নির্মলকুমার সাহা
৩৬ বছর আগে, ১৯৮৪ সালে একবারই কাছ থেকে দেখেছিলাম তাঁকে। ইন্দোর শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে মউয়ের বাড়িতে। আর্থিক অসচ্ছলতা, তবু ছোট বাড়িটিকে যতটা সম্ভব সাজিয়ে রাখার চেষ্টা। ৮ ফুট বাই ৮ ফুট, একটি ঘরে বসতে দিয়েছিলেন। ফ্যান ছিল না। অত্যধিক গরমে ঘামছিলাম। ভেতর থেকে নিজেই একটি হাতপাখা এনে দিয়ে বলেছিলেন, ‘খরচ বেড়ে যাবে, তাই ঘরে ফ্যান লাগাতে পারিনি!’
ছোট ঘরটির তিন দেওয়াল ঘেঁষা শো-কেসে অজস্র ট্রফি, পদক। দেখাচ্ছিলেন কোনটা কবে কোথায় পেয়েছেন। বোঝা যাচ্ছিল, শান্ত, অন্তর্মুখী লোকটাও খেলার মাঠ থেকে পাওয়া ওই পুরস্কারগুলো দেখাতে দেখাতে বেশ গর্ব অনুভব করছিলেন।
১৯৫৬, ১৯৬০ ও ১৯৬৪। তিনটি অলিম্পিকে খেলেছেন। এর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টিতে সোনা জিতেছেন। মাঝেরটিতে রুপো। এশিয়ান গেমসে ভারত প্রথম হকির সোনা জিতেছিল ১৯৬৬ সালে, ব্যাঙ্ককে। সোনাজয়ী সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন শঙ্কর লক্ষ্মণ। তিনিই প্রথম ভারতীয় দলের গোলকিপার-অধিনায়ক। অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন, হয়েছেন পদ্মশ্রী। এত সাফল্যের পর, এটাও সত্যি, সংসার চালাতে একসময় মউতে তাঁকে খুলতে হয়েছিল পান, বিড়ি, সিগারেটের দোকান! ট্রফি, পদক, স্মারক, শংসাপত্র তাঁর ছোট ঘরের শোভা বাড়িয়েছে, কিন্তু পেট ভরানোর নির্ভরতা দিতে পারেনি।
আর্থিক অনটনের পাশাপাশি, একসময় সঙ্গী হয় নানারকম অসুখ। রীতিমতো কষ্টে ছিলেন। সব কিছুর অবসান ১৪ বছর আগে ২০০৬ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে। সেদিন জীবনাবসান হয় হকির চিরকালের অন্যতম সেরা গোলকিপার শঙ্কর লক্ষ্মণের। ভারতীয় হকির মূল স্রোত থেকে অনেকটা দূরেই ছিলেন। চিরবিদায়ও নীরবেই।
১৯৮৪ সালে দেখা হওয়ার পর ২২ বছরে তিন-চারবার ফোনে কথা হয়েছে। শেষ কথা বলেছিলাম ১৯৯৮ সালে ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে হকিতে ভারত সোনা জেতার পর। তখনই শুনেছিলাম, তিনি বেশ অসুস্থ। ক্রমশঃ সেই অসুস্থতা বেড়েই চলে। মারা যাওয়ার এক মাস ৬ দিন আগে (২৩ মার্চ) ইন্দোরের এক হাসপাতালে দু-পায়েই অস্ত্রোপচার হয়। ডায়াবেটিস থেকেই পায়ে পচন ধরে। সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না হওয়াতেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। অস্ত্রোপচারের কয়েকদিন পর ফোনে শঙ্কর লক্ষ্মণের ছেলে মনোহর জানান, পায়ের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় অস্ত্রোপচারের পরই। এতটাই খারাপ হয় যে ডাক্তাররা পা কেটে বাদ দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন।
রমেশ পারমার একসময় ক্রিকেট খেলতেন। মধ্যপ্রদেশের হয়েও খেলেছেন। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ইন্দোরের হাসপাতালে ভারতের প্রাক্তন গোলকিপারকে দেখতে গিয়ে তিনি পরামর্শ দেন, হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানোর। শঙ্কর লক্ষ্মণের স্ত্রী শান্তাকে তিনি বলেন, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় শঙ্কর লক্ষ্মণকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি!
