তাঁর পরিচয়ের শেষ নেই। বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ। বেশ কিছু অঙ্কের বইয়ের লেখক। একদা বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এরকম আরও অনেক পরিচয়। কিন্তু এসবের বাইরের অন্য একটি পরিচয়েই তিনি বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ‘বাংলার ক্রিকেটের জনক’। বাঙালিকে তিনিই প্রথম ক্রিকেট খেলার গুরুত্ব বোঝাতে পেরেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটে বাঙালির পথচলা শুরু। একাধারে ছিলেন ক্রিকেটার, কোচ, ক্রিকেট সংগঠক, ক্রিকেটের প্রচারক। তিনি অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়।
ময়মনসিংহের মসুয়ার কালীনাথ রায়ের পাঁচ ছেলে। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন। পাঁচ ভাইয়ের চারজন সারদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন পিতৃদত্ত নামেই পরিচিত। কিন্তু কামদারঞ্জন বিখ্যাত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে। কালীনাথ রায়ের এক আত্মীয় কামদারঞ্জনকে পাঁচ বছর বয়সে দত্তক নেওয়ার পর নাম রেখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। আর রায়ের পর ‘চৌধুরী’ হল সম্মানসূচক উপাধি।
মসুয়া গ্রামের ওই রায় পরিবারে শুধু সাহিত্যচর্চা নয়, ক্রীড়াচর্চাও গুরুত্ব পেত। বিশেষ করে ক্রিকেট। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্যই সারদারঞ্জনের। তিনিই ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, অভিভাবক। তাঁর হাত ধরেই ওই পরিবারে ঢুকেছিল খেলাধুলো। পরিবারের সবাইকেই তিনি খেলাধুলোয় আগ্রহী করে তুলতে পেরেছিলেন। আর কমবেশি সব ভাইকেই টেনে আনতে পেরেছিলেন ক্রিকেট মাঠে। সারদারঞ্জনের মতোই শেষের তিনজন মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন টাউন ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। একসময় টাউন ক্লাবের হয়ে ৪ ভাই একসঙ্গেও খেলেছেন। উপেন্দ্রকিশোর ছোটদের জন্য লেখালেখি নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ছোটদের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সন্দেশ’ প্রথম প্রকাশিত হয়। তবে তিনিও ক্রিকেটে আগ্রহী ছিলেন। সময় পেলেই ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতেন। ১৮৯৯ সালে পাতিয়ালার মহারাজার ক্রিকেট দল যখন কলকাতায় খেলতে এসেছিল, ইডেনে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে দর্শক আসনে ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। পাতিয়ালার ওই দলে ছিলেন রনজি। শুধু তাই নয়, রনজির ওই কলকাতা সফরের সময় তাঁকে নিয়ে তখনকার ‘প্রদীপ’ পত্রিকায় একটি লেখাও লিখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। যে লেখার শিরোনাম ছিল ‘রণজিৎ সিংহজী’।
সারদারঞ্জনের জন্ম ১৮৫৮ সালের ২৪ মে। ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার মসুয়া গ্রামে। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুল থেকে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই ক্রিকেট খেলাটা নিয়মিত হয়ে যায়। শুরু হয় নিয়মিত ব্যায়ামচর্চাও। সারদারঞ্জন মনে করতেন, খেলাধুলো করতে হলে সবার আগে শরীর গড়তে হবে। ব্যায়ামচর্চার জন্য তিনি দলবল নিয়ে যেতেন ঢাকার তখনকার বিখ্যাত পালোয়ান অধীর ঘোষের আখড়ায়। ওটা অবশ্য অধীর গোয়ালার আখড়া নামেই বেশি পরিচিত ছিল। একা নন, তিনি শরীরচর্চা ও ক্রিকেট খেলায় সঙ্গী করে ফেলেছিলেন নিজের ভাইদের পাশাপাশি কলেজের অন্য ছাত্রদেরও। ঢাকায় আগে থেকেই ক্রিকেট খেলার চল ছিল। তা অবশ্যই বেশিমাত্রায় ইংরেজদের মধ্যেই। সারদারঞ্জন ঢাকায় যাওয়ার পর তাঁর উদ্যোগেই বাঙালি ছেলেদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার আগ্রহ দেখা দেয়। গড়ে ফেলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। অধ্যাপক হিসেবে পরে যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন, তখনও ছাত্রদের মধ্যে ক্রিকেট খেলা ছড়িয়ে দিতে ক্লান্তিহীন ছিলেন। ছাত্র ও অধ্যাপকদের নিয়ে ক্রিকেট দল গড়ে নানা জায়গায় খেলতে যাওয়াটা ছিল তাঁর নেশা।
