকের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতিই দিয়েছিল মার্গারেট অ্যাবটের মৃত্যুর অনেক পর। তারপরও ওই খবর পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছিল না মার্গারেটের উত্তরসূরিদের কাছে। তাঁদের খোঁজই পাওয়া যাচ্ছিল না। এর বড় কারণ সেবার অলিম্পিকে আমেরিকা যে দল পাঠিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই ‌‌তাতে মার্গারেট এবং মেরির নাম ছিল না। ফলে আমেরিকার অলিম্পিক সংস্থায় ওঁদের ঠিকানা ছিল না।
ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডার প্রফেসর পাওলা ওয়েলচ অলিম্পিকে আমেরিকার মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খোঁজা শুরু করেন মার্গারেট অ্যাবটের উত্তরসূরিদের। ১০ বছর চেষ্টার পর তিনি মার্গারেটের এক পুত্র ফিলিপ ডুনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। Screenwriter, Film director, Producer ‌হিসেবে হলিউডে তখন যথেষ্ট পরিচিত নাম ফিলিপ ডুনে। তবু তাঁকে খুঁজে পেতে এত দেরি কেন?‌ আসলে তিনি চলচ্চিত্র জগৎ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। খেলার জগতের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্কই ছিল না। ক্রীড়া জগতের লোকেরাও জানতেন না যে তিনি মার্গারেট অ্যাবটের পুত্র। তাছাড়া তাঁরা প্রয়োজন মনেও করেননি যে খবরটা মার্গারেট অ্যাবটের পরিবারের লোকেদের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। যাই হোক, পাওলা ওয়েলচ সেই কাজটি করতে পেরেছিলেন। মার্গারেট জেনে যেতে পারেননি। কিন্তু ফিলিপ ডুনে মারা (‌মৃত্যু ২ জুন, ১৯৯২) যাওয়ার বছর তিনেক আগে জানতে পেরেছিলেন তাঁর মা-‌র ‘‌সোনার খবর’‌। যে খবর ফোনে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন পাওলা ওয়েলচ।

জন্ম:‌ ১৫ জুন, ১৮৭৮ (‌কলকাতা)‌
মৃত্যু:‌ ১০ জুন, ১৯৫৫ (‌আমেরিকা)‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌

Saturday, June 6, 2020

নিরক্ষর এক দাবাড়ুর গল্প





বই, অঙ্ক, বুদ্ধি, লেখাপড়া—এত কিছু মিলে যখন দাবা, একজন নিরক্ষর মানুষ কি হয়ে উঠতে পারেন বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়?‌ এক শব্দে উত্তর হতে পারে, ‌‘‌অসম্ভব’‌‌। কিন্তু ওই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পেরেছিলেন মালিক মির সুলতান খান।



