দাদার পরিচয়ে নয়, রূপ সিং বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছিলেন নিজের গুণে, নিজের যোগ্যতায়
ধ্যানচাঁদের ভাইও
ছিলেন মহাতারকা
নির্মলকুমার সাহা
শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা হকি খেলোয়াড় রূপ সিং। হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের ছোট ভাই। কিন্তু দাদার পরিচয়ে নয়, তিনি বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছিলেন নিজের গুণে, নিজের যোগ্যতায়।
১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে ভারত ২৪-১ গোলে হারিয়েছিল আমেরিকাকে। একা রূপ সিং-ই করেছিলেন ১০ গোল। যা এখনও অলিম্পিকে এক ম্যাচে ব্যক্তিগত বেশি গোল করার রেকর্ড। ওটাই ছিল রূপের প্রথম অলিম্পিক। আর ওই ম্যাচটি অলিম্পিকে ছিল তাঁর দ্বিতীয় ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে জাপানের বিরুদ্ধে ভারত জিতেছিল ১১-১ গোলে। যাতে রূপ সিংয়ের গোল ছিল তিনটি। জাপানের বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে একটি নজিরও তৈরি হয়েছিল। ভারতের হয়ে সেই প্রথম কোনও দাদা-ভাইয়ের একসঙ্গে অলিম্পিকে খেলা। সেন্টার ফরোয়ার্ড ধ্যানচাঁদ, লেফট ইন রূপ সিং। ধ্যানচাঁদের ওটা ছিল দ্বিতীয় অলিম্পিক। লস এঞ্জেলসে গোল করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ দাদাকে টপকে গিয়েছিলেন অনভিজ্ঞ ভাই। সেবার অলিম্পিকে সোনা জেতার পথে ভারতকে খেলতে হয়েছিল মাত্র দুটি ম্যাচ। দুই ম্যাচে ধ্যানচাঁদের গোল ছিল ১২ টি। রূপের ১৩।
১৯৩২ সালের পর দুই ভাই একসঙ্গে খেলেছিলেন আরও একটি অলিম্পিক। ১৯৩৬ সালে বার্লিনে। ধ্যানচাঁদের নেতৃত্বে সেখানেও ভারত জিতেছিল সোনার পদক। বার্লিনে দাদা-ভাই দুজনই করেছিলেন ১১টি করে গোল। অর্থাৎ দুটি অলিম্পিক মিলে গোল করায় দাদার (২৩ গোল) চেয়ে এগিয়েই ছিলেন ভাই (২৪ গোল)।
বার্লিন অলিম্পিকের আগে ১৯৩৫ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ভারতীয় দল। সেই দলেও দাদার সঙ্গে ভাই ছিলেন। ওই সফরে ৪৮ ম্যাচে ভারত করেছিল ৫৮৪ গোল। ওখানে অবশ্য গোল করায় ভাইয়ের (১৮৫ গোল) আগে ছিলেন দাদা (২০১ গোল)। ভারতের বিরুদ্ধে গোল হয়েছিল ৪০টি।
অলিম্পিকে ভারত প্রথম হকি খেলতে গিয়েছিল ১৯২৮ সালে আমস্টারডামে। রূপের দাদা ধ্যানচাঁদ ছিলেন সেই ভারতীয় দলেও। আমস্টারডাম থেকে সোনা জিতে দেশে ফেরার পর অল্প কয়েকদিন ঝাঁসির বাড়িতে ছিলেন ধ্যানচাঁদ। ঝাঁসির প্রেমগঞ্জের সেই বাড়িতে সকাল, বিকেল, রাত—সবসময়ই নানা বয়সীদের ভিড় লেগে থাকত। স্কুলের ছাত্র, স্থানীয় হকি খেলোয়াড়, সাধারণ মানুষ—সকলেই আসতেন অলিম্পিকের সোনার পদক দেখতে। অলিম্পিকের গল্প শুনতে। সেই আগ্রহীদের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর ছোট ভাই রূপ সিং।
আত্মজীবনী ‘গোল’-এ ধ্যানচাঁদ লিখেছেন, ‘আমার ছোট ভাই রূপের মধ্যে সে সময় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম। ওর তখনও কিশোর বয়স। অলিম্পিক থেকে আমি ফেরার পর ও আমার ঘরেই থাকা শুরু করে। হকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমার কথোপকথন মন দিয়ে শুনতে থাকে। আমার বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, রূপ তাদের বলেছে, খুব মন দিয়ে হকি খেলবে। এমন কথাও বলেছে, তার লক্ষ্য হকি খেলে আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে হার মানানো।’
দাদার জনপ্রিয়তাকে হার মানাতে না পারলেও রূপ সিংও হকির মহাতারকা হয়ে উঠেছিলেন। বার্লিন অলিম্পিকে রূপ সিংয়ের খেলা এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে ৩৬ বছর পরও তা মনে রেখেছিলেন জার্মানরা। ১৯৭২ সালে আবার যখন জার্মানির অন্য শহর মিউনিখে অলিম্পিকের আসর বসে সেখানে গেমস ভিলেজের একটি রাস্তা রূপের নামে করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রূপ সিং আরও অন্ততঃ একটি অলিম্পিক খেলতেন। বাড়ত তাঁর গোল ও সোনার পদকের সংখ্যাও। কী আর করা যাবে!