হকি খেলে বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি কুড়োলেও শঙ্কর লক্ষ্মণের শুরুটা ছিল ফুটবল দিয়ে। একসময় সার্ভিসেসের হয়ে নিয়মিত ফুটবল খেলেছেন। ছিলেন স্টপার। দু’পায়েই প্রচণ্ড জোরে শট নিতে পারতেন। ওই শট দেখে, ১৯৫৩ সালে মেজর সনভান সিং পরামর্শ দেন হকিতে গোলে খেলতে। ওই পরামর্শ মনে ধরে যায় শঙ্কর লক্ষ্মণের। হকি খেলা শুরু করে দেন। তখন বয়স ২০ বছর। শুরুটা দেরিতে হলেও হকিতে সাফল্য এসেছে খুব দ্রুত। ঝড়ের গতিতে। হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সেই সময়ের সেরা গোলকিপার। চাকরি করতেন মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রিতে। ওই বছরই ১৯৫৩ সালে তাদের হয়ে হকি খেলেন। পরের বছর ঢুকে পড়েন সার্ভিসেস দলে। ১৯৫৫ সালে ভারতের হয়ে যান পোল্যান্ড সফরে। জাতীয় দলে সেই প্রথম ঢোকা। খেলেছেন টানা ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৬ সালে অলিম্পিকে প্রথম খেলেন। ভারত সোনা জিতেছিল। পুরো প্রতিযোগিতায় লক্ষ্মণ খেয়েছিলেন মাত্র একটি গোল। ১৯৬০ সালের অলিম্পিকেও খান মাত্র একটি গোল। কিন্তু ওই একটি গোলই ভারতের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল অলিম্পিক হকির সোনা। নাসের বুন্দার সেই গোলেই সোনা জিতেছিল পাকিস্তান। পুরোনো দিনের খেলোয়াড়দের কাছ শুনেছি, ফাইনালের শেষে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলেন শঙ্কর লক্ষ্মণই। পরের চার বছর ভালোভাবে হাসতে পারেননি। হেসেছিলেন ১৯৬৪-তে অলিম্পিকের সোনা পুনরুদ্ধার করে। টোকিওর সেই ফাইনালের পর পাকিস্তানের ম্যানেজার এ আই এস দারা বলেছিলেন, ‘ভারত নয়, আমাদের ফাইনালটা খেলতে হল শঙ্কর লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে। ভারত নয়, আমরা হারলাম শঙ্কর লক্ষ্মণের কাছে।’
তিনটি অলিম্পিকের মতো খেলেছেন তিনটি এশিয়ান গেমসেও। ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে রুপো জিতেছেন। ১৯৬৬ সালে সোনা, তাঁরই নেতৃত্বে।
আরও একটি অলিম্পিক খেলতে পারতেন ১৯৬৮ সালে। নেতৃত্বও দিতে পারতেন দেশকে। এর কোনওটাই হয়ে ওঠেনি। কেন? ভারতীয় হকির সেই চিরাচরিত রাজনীতি। নিজের কথা বিশেষ বলতে চাইতেন না। ৩৬ বছর আগে অনেক পীড়াপীড়ির পর বাড়িতে বসে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, রাজনীতির জন্যই ওটা হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৮-র মেক্সিকো অলিম্পিকের দল গড়ার ট্রায়ালে আমাকে ডাকা হয়নি। ট্রায়ালের পর দল গড়াও হয়ে যায়। অবশিষ্ট ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে তিনটি ম্যাচ খেলে ওই দল। দুই গোলকিপারই আশানুরূপ খেলতে ব্যর্থ হয়। তখন আমাকে বলা হয় দলে যোগ দিতে। আমি যাইনি। আসলে আমাকে ট্রায়ালে না ডাকার বড় কারণ ছিল নেতৃত্ব। আমাকে দলে নিলে অধিনায়ক করতে হত। তাই ট্রায়ালেই ডাকা হয়নি। সেবার ওই নেতৃত্ব নিয়ে কতটা রাজনীতি হয়েছিল, তা তো সবাই জানেন। যুগ্ম অধিনায়ক! কোথাও কখনও শুনেছেন!’
খেলা ছাড়ার পর কিছুদিন কোচিংও করিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে সার্ভিসেস জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তাঁর কোচিংয়েই। মউতে ছোটদেরও খেলা শিখিয়েছেন। ১৯৮১ সালে একবার ডাক পেয়েছিলেন ভারতের জুনিয়র দলকে প্রশিক্ষণ দিতে। চারজন কোচের একজন ছিলেন তিনি। বাকিরা বেশ ভালো অঙ্কের মাইনে পেলেও শঙ্কর লক্ষ্মণকে দেওয়া হয়েছিল মোট মাত্র ৫০০ টাকা। রীতিমতো অপমানিত হয়েছিলেন। আর যাননি। ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়াডের সময়ও তাঁকে কম অপমানিত হতে হয়নি। এশিয়ান গেমসের সংগঠন কমিটি তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল উদ্বোধনের আগে মশাল দৌড়ে অংশ নিতে। তিনি চিঠি পেয়েছিলেন ইন্দোরের কালেক্টরের মাধ্যমে। দিল্লি যেতে টাকা দরকার। কে দেবেন টাকা? ট্রেনের টিকিট? ১৯৭৯ সালে আর্মির চাকরি থেকে অবসর নেওযার পরই অর্থের টানাটানি। তিনি ঠিক করেছিলেন দিল্লি যাবেন না। শুভানুধ্যায়ী, বন্ধুরা মিলে তাঁকে তুলে দিয়েছিলেন দিল্লির ট্রেনে। রাজধানী পৌঁছেও মহা সমস্যা। মাপ নিয়েও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একদিন আগে যে পোশাক দেওয়া হল তা তাঁর দ্বিগুণ সাইজের। কী আর করা যাবে, নিজের পোশাক পরেই তিনি অংশ নিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বেশ কয়েকদিন দিল্লিতে থাকলেন, খেলা দেখলেন। প্রতিশ্রুতি মতো খরচ কিন্তু দিলেন না সংগঠকেরা। ফিরে গেলেন মউতে। পরে একাধিকবার চিঠি পাঠিয়েও ২ হাজার টাকা পাননি শঙ্কর লক্ষ্মণ। ক্ষোভ, অভিমানের এরকম টুকরো টুকরো ঘটনা আরও অনেক। কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক শঙ্কর লক্ষ্মণ এ সব নিয়ে কখনও তীব্র ক্ষোভপ্রকাশ করেননি। নিজেকে আরও অনেক বেশি আটকে রেখেছিলেন মউয়ের গণ্ডিতেই। নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন ভারতীয় হকির, ভারতের খেলাধুলোর বৃহৎ জগৎ থেকে। যেন উপেক্ষার জবাব আরও বেশি উপেক্ষায়।
No comments:
Post a Comment