নিরক্ষর এক
দাবাড়ুর গল্প 


নির্মলকুমার সাহা


বই ছাড়া দাবা, ভাবাই যায় না। দাবা মানেই অজস্র বই।‌ অঙ্ক আর অঙ্ক। যুগের পর যুগ এরকমই চলে আসছে। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কম্পিউটার। বই, অঙ্ক, বুদ্ধি, লেখাপড়া—এত কিছু মিলে যখন দাবা, একজন নিরক্ষর মানুষ কি হয়ে উঠতে পারেন বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়?‌ এক শব্দে উত্তর হতে পারে, ‌‘‌অসম্ভব’‌‌। কিন্তু ওই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পেরেছিলেন অবিভক্ত ভারতের একজন। তিনি মালিক মির সুলতান খান। নাম যাই হোক, তিনি মালিক, মির বা সুলতান, কোনওটাই ছিলেন না। ছিলেন দরিদ্র পরিবারের এক সন্তান।
অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের সরগুড়া জেলার মিঠা গ্রাম। যা এখন পাকিস্তানে। ওই গ্রামেই থাকতেন এক ধর্মীয় নেতা নিজামুদ্দিন। তাঁর দশম পুত্র সুলতানের জন্ম ১৯০৫ সালে। কোন মাসে?‌ কত তারিখে?‌ তা অবশ্য সুলতান খান কখনও বলতে পারেননি। নিজামুদ্দিন এতটাই গরীব ছিলেন যে সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। একটু-‌আধটু দাবা খেলা জানতেন নিজামুদ্দিন। ছেলেদের লেখাপড়া শেখাতে না পারলেও ভারতীয় পদ্ধতিতে দাবা খেলা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত দাবায় ওই ভারতীয় পদ্ধতিই সুলতানের সম্বল ছিল।
স্যর উমর হায়াত খান দাবাপ্রেমী ছিলেন। দাবা খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। একদিন সুলতান খানের খেলা দেখে মুগ্ধ হন। তাঁর মনে হয়, কিছুটা সহযোগিতা পেলে সুলতান বড় দাবা খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারবেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯২৮ সালে সর্বভারতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন সুলতান। একবছর পরই উমর হায়াত খান পঞ্চম জর্জের এ ডি সি হন। তিনি সুলতানকে ব্রিটেনে নিয়ে যান তাঁর কর্মচারী হিসেবে। ১৯২৯ সালের ২৬ এপ্রিল সুলতান খান ব্রিটেনে যান। ব্রিটেনে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই দাবার আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন শিখে ফেলেন। শুধু তাই নয়, সেই ১৯২৯ সালেই ব্রিটিশ দাবায় চ্যাম্পিয়ন হন সুলতান। ১৯২৯-‌এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৩৩-‌এর শেষ দিক পর্যন্ত ব্রিটেনে ছিলেন। তাও আবার টানা নয়। উমর হায়াত খানের সঙ্গে ১৯২৯-‌এর নভেম্বর থেকে ১৯৩০ সালের মে পর্যন্ত ভারতে এসে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু ওই অল্প কয়েকবছরেই ব্রিটেনে সুলতানের সাফল্য মনে রাখার মতো। ব্রিটিশ দাবায় চারবার খেলে তিনবার চ্যাম্পিয়ন। ১৯২৯, ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে। ভারতে চলে আসায় ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ দাবায় খেলতে পারেননি। মাত্র একবারই ১৯৩১ সালে খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি।
তিনটি দাবা অলিম্পিয়াডে (‌১৯৩০, ১৯৩১, ১৯৩৩)‌ খেলেছেন ব্রিটেনের হয়ে। তিনটিতেই ছিলেন একনম্বর বোর্ডের খেলোয়াড়। ১৯৩০ সালে হামবুর্গে ১৪ রাউন্ডে করেছিলেন ১১ পয়েন্ট। শুধু দাবা অলিম্পিয়াড নয়, ওই সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাবায়ও ব্রিটেনের হয়ে খেলেছেন। তখন আন্তার্জাতিক কোনও প্রতিযোগিতাতেই প্রথম চারের বাইরে যাননি। ১৯৩০ সালেই হেস্টিংসে আন্তর্জাতিক দাবায় হারান প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কাপাব্লাঙ্কাকে। ‘‌মর্নিং পোস্ট’‌-‌এ সুলতানের খেলার প্রশংসা করে লেখা হয়েছিল, ‘‌রনজি অফ চেস’‌। কাপাব্লাঙ্কা পরে লিখেছিলেন, ‘‌ভারতীয় নিয়মে ভারতসেরা ছিল সুলতান। ইউরোপে এসে দাবার আন্তর্জাতিক নিয়ম শিখে অল্পদিনেই যে সাফল্য পেয়েছিল, তাতে ওকে জিনিয়াস ছাড়া অন্য কিছু বলা সম্ভব নয়’‌। সুলতান খান-‌কাপাব্লাঙ্কার সেই খেলাটি দাবা ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৩১ সালে প্রাগে দাবা অলিম্পিয়াডে তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আলেকজান্ডার আলেখিনের সঙ্গে ড্র। ১৯৩১-‌এ হেস্টিংসে ও ১৯৩২-‌এ বার্নে ড্র করেন ম্যাক্স ইউয়ের সঙ্গে। হল্যান্ডের এই তারকা পরে ১৯৩৫ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে সুলতান হারান আমেরিকার বিখ্যাত খেলোয়াড় ফ্রাঙ্ক জেমস মার্শালকে।
এত সাফল্যের পরও সুলতানের আন্তর্জাতিক দাবা জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ সুলতান পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন উমর হায়াত খানের ওপর। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকাপাকি ভারতে ফিরে আসেন উমর হায়াত খান। ফলে ফিরে আসতে হয় সুলতানকেও। শেষ হয়ে যায় সুলতানের আন্তর্জাতিক দাবা জীবনও। এখানেই একটি বড় প্রশ্ন, উমর হায়াত খান কি সত্যিই সুলতানের দাবা খেলা পছন্দ করতেন?‌ সত্যি কি তিনি চাইতেন, সুলতান দাবা খেলে আরও প্রতিষ্ঠা পান?‌ তাই যদি হবে, তাহলে তো তিনি সুলতানকে ব্রিটেনে রেখেই আসতে পারতেন। তখনকার নানা পত্রপত্রিকায় সুলতান খানকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিছু লেখায় উমর হায়াত খানের ‘‌গৃহভৃত্য’‌ হিসেবেই সুলতান চিহ্নিত হয়েছেন। যেমন আমেরিকার বিখ্যাত দাবাড়ু রুবেন ফাইন লিখেছেন, ‘‌১৯৩৩ সালে দাবা অলিম্পিয়াডের পর উমর হায়াত খান তাঁর বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমাদের। সেখানে গিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। একজন গৃহভৃত্যের যা কাজ সবই সুলতান খানকে দিয়ে করাচ্ছিলেন উমর হায়াত খান। আমাদের খাবার দেওয়া, টেবিল পরিষ্কারের কাজও করতে হচ্ছিল সুলতানকে। অত উঁচু পর্যায়ের একজন খেলোয়াড়কে ওই অবস্থায় দেখে ব্যথিত হয়েছিলাম। সুলতানের সাফল্যের সামান্য স্বীকৃতিও উমর হায়াত খান দেননি!‌’‌