ধ্যানচাঁদ লিখেছেন, ‘রূপের তুলনা হয় না। পাশে ও না থাকলে কোথায় থাকতাম আমি! রূপ খেলা শিখেছে নিজের উৎসাহ আর চেষ্টাতেই। ঝাঁসিতে থাকার সময়েই হকিতে ওর হাতে খড়ি। একসঙ্গে অনেকদিন খেলেছি। বড় বলে আমি হয়ত রূপকে অল্পস্বল্প উপদেশও দিয়েছি। কিন্তু আমার জন্য রূপ সিং সর্বকালের অন্যতম সেরা হকি খেলোয়াড় হয়েছে, এটা ঠিক নয়। ও বড় হয়েছে নিজের সাধনাতেই।’
শেষ বয়সে একবার তো ধ্যানচাঁদ এমনও বলে ফেলেছিলেন, ‘রূপ আমার চেয়ে অনেক ভাল খেলোয়াড় ছিল।’
রূপ সিং খেলতেন ধ্যানচাঁদের পাশে ইনসাইড লেফটে। তাঁর খেলায় পাওয়ার, অনুমান ক্ষমতা এবং স্টিক ওয়ার্ক ছিল অতুলনীয়। গোলে নিতে পারতেন জোরালো হিট। ভাইয়ের ওই জোরালো হিট নিয়ে ধ্যানচাঁদ চিন্তিত ছিলেন। বহুবার ভাইকে সতর্ক করেছেন, যাতে ওরকম হিটে বিপক্ষের কোনও খেলোয়াড় আহত না হন। নিতে পারতেন ভাল পেনাল্টি কর্নার শটও। আক্ষরিক অর্থেই রূপ ছিলেন কমপ্লিট হকি খেলোয়াড়। ছিলেন যথার্থ স্পোর্টসম্যান। আম্পায়ারের কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে বা বিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে তর্কে জড়াতে তাঁকে কখনও দেখা যায়নি।
সাজপোষাক, জীবনযাত্রায় রূপ ছিলেন খুব পরিচ্ছন্ন। ১৯৩২ সালে অলিম্পিক দলে নির্বাচিত হয়েও তিনি প্রথমে যেতে চাননি। আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার মতো ভাল পোষাক তাঁর ছিল না। ধ্যানচাঁদ নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দেওয়ার পর তিনি লস এঞ্জেলস যেতে রাজি হয়েছিলেন।
সুমের সিংয়ের (পোশাকি নাম সমেশ্বর দত্ সিং) তিন ছেলে। মূল সিং, ধ্যান সিং (ধ্যানচাঁদ) ও রূপ সিং। রূপ সিংয়ের জন্ম জব্বলপুরে ১৯০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। দাদা ধ্যানচাঁদকে দেখেই হকিতে আসা। কিন্তু শুরু থেকে দাদার সঙ্গে একই দলে খেলা হয়ে ওঠেনি। লস এঞ্জেলস অলিম্পিকের কয়েকমাস আগে প্রথম দাদা-ভাই একসঙ্গে খেলেন। লস এঞ্জেলস যাওয়ার আগে দেশে ও বিদেশে ভারতীয় দল ১৫টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল। দাদা-ভাইয়ের মাঠের অসাধারণ বোঝাপড়াটা তৈরি হয়েছিল ওই প্রস্তুতি ম্যাচগুলো থেকেই।
চাকরি করতেন গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজ পরিবারের নিজস্ব সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীতে। ছিলেন ক্যাপ্টেন। তখন বিভিন্ন রাজ পরিবারে ক্রিকেট, গল্ফ, টেনিসের মতো খেলার কদর ছিল। নিয়মিত খেলা হত। রূপ সিংও ওই তিনটি খেলায় অংশ নিতেন। অবসরের পর আর্থিক অনটনে পড়েন। পেনশন পেতেন মাসিক ১৪৮ টাকা! সংসার চালাতে হিমশিম। কী আর করবেন, সিন্ধিয়া পরিবারের ফাইফরমাশ খেটে, বাড়ির কাজকর্ম করে কিছু টাকা উপার্জন করতেন। এভাবেই সংসার চালাতেন অলিম্পিকে জোড়া সোনাজয়ী নায়ক। শেষ জীবনে প্রবল দারিদ্র্যই ছিল তাঁর সঙ্গী।
জীবনাবসান গোয়ালিয়রেই ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পরের বছরই গোয়ালিয়রের হকি স্টেডিয়ামের নাম হয় ‘ক্যাপ্টেন রূপ সিং স্টেডিয়াম’। কিন্ত আমাদের এই ক্রিকেটসর্বস্ব দেশে কী আর হবে! ১৯৮৮ সালে পরিকাঠামো বদল করে ওটাকে ক্রিকেট স্টেডিয়াম করে ফেলা হয়। একজন সফল ক্রীড়ানায়ককে মৃত্যুর পর দেওয়া সামান্য সম্মানটুকুও কেড়ে নেওয়া। নিজের দেশে না পেলেও বিদেশে মরণোত্তর সম্মান পেয়েছেন তিনি। ২০১২ সালে অলিম্পিকের সময় লন্ডনে ভারতের যে তিনজন খেলোয়াড়ের নামে টিউব স্টেশনের নামকরণ হয়েছিল, তাঁদের একজন রূপ সিং। বাকি দু’জন ধ্যানচাঁদ ও লেসলি ক্লডিয়াস।
No comments:
Post a Comment