‌‌ভারতে ফিরে আসার পর বেশিদিন দাবা খেলেননি সুলতান। ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তখনকার ভারত চ্যাম্পিয়ন ভি কে খাদিলকারের সঙ্গে ১০ গেমের একটি সিরিজে অংশ নেন। প্রথম গেমটি ড্র। বাকি ৯টিতেই জেতেন সুলতান। ওই জয়ের পরই অবসর নেন। সুলতান খান অত বড় খেলোয়াড় হয়েও ছেলেদের দাবায় আনেননি।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম। শেষ জীবনও কেটেছে প্রবল দারিদ্র‌্যের মধ্যেই। দেশে ফিরে আসার পর উমর হায়াত খান একখণ্ড চাষের জমি দিয়েছিলেন সুলতানকে। ওখানে চাষ করেই বাকি জীবন কাটাতে হয়। তখন সবসময়ের সঙ্গী ছিল হুক্কা। সকাল থেকে রাত, বাড়ির সামনে গাছতলায় বসে হুক্কা টানতেন। একসময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। ওই অবস্থায়ও টেনে যেতেন হুক্কা। চিকিৎসা করার টাকা ছিল না। প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ওই সরগুড়ায়, ১৯৬৬ সালের ২৫ এপ্রিল।
সুলতান খান তখন বেঁচে। আমেরিকা থেকে ইসমাইল স্লোয়ান গিয়েছিলেন মিঠা গ্রামে সুলতানকে নিয়ে একটি লেখার জন্য। তাঁর সেই লেখা পড়ে জানা যায় দারিদ্র‌্য, যক্ষ্মা, হুক্কার মাঝেও সুলতানের মন থেকে দাবা তখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। কোনও লোক দেখলেই দাবা খেলতে চাইতেন। দাবা খেলতে চেয়েছিলেন ইসমাইল স্লোয়ানের সঙ্গেও।
সুলতান যে বছর মারা যান, সেই ১৯৬৬ সালেই প্রকাশিত হয় টেরেঙ্ক টিলার সম্পাদিত ‘‌Chess Treasury Of The Air‌’‌ বইটি। তাতে ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট দাবা খেলোয়াড় হ্যারি গোলোমবেক লিখেছেন, ‘‌১৯২৯ সালের গ্রীষ্মে সুলতান খান যখন প্রথম ইউরোপে আসে ‌পড়তে বা লিখতে পারা তো দূরের ব্যাপার, ইউরোপের কোনও ভাষায় (‌পড়ুন ইংরেজি)‌ কথাও বলতে জানত না। .‌.‌.‌.‌ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার সময় আমরা একই বোর্ডিং হাউসে ছিলাম। ওখানে আমরা দু’‌জনই শুধু দাবা খেলোয়াড়। ভাষা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আকারে-‌ইঙ্গিতে আমাদের মত বিনিময় হত। আর দাবা খেলতে গিয়ে তো ঘুঁটির চালই আসল ব্যাপার। ভাষা সেখানে কোনও সমস্যা নয়। কোনও বড় সমস্যা হলে দোভাষীর সাহায্য নিতাম। তখনই আবিস্কার করেছিলাম, সুলতান খান লেখাপড়া জানে না। .‌.‌.‌.‌ ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত রসিকতাবোধ ছিল। সবেতেই খুব জোরে হেসে উঠত।’‌
ইসমাইল স্লোয়ানের লেখা পড়ে মনে হয় প্রবল দারিদ্র‌্য, অসুস্থতার মধ্যেও ওই হাসি তিনি ধরে রেখেছিলেন শেষ বয়সেও।
তখনও গ্র‌্যান্ড মাস্টার টাইটেল দেওয়া শুরু হয়নি। তাই সুলতান খানের নামের আগে ‘‌জি এম’‌ লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে কী?‌ দাবা বিশ্বে তাঁর খেলা কখনও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। প্রায় তিনদশক আগে চেন্নাইয়ের বেসান্ত নগরের এক বাড়ির টেবিলে একটি বই দেখেছিলাম। বইটির নাম:‌ মির সুলতান খান। লেখক:‌ আর এন কোলস। প্রকাশকাল:‌ ১৯৭৭। বিষয়:‌ সুলতান খানের কিছুটা পরিচিতি ও তাঁর উল্লেখযোগ্য ৬৪টি খেলার ছক-‌সহ বিশ্লেষণ। এক নিরক্ষর দাবাড়ুর খেলা যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি, তা সেদিন বোঝা গিয়েছিল বিশ্বনাথন আনন্দের টেবিলে রাখা ওই বইটি দেখেই। পরে আরও অনেক ঘটনায়ও সেটা বোঝা গিয়েছে। ২০০৪ সালে ওই বইটি আরও বর্ধিত আকারে ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত হয়। নাম:‌ দি বেস্ট গেমস অফ মির সুলতান খান।
কয়েকদিন পর মে মাসের গোড়ায় প্রকাশিত হতে চলেছে মির সুলতান খানকে নিয়ে আরও একটি বই। যার লেখক ব্রিটেনের গ্র‌্যান্ড মাস্টার ড্যানিয়েল কিং। যে বইয়ের প্রচ্ছদেই সুলতান খানকে ‘‌ভৃত্য’‌ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (‌‌এই লেখার সঙ্গে সেই বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিও দেওয়া হল)‌। প্রায় তিনদশক আগে বেসান্ত নগরের বাড়িতে যাঁর টেবিলে আর এন কোলসের লেখা ‘‌মির সুলতান খান’‌ বইটি দেখেছিলাম সেই বিশ্বনাথন আনন্দ লিখেছেন ড্যানিয়েল কিংয়ের এই বইয়ের ভূমিকা। এতেই প্রমাণিত দাবা দুনিয়ায় মির সুলতান খান এখনও একইরকম প্রাসঙ্গিক। 

জন্ম:‌ ১৯০৫।
মৃত্যু:‌ ২৫ এপ্রিল ১৯৬৬।‌‌‌‌‌

Friday, June 5, 2020

ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট এবং চিমার মেয়ে



করোনা আতঙ্কেও বিশ্বের একটা বড় অংশ এখন উত্তাল জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা ঘিরে। বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ চলছে। লন্ডনের রাস্তায় প্রতিবাদে সামিল কলকাতায় খেলে যাওয়া নাইজেরিয়ান ফুটবলার চিমা ওকোরির মেয়ে নেনকাও।





ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট
এবং চিমার মেয়ে 



নির্মলকুমার সাহা


করোনা আতঙ্কেও বিশ্বের একটা বড় অংশ এখন উত্তাল জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা ঘিরে। ‌আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করা হয়েছে ২৫ মে। তারপর ১১ দিন কেটে গেলেও বিশ্ব জুড়ে এখনও প্রতিবাদ চলছে। যে প্রতিবাদে সামিল নামী-‌অনামী অনেকেই। কলকাতায় অনেকদিন ফুটবল খেলে গিয়েছেন নাইজেরিয়ার চিমা ওকোরি। তাঁর মেয়ে নেনকা ওকোরি এখন লন্ডনে থাকেন। শুক্রবার সকালে ‘‌এই সময়’‌ পড়ে জানা গেল চিমার মেয়েও জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে লন্ডনের রাস্তায় মিছিলে হাঁটছেন। ওই প্রতিবাদের ধরণটা অবশ্যই একটু অন্যরকম। নেনকার গায়ের সাদা টি শার্টে ‘‌ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’‌-‌এর সেই বিখ্যাত ছবি। হাতে কালো কালিতে লেখা প্ল্যাকার্ড।
খবরটা পড়তে পড়তেই মন চলে গেল ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই ‘‌ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’‌-‌এ। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হেনস্থা হওয়া নতুন নয়। কখনও কখনও সেটা আবার বেশি করে মাথা চাড়া দেয়। তখনও আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা নানাভাবে হেনস্থা করছিলেন কালো মানুষদের। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গরা। প্রতিবাদও চলছিল আমেরিকা জুড়ে। সেই প্রতিবাদ আন্দোলনের এক সৈনিক ছিলেন নিগ্রো তরুণ টমি স্মিথ। তিনি আবার ভাল দৌড়তেনও। সেই দৌড়ের ট্র‌্যাকেও তাঁকে এবং তাঁর মতো কালো মানুষদের সহ্য করতে হত অনেক লাঞ্ছনা, অপমান। এরকম চলতে চলতেই এসে যায় ১৯৬৮-‌র মেক্সিকো অলিম্পিক। হাজার চেষ্টাতেও আমেরিকার অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্স দল থেকে বাদ দেওয়া যায়নি নিগ্রো টমি স্মিথকে। বাদ দেওয়া যায়নি আরও কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গকেও। কীভাবে বাদ দেওয়া যাবে?‌ ‘‌কৃষ্ণাঙ্গ’‌ ছাড়া আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স হয় নাকি!‌ কালোদের বাদ দেওয়া মানেই অলিম্পিকে আমেরিকার পদকের সংখ্যা অনেক কমে যাওয়া।
অলিম্পিক দলে সুযোগ পাওয়ার পর টমি স্মিথ দুরকম প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এক, সোনা জিততেই হবে। বিশ্ববাসীর কাছে আরও একবার প্রমাণ করতে হবে, আমেরিকায় অবহেলিত কালোরাই জগতের আলো। দুই, ট্র‌্যাকের বাইরেও তিনি যে কালোমানুষদের হয়ে প্রতিবাদের এক ঊজ্জ্বল প্রতীক, সেটাও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে হবে।
এই দু’‌রকম প্রস্তুতিতেই তিনি দেশে পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন আরেক ‘‌কৃষ্ণাঙ্গ’‌ অ্যাথলিট জন কার্লোসকে। টমি স্মিথের মতো তিনিও ২০০ মিটার দৌড়তেন। মেক্সিকো অলিম্পিকের জন্য আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স দলে ২০০ মিটারে টমি স্মিথের সঙ্গে তিনিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলিটদের সংগঠন ‘‌অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’‌-‌এর সদস্য তিনিও।
১৬ অক্টোবর ১৯৬৮। মেক্সিকো অলিম্পিকে ২০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ড গড়ে (‌১৯.‌৮৩ সেকেন্ড)‌ সোনা জেতেন টমি স্মিথ। তিনি ভাঙেন জন কার্লোসেরই আগের বিশ্বরেকর্ড (‌১৯.‌৯২)‌। জন কার্লোস জেতেন ব্রোঞ্জ (‌২০.‌১০ সেকেন্ড)‌। অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ড গড়ে (‌২০.‌০৬ সেকেন্ড)‌ রুপো পিটার নর্মানের। ‌তখন অস্ট্রেলিয়ায় পিটার নর্মানের অন্য একটি পরিচয়ও ছিল। মানবাধিকার রক্ষায় যে কোনও প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতায় আন্দোলনে ছিলেন অক্লান্ত সৈনিক। ২০০ মিটার দৌড় শেষে পিটার নর্মানকে কাছে ডেকে নেন স্মিথ, কার্লোস। জানান তাঁদের পরিকল্পনার কথা। ঠিক হয় পদক নিতে বিজয়মঞ্চে এসেই তাঁরা জানাবেন প্রতিবাদ। পরিকল্পনা মতো খালি পায়ে হাতে কালো গ্লাভস পরে পদক নিতে উঠবেন স্মিথ, কার্লোস। আর পিটার নর্মান স্মিথ, কার্লোসের মতোই ‘‌‌অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’‌-‌এর ব্যাজ পরবেন। কিন্তু মঞ্চে ওঠার আগে গ্লাভস পরতে গিয়েই ধরা পড়ল একটি ভুল। অলিম্পিক ভিলেজ থেকে মাঠে আসার সময় কার্লোস কালো গ্লাভস আনতে ভুলে গিয়েছেন। এবার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেন পিটার। তিনি পরামর্শ দেন স্মিথের দুই হাতের দুটি গ্লাভস ভাগ করে পরতে। সেই মতো ডান হাতেরটা পরেন স্মিথ নিজে। আর বাঁ হাতেরটা পরেন কার্লোস। ছবি দেখলেই পরিষ্কার স্মিথ তুলে আছেন মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত। আর কার্লোস তুলে আছেন বাঁ হাত। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান যখন চলছে আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠতেই টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস কালো গ্লাভস পরা মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে ধরেন। দাঁড়িয়ে থাকেন মাথা নিচু করে। যা ‘‌ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’‌ নামে পরিচিত। আর পিটার নর্মানের বুকে তখন ‘‌অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’‌-‌এর সেই ব্যাজ। অলিম্পিকের বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে এরকম প্রতিবাদ!‌ হইচই পড়ে যায় বিশ্বজুড়ে। স্মিথ, কার্লোসকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনে আমেরিকা। নর্মানকে দেশে ফিরিয়ে না আনলেও অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক সংস্থা তাঁকে সতর্ক করে।
দেশে ফিরেও নানা সমস্যায় পড়তে হয় স্মিথ, কার্লোসকে। বেশ কয়েক বছর ওঁদের পরিবার, পরিজনদের ওপরও চলে অত্যাচার। সেই অত্যাচারের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন কার্লোসের স্ত্রী। সে এক অন্য কাহিনী। অন্য ইতিহাস।
মেক্সিকো অলিম্পিক থেকে ফিরে আমেরিকায় যখন স্মিথ, কার্লোসের জীবন নাজেহাল, তখনও অস্ট্রেলিয়ায় শোনা গিয়েছে পিটার নর্মানের প্রতিবাদী গলার আওয়াজ। স্মিথ, কার্লোসের প্রতিবাদের শরিক হওয়ার পর তিনি বেশ গর্বিতই ছিলেন। সেই ১৯৬৮ সালেই পিটার নর্মান বলেছিলেন, ‘‌আমি যে নীতি ও আদর্শে বিশ্বাস করি, বিশ্বের সেরা ক্রীড়াক্ষেত্রে সেই আদর্শের জন্য লড়াইয়ের শরিক হতে পেরে গর্বিত।’‌ পিটার নর্মান মারা যান ২০০৬ সালের ৩ অক্টোবর। জীবনাবসানের একবছর আগে ২০০৫ সালে তাঁর দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পড়লাম, তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘‌বছরের পর বছর কিছু মানুষের লড়াইয়ে বর্ণবৈষম্য, সামাজিক অবিচার অনেক কমেছে। এতে ভাল লাগে। কিন্তু খারাপ দিকটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এখনও তো সাদা-‌কালো, ধনী-‌দরিদ্র ভেদাভেদ রয়েছে।’‌
মেক্সিকো অলিম্পিকের পরও স্মিথ, কার্লোসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল পিটার নর্মানের। তিনজনের শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৫ সালে। ১৯৬৮-‌র সেই প্রতিবাদের স্মরণে আমেরিকার সান জোসেতে স্মিথ, কার্লোসের মূর্তির আবরণ উন্মোচনের অনুষ্ঠানে। সেখানে পিটার নর্মান বলেছিলেন, ‘‌এ তো এক পরিবারের তিন সদস্যের ফের দেখা হওয়ার মতো ঘটনা।’‌ ওই ঘটনা নিয়ে পিটার নর্মানের ভাইপো ম্যাথু নর্মানের তৈরি করা তথ্যচিত্র ‘‌স্যালুট’‌ আলোড়ন তুলেছিল। ম্যাথুরই লেখা বই ‘‌দ্য পিটার নর্মান স্টোরি’‌। সেখানেও গুরুত্ব পেয়েছে মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই প্রতিবাদ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই টমি স্মিথের আত্মজীবনী ‘‌Silent Gesture’‌-‌এও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই ‘‌ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’‌। একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমেরিকা সম্পর্কে স্মিথের ধারণাটা এরকম, ‘‌যদি আমরা কোনও সাফল্য পাই, আমরা বিশ্বের খেলার মাঠে কোথাও জিতি, তখন কিছুদিনের জন্য আমাদের আমেরিকান হিসেবেই ধরা হয়। তখন আমরা ব্ল্যাক আমেরিকান নই। কিন্তু আমরা কিছু খারাপ করলে, খেলার মাঠে ব্যর্থ হলেই জোর গলায় আমাদের নিগ্রো বলা হয়। আমি কিন্তু সবসময় আমাকে কৃষ্ণাঙ্গই মনে করি। এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমি গর্বিত। শুধু আমি কেন, আমার মতো আরও অনেকেই।’‌

 (‌প্রথম ছবি, মেক্সিকোর সেই ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট। দ্বিতীয় ছবি, লন্ডনে প্রতিবাদ মিছিলে চিমার মেয়ে নেনকা। ছবি ফেসবুকের সৌজন্যে।)‌ 


Wednesday, June 3, 2020

মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল স্টেলা ‘‌Woman with intersex variation’‌





একজনের হাতে ছিল বন্দুক। সেটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে যান স্টেলা। এমন সময়ই গুলি এসে লাগে পেটের নিচের অংশে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অপারেশন টেবিলে মারা যান অলিম্পিক সোনাজয়ী তারকা। 




মৃত্যুর পর জানা
গিয়েছিল স্টেলা
‘‌Woman with
intersex variation’‌



নির্মলকুমার সাহা


আমেরিকার হয়ে অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অংশ নিয়েছিলেন পোলান্ডের হয়ে। তাতে অবশ্য স্টেলা ওয়ালশের সোনা জেতা আটকায়নি। ১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন পোলান্ডের জাতীয় নায়িকা।
আমেরিকার বদলে কেন পোলান্ড?‌ স্টেলার জন্ম পোলান্ডের রুপিনে, ১৯১১ সালের ৩ এপ্রিল। নাম ছিল স্ট্যানিস্লায়া ওয়ালাসিউইকজ। তিন মাস বয়সেই বাবা (‌জুলিয়ান ওয়ালাসিউইকজ)‌ ও মা-‌র (‌ভেরোনিকা)‌ হাত ধরে চলে যেতে হয়েছিল আমেরিকায়। সন্তানকে নিয়ে জুলিয়ান ও ভেরোনার আমেরিকায় পা রাখার কারণ ছিল আর্থিক অনটন। আমেরিকায় গিয়ে যদি কোনও কাজ পাওয়া যায়। আমেরিকায় গিয়ে ওঁরা সংসার পেতেছিলেন ক্লিভল্যান্ডে। জুলিয়ান একটা স্টিল কারখানায় কাজও জুটিয়ে নিয়েছিলেন। আমেরিকায় যাওয়ার পরই ওখানে সহজবোধ্য হওয়ার জন্য জুলিয়ান-‌ভেরোনা মেয়ের আরও একটা নাম রেখেছিলেন, স্টেলা ওয়ালশ। পরে ওই নামেই তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।
আর্থিক সঙ্কটের মাঝেও মেয়েকে অ্যাথলিট হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করেন জুলিয়ান-‌ভেরোনিকা। ক্লিভল্যান্ডে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্টেলার অ্যাথলেটিক্স চর্চা শুরু। ওখানকার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্যও আসতে থাকে। ১৯২৭ সালে আমেরিকায় সিনিয়রদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেন। পরের বছরই, ১৯২৮ সালে আমস্টারডামে অলিম্পিক। আমেরিকার অলিম্পিক দলের প্রস্তুতি শিবিরেও ডাক পান। আমেরিকার অলিম্পিক দলে ওঁর সুযোগ পাওয়া যখন নিশ্চিত তখনই আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। বয়স ২১ বছর না হওয়ায় আমেরিকার নাগরিকত্ব পাননি।
আমস্টারডাম অলিম্পিকে যেতে না পারলেও ওখানে একজনের সাফল্য দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্টেলাকে। তিনি পোলান্ডের হালিনা কোনোপাকা। যিনি মহিলাদের ডিসকাস থ্রো-‌তে সোনা জিতেছিলেন। অলিম্পিকের ইতিহাসে পোলান্ডের ওটাই ছিল প্রথম সোনা। বলতে গেলে সেদিন থেকেই ১৯৩২-‌এর অলিম্পিকের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন স্টেলা। ১৯৩০ সালের মে মাসে ১০০ গজ ১১ সেকেন্ডের কমে দৌড়ন। পরপর আরও সাফল্য। ১৯৩২-‌এ নিজেদের দেশে অলিম্পিক। আমেরিকানরা মহিলাদের ১০০ মিটারের সোনার পদকটা তখন থেকেই দেখতে শুরু করেন স্টেলার গলায়। স্টেলাও শুরু করে দেন অলিম্পিকের প্রস্তুতি। লক্ষ্য ১০০ মিটারের সোনা। কিন্তু অলিম্পিকের ঠিক কাছাকাছি এসেই দেখা দেয় ঘোর সমস্যা। স্টেলার বাবার চাকরি চলে যায়। স্টেলা তখন চাকরি করতেন নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল রেলরোডে। প্রায় একই সময়ে স্টেলার সেই চাকরিও চলে যায়। ওঁদের পরিবার তখন গভীর আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি। যা অবস্থা, তাতে স্টেলার বিকল্প কোনও চাকরির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তা না হলে সংসার চলবে না। ওখানকার ক্রীড়াকর্তারা ক্লিভল্যান্ড রিক্রিয়েশন বিভাগে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তাতে দেখা দেয় অন্য সমস্যা। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী খেলাধুলো বা রিক্রিয়েশন সংক্রান্ত কোনও দপ্তরে চাকরি করলে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া যাবে না। ঠিক তখনই পোলিশ দূতাবাস থেকে স্টেলাকে চাকরির অফার দেওয়া হয়। ওই চাকরিতে যোগ দিয়ে স্টেলা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন নিজের জন্মভূমি পোলান্ডের হয়ে।
১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে ১০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ডের সমান সময় (১১.‌৯ সেকেন্ড)‌‌ করে সোনা জিতেছিলেন। রুপো জিতেছিলেন কানাডার হাইল্ড স্ট্রাইক। তাঁরও সময় ছিল ১১.‌৯ সেকেন্ড। স্টেলা সোনা জেতার পর সরকারিভাবে কেউ কোনও অভিযোগ করেননি। কিন্তু কানাডার কিছু কর্মকর্তা সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন।‌ নিজেরা বলাবলি করেছিলেন, আদৌ স্টেলা কি মহিলা?
লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে স্টেলা আরও একটা ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন। সেটা হল ডিসকাস থ্রো। তাতে ৯ প্রতিযোগীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থান পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১০০ মিটারের ফাইনাল ও ডিসকাস থ্রো একইদিনে হয়েছিল।
১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকেও ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন স্টেলা। জিতেছিলেন রুপো (‌১১.‌৭ সেকেন্ড)‌। ওখানে স্টেলার বিরুদ্ধে নয়, অভিযোগ উঠেছিল সোনাজয়ী আমেরিকার হেলেন স্টিফেন্সের (‌১১.‌৫ সেকেন্ড)‌ বিরুদ্ধে। অভিযোগ তুলেছিলেন স্টেলার দেশ পোলান্ডের এক সাংবাদিক। সেই অভিযোগ অবশ্য টেকেনি। সংগঠক জার্মানির কর্মকর্তারা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেক্স টেস্ট হয়েছে। তাতে প্রমাণিত হেলেন মহিলাই। বিতর্ক ওখানেই থেমে গিয়েছিল।
যাই হোক বার্লিন থেকে আমেরিকায় ফিরে আসেন স্টেলা। ভেবেছিলেন পরের অলিম্পিকেও অংশ নেবেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তো পরপর দুটো অলিম্পিক হতেই পারেনি। অলিম্পিকে আর অংশ নেওয়া না হলেও স্টেলা থেকে গিয়েছিলেন খেলার জগতেই। অলিম্পিকের একটি করে সোনা ও রুপো ছাড়াও ছাড়াও স্টেলার গলায় উঠেছিল মহিলাদের বিশ্ব গেমসের ৪ টি সোনা ও ২ টি রুপোর পদক। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছিলেন ২ টি সোনা। খেলাধুলো থেকে অবসর নেওয়ার পর আমেরিকায় থাকা পোলিশদের নানা সংস্থার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তাদের খেলাধুলোর দিকটা বলতে গেলে একাই সামলাতেন। নানা রকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। নানা ভাবে উঠতি পোলিশ খেলোয়াড়দের সাহায্য করতেন। ছোটদের কোচিং করাতেন। ঠিক করে ফেলেছিলেন আর পোলান্ডে ফিরবেন না। আমেরিকায় থেকেই পোলান্ডের খেলোয়াড়দের সাহায্য করবেন। একসময় বারবার আবেদন করেও আমেরিকার নাগরিকত্ব পাচ্ছিলেন না। গড়িমসির কারণ অবশ্যই ১৯৩২ সালের অলিম্পিকে শেষ সময়ে আমেরিকা দল থেকে সরে দাঁড়ানো। অবশেষে ১৯৪৭ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। বিয়ে করেন আমেরিকার নামী বক্সার নীল ওলসনকে। সেই সম্পর্ক অবশ্য ৮ সপ্তাহের বেশি টেকেনি। সরকারিভাবে কখনও বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও, ওঁরা আর একসঙ্গে থাকেননি। স্টেলা থাকতেন ক্লিভল্যান্ডের ছোট বাড়িতে মা ভেরোনিকার সঙ্গে।
আর ঘরসংসার করা না হলেও খেলাধুলো নিয়ে দিব্যি জীবন কেটে যাচ্ছিল স্টেলার। তাঁর আবেগ ও ভালোবাসা ছিল খেলাধুলো এবং পোলান্ড ঘিরেই। আর পোলান্ডের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে বলতেন, ‘‌The Polish Flyer.’‌ কিন্তু শেষ পরিণতি?‌ 
১৯৮০ সালের ৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। পোলান্ডের জাতীয় মহিলা বাস্কেটবল দল তখন আমেরিকায়। পরের সপ্তাহে তাদের সঙ্গে কেন্ট স্টেটের প্রীতি ম্যাচ। সেখানে পোলিশ দলের সংবর্ধনা। যার অনেকটা দায়িত্বই ছিল স্টেলার। এছাড়া ওই খেলার দিন স্টেলাকে নাগরিক সংবর্ধনা জানানোর ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন শহরের মেয়র George Voinovich. ‌‌ঠিক ছিল ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্টেলার হাতে মেয়র তুলে দেবেন শহরের সাম্মানিক চাবি। ৪ ডিসেম্বর ডিনারের পর বেশ রাতেই ৮৪ বছর বয়সী মা-‌কে বাড়িতে রেখে পোলিশ খেলোয়াড়দের জন্য উত্তরীয় ও স্মারক কিনতে গিয়েছিলেন এক শপিং কমপ্লেক্সে। পার্কিং লটে তাঁর গাড়ি রাখা ছিল। কেনাকাটার শেষে পার্কিং লটে গাড়ি নিতে এসেই চোর ও ছিনতাইবাজদের মুখোমুখি পড়ে যান স্টেলা। একজন স্টেলার দিকে এগিয়ে আসতেই ধস্তাধস্তি শুরু। অন্য একজনের হাতে ছিল বন্দুক। সেটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে যান স্টেলা। এমন সময়ই গুলি এসে লাগে পেটের নিচের অংশে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অপারেশন টেবিলে মারা যান স্টেলা। মৃত্যুর পর ময়না তদন্ত হয়। তাতে জানা যায়, ‘‌Woman with intersex variation’‌!‌

জন্ম:‌ ৩ এপ্রিল ১৯১১
মৃত্যু:‌ ৪ ডিসেম্বর ১৯৮০

Tuesday, June 2, 2020

‘‌বাংলার ক্রিকেটের জনক’ সারদারঞ্জন‌ রায়



বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার ডব্লু জি গ্রেসের সঙ্গে তাঁর চেহারায় অনেক সাদৃশ্য ছিল। দু’‌জনেই ছিলেন শ্মশ্রুধারী। তাই ‘‌বাংলার ক্রিকেটের জনক’‌-‌কে ‘‌বাংলার ডব্লু জি গ্রেস’-‌ও বলা হয়। 




‘‌বাংলার ক্রিকেটের জনক’
সারদারঞ্জন‌ রায় 


নির্মলকুমার সাহা


তাঁর পরিচয়ের শেষ নেই। বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ। বেশ কিছু অঙ্কের বইয়ের লেখক। একদা বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এরকম আরও অনেক পরিচয়। কিন্তু এসবের বাইরের অন্য একটি পরিচয়েই তিনি বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ‘‌বাংলার ক্রিকেটের জনক’‌। বাঙালিকে তিনিই প্রথম ক্রিকেট খেলার গুরুত্ব বোঝাতে পেরেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটে বাঙালির পথচলা শুরু। একাধারে ছিলেন ক্রিকেটার, কোচ, ক্রিকেট সংগঠক, ক্রিকেটের প্রচারক। তিনি অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়।
ময়মনসিংহের মসুয়ার কালীনাথ রায়ের পাঁচ ছেলে। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন। পাঁচ ভাইয়ের চারজন সারদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন পিতৃদত্ত নামেই পরিচিত। কিন্তু কামদারঞ্জন বিখ্যাত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে। কালীনাথ রায়ের এক আত্মীয় কামদারঞ্জনকে পাঁচ বছর বয়সে দত্তক নেওয়ার পর নাম রেখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। আর রায়ের পর ‘‌চৌধুরী’‌ হল সম্মানসূচক উপাধি।
মসুয়া গ্রামের ওই রায় পরিবারে শুধু সাহিত্যচর্চা নয়, ক্রীড়াচর্চাও গুরুত্ব পেত। বিশেষ করে ক্রিকেট। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্যই সারদারঞ্জনের। তিনিই ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, অভিভাবক। তাঁর হাত ধরেই ওই পরিবারে ঢুকেছিল খেলাধুলো। পরিবারের সবাইকেই তিনি খেলাধুলোয় আগ্রহী করে তুলতে পেরেছিলেন। আর কমবেশি সব ভাইকেই টেনে আনতে পেরেছিলেন ক্রিকেট মাঠে। সারদারঞ্জনের মতোই শেষের তিনজন মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন টাউন ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। একসময় টাউন ক্লাবের হয়ে ৪ ভাই একসঙ্গেও খেলেছেন। উপেন্দ্রকিশোর ছোটদের জন্য লেখালেখি নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ছোটদের বিখ্যাত পত্রিকা ‘‌সন্দেশ’‌ প্রথম প্রকাশিত হয়। তবে তিনিও ক্রিকেটে আগ্রহী ছিলেন। সময় পেলেই ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতেন। ১৮৯৯ সালে পাতিয়ালার মহারাজার ক্রিকেট দল যখন কলকাতায় খেলতে এসেছিল, ইডেনে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে দর্শক আসনে ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। পাতিয়ালার ওই দলে ছিলেন রনজি। শুধু তাই নয়, রনজির ওই কলকাতা সফরের সময় তাঁকে নিয়ে তখনকার ‘‌প্রদীপ’‌ পত্রিকায় একটি লেখাও লিখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। যে লেখার শিরোনাম ছিল ‘‌রণজিৎ সিংহজী’‌।
সারদারঞ্জনের জন্ম ১৮৫৮ সালের ২৪ মে। ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার মসুয়া গ্রামে। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুল থেকে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই ক্রিকেট খেলাটা নিয়মিত হয়ে যায়। শুরু হয় নিয়মিত ব্যায়ামচর্চাও। সারদারঞ্জন মনে করতেন, খেলাধুলো করতে হলে সবার আগে শরীর গড়তে হবে। ব্যায়ামচর্চার জন্য তিনি দলবল নিয়ে যেতেন ঢাকার তখনকার বিখ্যাত পালোয়ান অধীর ঘোষের আখড়ায়। ওটা অবশ্য অধীর গোয়ালার আখড়া নামেই বেশি পরিচিত ছিল। একা নন, তিনি শরীরচর্চা ও ক্রিকেট খেলায় সঙ্গী করে ফেলেছিলেন নিজের ভাইদের পাশাপাশি কলেজের অন্য ছাত্রদেরও। ঢাকায় আগে থেকেই ক্রিকেট খেলার চল ছিল। তা অবশ্যই বেশিমাত্রায় ইংরেজদের মধ্যেই। সারদারঞ্জন ঢাকায় যাওয়ার পর তাঁর উদ্যোগেই বাঙালি ছেলেদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার আগ্রহ দেখা দেয়। গড়ে ফেলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। অধ্যাপক হিসেবে পরে যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন, তখনও ছাত্রদের মধ্যে ক্রিকেট খেলা ছড়িয়ে দিতে ক্লান্তিহীন ছিলেন। ছাত্র ও অধ্যাপকদের নিয়ে ক্রিকেট দল গড়ে নানা জায়গায় খেলতে যাওয়াটা ছিল তাঁর নেশা।
ঢাকা কলেজের তখন অধ্যক্ষ মিস্টার বুথ, গণিতের অধ্যাপক সারদারঞ্জন। একসময় কলেজে ক্রিকেটের কর্মকাণ্ড চালাতে মিস্টার বুথের সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছেন সারদারঞ্জন। কিন্তু পরে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করেই তাঁর সঙ্গে সারদারঞ্জনের মতান্তর। ঢাকা কলেজের ক্রিকেট দল কলকাতায় এসেছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে। ছাত্রদের সঙ্গে সারদারঞ্জন ও আরও কয়েকজন অধ্যাপক ওই ম্যাচে অংশ নেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ হেরে যায়। হারের পর শুধু ছাত্রদের নিয়ে দল গড়ে আর একটা ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দেয় প্রেসিডেন্সি। অধ্যক্ষ বুথ ওই ম্যাচে একমাত্র অধ্যাপক সারদারঞ্জনকে খেলার অনুরোধ করেন। ওই অনুরোধ তিনি মেনে নিতে পারেননি। যা থেকে বিরোধ তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত চাকরিই ছেড়ে দেন সারদারঞ্জন। পরে বিদ্যাসাগরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৮৮৮ সালে যোগ দেন মেট্রোপলিটন কলেজে। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর (‌২৯ জুলাই, ১৮৯১)‌ পর কলেজ চালানোর দায়দায়িত্ব অনেকটাই নিতে হয় সারদারঞ্জনকে। সামলাতে হয় কলেজের আর্থিক সমস্যাও।
মিস্টার বুথের সঙ্গে বিরোধ ও তাঁর বড় জ্যাঠামশাই সারদারঞ্জন সম্পর্কে ‘‌আর কোনোখানে’ বই‌‌য়ে বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদার লিখেছেন, ‘‘‌ওরকম তেজী মানুষ আজকাল কম দেখা যায়। এখন বোঝাপড়ার যুগ এসেছে, কিন্তু আমার বড় জ্যাঠামশাই বলতেন, ‘‌Compromise ‌আবার কি?‌ অন্যায়ের সঙ্গে কখনো Compromise হয় না, অন্যায় সর্বদা অন্যায়।’‌ কাজের বেলাও তাই। প্রথম সরকারী কলেজে চাকরিতে ঢুকেছেন, একাধারে পণ্ডিত ও খেলোয়াড়, ভবিষ্যতে অনেক উন্নতির সম্ভাবনা, তখনি গোল বাধল। ইংরেজ প্রিন্সিপাল আদেশ করলেন, একটা বিশেষ ম্যাচে কলেজের ক্রিকেট টীমে নামতে হবে। বড় জ্যাঠামশাই তো অবাক—‘‌ও তো ছাত্রদের টীম, অন্য কলেজের ছাত্রদের খেলা হবে, তাতে আমি কি করে খেলি?‌’‌ সাহেব বলল, ‘‌কেউ টের পাবে না আমরা জিতে যাব। আমি আদেশ করছি।’‌ শুনে বড় জ্যাঠামশাইয়ের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। বললেন, ‘‌এমন অন্যায় আদেশ আমি মানি না।’‌ ব্যস, অমন ভালো চাকরি তখনি ছেড়ে দিলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর কখনো ইংরেজ সরকারের চাকরি করবেন না। করেনও নি। এমন মানুষকে যে বিদ্যাসাগরমশাই খুঁজে-‌পেতে তাঁর কলেজে ঢোকাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি?‌’‌’‌
পরে মেট্রোপলিটন কলেজের নাম বদলে হয় বিদ্যাসাগর কলেজ। ১৯০৯ সালে বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ হন সারদারঞ্জন। ওই পদে ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
অন্যায়ের প্রতিবাদে আগে আরও একবার চাকরি ছেড়েছিলেন। সারদারঞ্জন ছিলেন ডবল এম এ, অঙ্কে ও সংস্কৃতে। তাঁর প্রথম চাকরি আলিগড় এম এ ও কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে। সেই চাকরি কেন ছেড়েছিলেন তা তুলে ধরা যাক বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় বসুর একটি লেখা থেকে, ‘‌একদিন সংস্কৃতের অধ্যাপক অনুপস্থিত হওয়ায় অধ্যক্ষ তাঁকে সংস্কৃত ক্লাসে গিয়ে ছেলেদের অঙ্ক দিয়ে চুপ করিয়ে রাখতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধে সম্মত হয়ে সারদারঞ্জন ক্লাস নিলেন, তবে ছেলেদের তিনি আঁক কষালেন না, বিকল্পে পড়ালেন সংস্কৃতই। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থায় হিতে বিপরীত ঘটলো। ছেলেরা ক্লাসের পর বায়না ধরলো যে তাঁর কাছেই সংস্কৃত শিক্ষা করবে বলে। খবরটা অধ্যক্ষের কানে উঠতে তিনিও এক ঢিলে দুই পাখী মারার সঙ্কল্পে উৎফুল্ল হয়ে সারদারঞ্জনকে ভবিষ্যতে গণিত ও সংস্কৃত, দুটি অধ্যাপকের পদ যুগ্মভাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব জানালেন। নতুন প্রস্তাব গ্রহণে সারদারঞ্জনের আপত্তি ছিল না, যদি তাঁকে বর্ধিত হারে বেতন দেওয়া হয়। এই নিয়ে সারদাঞ্জনের সঙ্গে অধ্যক্ষ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘটলো মতানৈক্য, ফলে আলিগড়ের চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ডিরেক্টর ক্রফট সাহেবের অনুরোধে চলে আসেন বহরমপুর কলেজে।’‌
বহরমপুরে অবশ্য বেশিদিন থাকতে হয়নি সারদারঞ্জনকে। বহরমপুর ও ঢাকা, দুটিই সরকারি কলেজ। বহরমপুর থেকে বদলি হয়ে তাঁকে আসতে হয় ঢাকা কলেজে। একদা যে কলেজের ছাত্র ছিলেন, এবার সেখানে অধ্যাপক।
যখন যে কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন সেখানেই খেলাধুলোর, বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রসারে উদ্যোগী হয়েছেন নিজের ইচ্ছায়। আলিগড়ে গিয়েও ওখানকার ছাত্রদের মধ্যে ক্রিকেটে খেলা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারদারঞ্জন। আলিগড়ে ক্রিকেট খেলার চল সারদারঞ্জনের সময় থেকেই। অধ্যাপনার পাট চুকিয়ে চলে আসার পরও ক্রিকেট দল নিয়ে আলিগড়ে গিয়েছেন ম্যাচ খেলতে। আসলে আলিগড়ের ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তরিকভাবে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন যে নিজেকে আর বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। মেট্রোপলিটন বা বিদ্যাসাগর কলেজের ক্রিকেট দল ওঁর আমলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি ওই কলেজে গুরুত্ব পেয়েছে ফুটবলও। ওই সময় অনেকে ক্লাব পর্যায়ে একসঙ্গে একাধিক খেলায় অংশ নিতেন। কলেজ দলের হয়েও অনেকেই ফুটবল, ক্রিকেট সমান দক্ষতায় খেলেছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন না ‘‌চীনের প্রাচীর’‌গোষ্ঠ পালও। ফুটবলার হিসেবে বিখ্যাত হলেও ক্লাব পর্যায়ে গোষ্ঠ পাল চুটিয়ে খেলেছেন ক্রিকেট, হকিও। বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ক্রিকেটে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল সারদারঞ্জনের কাছে। হেমাঙ্গ বসু, জিতেন ব্যানার্জি, শৈলেশ বসু, তুলসী দত্ত, হাবুল মিত্রর মতো আরও অনেকেরও তাই। বিদ্যাসাগর কলেজের দল নিয়েও তিনি ভারতের নানা প্রান্তে গিয়েছেন, প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য। বিদ্যাসাগর কলেজের শতবর্ষের স্মারক গ্রন্থে ‘‌স্মৃতিকথা’-‌য় গোষ্ঠ পাল লিখেছেন, ‘‌মোহনবাগানের নামী ব্যাক আমি। কিন্তু হঠাৎ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। সারদারঞ্জন আমাকেও ঐ খেলার কৌশল হাতে ধরে শিখিয়েছেন। তারপরে কলেজ ও মোহনবাগানের হয়ে বহু সেঞ্চুরী করেছি। .‌.‌.‌.‌.‌.‌ ১৯১৯ সালে সারদারঞ্জন কলেজের দল নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সফরে গিয়েছিলেন। এ-‌দলে তুলসী দত্ত, হাবুল মিত্র, সুশান্ত ঘোষ, রবি মিত্র, হেমাঙ্গ বসু এবং আমি ছিলাম।.‌.‌.‌.‌.‌সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা, কলেজে ক্রিকেট খেলে স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম। এলাহাবাদে কলেজের পক্ষে ক্রিকেট খেলে সেঞ্চুরী করেছিলাম।’‌ ‌
সারদারঞ্জনের উদ্যোগে বাঙালি ক্লাবগুলোর মধ্যে টাউন-‌ই প্রথম ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নেয়। শুধু টাউন ক্লাবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা নয়, ১৯২০ সালে যখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়, সারদারঞ্জন ছিলেন প্রথম সভাপতি। স্পোর্টিং ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পেছনেও অবদান রয়েছে সারদারঞ্জনের। ওখানেও বাঙালি ছেলেদের প্রাধান্য দিয়ে ক্রিকেট দল গড়ায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। একদা নাটোর দল গড়ার ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। ১৯১৩-‌১৪ সালে তাঁর চেষ্টাতেই প্রথম ইংলিশ বনাম বেঙ্গলি স্কুল ক্রিকেট ম্যাচ হয়। কীভাবে ক্রিকেট খেলতে হয় এবং তার নিয়মকানুন নিয়ে ১৮৯৮ সালে তখনকার ‘‌মুকুল’‌ পত্রিকায় ছোটদের জন্য সারদারঞ্জন একটি লেখাও লিখেছিলেন। যার শিরোনাম ছিল ‘‌ক্রিকেট খেলা’‌।
শুধু নিজের ভাইদের নয়, সারদারঞ্জন তাঁর অন্য অনেক আত্মীয়কেও টেনে আনতে পেরেছিলেন ক্রিকেট মাঠে। যেমন সারদারঞ্জনের প্রভাবেই তাঁর দুই ভাগ্নে কার্তিক-‌গণেশ (‌বসু)‌ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ক্রিকেটে। সেই প্রভাবেই রায় ও বসু পরিবারের পরের প্রজন্মের আরও অনেকেও ক্রিকেটে ঝোঁকেন। সেই তালিকা দীর্ঘ। তাঁরাও প্রায় সবাই সারদারঞ্জনের মতোই জড়িয়ে পড়েছিলেন টাউন বা স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে।
ক্রিকেটে তিনি এতটাই আসক্ত ছিলেন যে শেষ বয়সেও শুধু দল গড়া বা খেলা শেখানোর মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি। বয়সের তোয়াক্কা না করে ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ খেলতে নেমে পড়তেন। সারদারঞ্জনের মৃত্যু ৬৭ বছর বয়সে (‌১ নভেম্বর, ১৯২৫)‌ দেওঘরে। তার আগের বছরও (‌৬৬ বছর বয়সে)‌ তিনি বিদ্যাসাগর কলেজের হয়ে ই বি আর ম্যানসনের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। প্রশংসনীয় ছিল তাঁর ওই উদ্যম।
শুধু ক্রিকেট শেখানো নয়, সবাই যাতে ক্রিকেট খেলার উন্নত সরঞ্জাম পান তার ব্যবস্থাও করেছিলেন সারদারঞ্জন। ১৮৯৯ সালে খুলেছিলেন ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকান, এস রায় অ্যান্ড কোং। সেখানে ছাত্ররা কম পয়সায় ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনতে পারতেন। শোনা যায়, প্রত্যেক ম্যাচের সেরা ব্যাটসম্যানকে তিনি নিজের দোকান থেকে দামী ব্যাট উপহার দিতেন। ওঁর দোকানে পাশাপাশি বিক্রি হত ফুটবলও। ওই দোকানে আর পাওয়া যেত মাছ ধরার বড়শি, ছিপ ও অন্যান্য সামগ্রী। এই ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকান খোলার অন্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল। বিদ্যাসাগর কলেজ তখন আর্থিক সমস্যায় ধুঁকছে। কলেজকে আর্থিক সহায়তা দেওয়াটা নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছিলেন সারদারঞ্জন। কলেজকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য আগেই, ১৮৯৪ সালে তিনি অবশ্য একটি প্রকাশনা সংস্থাও চালু করেছিলেন।
ওই ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকানে মাছ ধরার সামগ্রী রাখার কারণটাও গুরুত্বপূর্ণ। সারদারঞ্জন পারদর্শী ছিলেন মাছ ধরায়ও। ওটাও ছিল তাঁর আরেকটি প্যাশন। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মাছ ধরতে যেতেন।
ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিংয়েই সারদারঞ্জনের দক্ষতা ছিল বেশি। মিডিয়াম পেস বল করতেন। বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার ডব্লু জি গ্রেসের সঙ্গে তাঁর চেহারায় অনেক সাদৃশ্য ছিল। দু’‌জনেই ছিলেন শ্মশ্রুধারী। তাই ‘‌বাংলার ক্রিকেটের জনক’‌-‌কে ‘‌বাংলার ডব্লু জি গ্রেস’-‌ও বলা হয়।


জন্ম:‌ ২৪ মে, ‌১৮৫৮।
মৃত্যু:‌ ১ নভেম্বর, ১৯২৫। 

Monday, June 1, 2020

‘‌মিস্টার ক্লিন’‌ ঘুমোতেন ১১ ঘণ্টা!‌

ববি মরো যখন অ্যাথলেটিক্স করতেন, নিয়ম করে রাতে ঘুমোতেন ১১ ঘণ্টা। প্রশিক্ষণ নেওয়া বা অনুশীলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। বলতেন, ‘‌ঘুমটাই আমার আসল শক্তি। রাতের এই টানা ঘুমই আমার সফল্যের চাবিকাঠি।’‌



‘‌মিস্টার ক্লিন’‌
ঘুমোতেন
১১ ঘণ্টা!‌



নির্মলকুমার সাহা



(‌১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে ট্রিপল সোনা জিতেছিলেন আমেরিকান স্প্রিন্টার ববি মরো। ৩০ মে, শনিবার বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় জীবনাবসান হল তাঁর, সান বেনিতোতে নিজের বাড়িতেই। তুলো এবং গাজর চাষের প্রতি তাঁর ছিল গভীর ভালবাসা। সান বেনিতোতেই ছিল ওঁদের পারিবারিক তুলো ও গাজর চাষের ক্ষেত। ৪ বছর আগে আজকালে প্রকাশিত ববি মরোকে নিয়ে একটি লেখা। তাঁর জীবনাবসানের পরও মনে হল লেখাটি অপ্রাসঙ্গিক নয়।)‌



১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে ১০০ মিটার দৌড়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। হিটের দ্বিতীয় রাউন্ডেই ২ আমেরিকান অলিম্পিক রেকর্ডের সমান সময় (‌১০.‌৫ সেকেন্ড)‌ করেছিলেন। একজন ববি মরো। আরেকজন ইরা মার্চিসন। দুটি সেমিফাইনালেও ওঁরা ২ জনই প্রথম হয়েছিলেন। মরো আবার অলিম্পিক রেকর্ডের সমান সময় করেন, ১০.‌৫ সেকেন্ড। মার্চিসনের সময় ছিল ১০.‌৭৯ সেকেন্ড। ফাইনালে মার্চিসন অবশ্য আর পেরে ওঠেননি। আবার অলিম্পিক রেকর্ডের সমান সময় করে (‌১০.‌৫ সেকেন্ড)‌ সোনা জিতেছিলেন ববি মরো। ওই একই সময়ে শেষ করে রুপো জিতেছিলেন আমেরিকারই ডব্লু থানে বেকার। ১০.‌৬ সেকেন্ডে শেষ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার হেক্টর হোগান এবং মার্চিসন। হোগান জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ পদক। মার্চিসন পেয়েছিলেন চতুর্থ স্থান। 
সেবার মেলবোর্ন অলিম্পিকে আরও দুটি সোনা জিতেছিলেন ববি মরো। ১০০ মিটারের পাশাপাশি তাঁর গলায় উঠেছিল ২০০ মিটার ও ৪x‌‌১০০ মিটার রিলের সোনা। ২০০ মিটারে সোনা জেতার পথে ফাইনালে ছুঁয়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড (‌২০.‌৬ সেকেন্ড)‌। ৪x‌‌১০০ মিটার রিলেতে আমেরিকা দল গড়েছিল ৩৯.‌৫ সেকেন্ডের নতুন বিশ্বরেকর্ড। মরো ছিলেন ওই রিলে দলের শেষ রানার। 
অলিম্পিকে ওই দুর্দান্ত সাফল্যের পর সে বছর পেয়েছিলেন স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের ‘‌স্পোর্টসম্যান অফ দ্য ইয়ার’‌ পুরস্কার। ববি মরো যখন অ্যাথলেটিক্স করতেন, নিয়ম করে রাতে ঘুমোতেন ১১ ঘণ্টা। প্রশিক্ষণ নেওয়া বা অনুশীলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। বলতেন, ‘‌ঘুমটাই আমার আসল শক্তি। রাতের এই টানা ঘুমই আমার সফল্যের চাবিকাঠি।’‌ সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। কখনও কোনও বিতর্কের ধারেকাছেও থাকতেন না। অ্যাথলেটিক্স জীবনে যখন সাফল্যের শীর্ষে, আমেরিকায় ওঁকে ‘‌মিস্টার ক্লিন’‌ বলা হত।
জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ অক্টোবর টেক্সাসের হার্লিংজেনে। পরিবারের ছিল সান বেনিতোতে তুলো ও গাজর চাষের ক্ষেত। ওটাই ওঁদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক ব্যবসা। সেখানেই কেটেছে শৈশব। খেলাধুলোর জন্য মাঝের অল্প কিছু সময় বাদ দিলে আবার ওখানে এসেই স্থায়ী হয়েছেন ববি মরো।  
সান বেনিতো হাই স্কুলে যখন ভর্তি হন, পরিকল্পনা ছিল হাই স্কুলের পর্ব চুকে গেলেই বান্ধবী জো আনকে বিয়ে করে সংসার আর পারিবারিক চাষের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু স্কুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন খেলাধুলোর সঙ্গে। স্প্রিন্টার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার আগে সান বেনিতো হাই স্কুল দলের হয়ে আমেরিকান ফুটবল খেলতেন। ওঁকে আমেরিকান ফুটবল খেলতে দেখেই একদিন সান বেনিতো হাই স্কুলের অ্যাথলেটিক্স কোচ জেক ওয়াটসন অন্যরকম পরামর্শ দেন। বলেন, আমেরিকান ফুটবল ছেড়ে স্প্রিন্টে মন দিতে। তিনি কোচিং করাবেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে ওয়াটসনের কথায় স্প্রিন্টে মন দেন ববি মরো। পরে যখন আবিলেন ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন, ততোদিনে আমেরিকান ফুটবল ছেড়ে পাকাপাকি চলে এসেছেন অ্যাথলেটিক্সে। তখন অ্যাথলেটিক্সে ববি মরোর ক্লাব ছিল ফ্রাটার সোদালিস। 
সান বেনিতো হাই স্কুল থেকেই উত্থান ববি মরোর। সেটা মনে রেখে ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ ওঁর অলিম্পিক সোনা জয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৬ সালে এক বিশাল অনুষ্ঠান করে। ববি মরোর নামে ১১ হাজার আসনের একটি নতুন স্টেডিয়াম গড়া হয়। যার উদ্বোধন হয় ববি মরোর হাতেই। 
১৯৫৮ সালে অ্যাথলেটিক্স থেকে অবসর নিয়ে পারিবারিক চাষের কাজেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। যখন অ্যাথলেটিক্স করতেন, তখনও সময় পেলেই চলে যেতেন নিজেদের সেই চাষের ক্ষেতে। চাষের প্রতি ওঁর এতটাই ভালবাসা ছিল যে নিজেও হাত লাগাতেন। মেলবোর্ন অলিম্পিকের কয়েক মাস পরের একটা ছবিতে দেখা গিয়েছে, সোনাজয়ী নায়ক গাজর ক্ষেতে নিজে ট্র‌্যাকটর চালাচ্ছেন। ১৯৬০ সালে অবসর ভেঙে অল্প সময়ের জন্য ট্র‌্যাকে ফিরেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন ১৯৬০ সালেও আমেরিকার অলিম্পিক দলে ঢোকার। সেটা আর পারেননি। ফলে দ্বিতীয়বার অবসর নিয়ে পুরোপুরি ঢুবে গিয়েছিলেন পারিবারিক ব্যবসায়। অলিম্পিকে সোনাজয়ী হিসেবে সেলিব্রিটি তকমা লেগে যাওয়ায় অন্য কিছু কাজের সঙ্গে জড়াতে হলেও, নিজের ভালবাসার তুলো ও গাজর চাষের কাজের ক্ষতি কখনও করেননি। 

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...