ঢাকা কলেজের তখন অধ্যক্ষ মিস্টার বুথ, গণিতের অধ্যাপক সারদারঞ্জন। একসময় কলেজে ক্রিকেটের কর্মকাণ্ড চালাতে মিস্টার বুথের সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছেন সারদারঞ্জন। কিন্তু পরে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করেই তাঁর সঙ্গে সারদারঞ্জনের মতান্তর। ঢাকা কলেজের ক্রিকেট দল কলকাতায় এসেছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে। ছাত্রদের সঙ্গে সারদারঞ্জন ও আরও কয়েকজন অধ্যাপক ওই ম্যাচে অংশ নেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ হেরে যায়। হারের পর শুধু ছাত্রদের নিয়ে দল গড়ে আর একটা ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দেয় প্রেসিডেন্সি। অধ্যক্ষ বুথ ওই ম্যাচে একমাত্র অধ্যাপক সারদারঞ্জনকে খেলার অনুরোধ করেন। ওই অনুরোধ তিনি মেনে নিতে পারেননি। যা থেকে বিরোধ তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত চাকরিই ছেড়ে দেন সারদারঞ্জন। পরে বিদ্যাসাগরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৮৮৮ সালে যোগ দেন মেট্রোপলিটন কলেজে। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর (২৯ জুলাই, ১৮৯১) পর কলেজ চালানোর দায়দায়িত্ব অনেকটাই নিতে হয় সারদারঞ্জনকে। সামলাতে হয় কলেজের আর্থিক সমস্যাও।
মিস্টার বুথের সঙ্গে বিরোধ ও তাঁর বড় জ্যাঠামশাই সারদারঞ্জন সম্পর্কে ‘আর কোনোখানে’ বইয়ে বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদার লিখেছেন, ‘‘ওরকম তেজী মানুষ আজকাল কম দেখা যায়। এখন বোঝাপড়ার যুগ এসেছে, কিন্তু আমার বড় জ্যাঠামশাই বলতেন, ‘Compromise আবার কি? অন্যায়ের সঙ্গে কখনো Compromise হয় না, অন্যায় সর্বদা অন্যায়।’ কাজের বেলাও তাই। প্রথম সরকারী কলেজে চাকরিতে ঢুকেছেন, একাধারে পণ্ডিত ও খেলোয়াড়, ভবিষ্যতে অনেক উন্নতির সম্ভাবনা, তখনি গোল বাধল। ইংরেজ প্রিন্সিপাল আদেশ করলেন, একটা বিশেষ ম্যাচে কলেজের ক্রিকেট টীমে নামতে হবে। বড় জ্যাঠামশাই তো অবাক—‘ও তো ছাত্রদের টীম, অন্য কলেজের ছাত্রদের খেলা হবে, তাতে আমি কি করে খেলি?’ সাহেব বলল, ‘কেউ টের পাবে না আমরা জিতে যাব। আমি আদেশ করছি।’ শুনে বড় জ্যাঠামশাইয়ের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। বললেন, ‘এমন অন্যায় আদেশ আমি মানি না।’ ব্যস, অমন ভালো চাকরি তখনি ছেড়ে দিলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর কখনো ইংরেজ সরকারের চাকরি করবেন না। করেনও নি। এমন মানুষকে যে বিদ্যাসাগরমশাই খুঁজে-পেতে তাঁর কলেজে ঢোকাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি?’’
পরে মেট্রোপলিটন কলেজের নাম বদলে হয় বিদ্যাসাগর কলেজ। ১৯০৯ সালে বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ হন সারদারঞ্জন। ওই পদে ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
অন্যায়ের প্রতিবাদে আগে আরও একবার চাকরি ছেড়েছিলেন। সারদারঞ্জন ছিলেন ডবল এম এ, অঙ্কে ও সংস্কৃতে। তাঁর প্রথম চাকরি আলিগড় এম এ ও কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে। সেই চাকরি কেন ছেড়েছিলেন তা তুলে ধরা যাক বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় বসুর একটি লেখা থেকে, ‘একদিন সংস্কৃতের অধ্যাপক অনুপস্থিত হওয়ায় অধ্যক্ষ তাঁকে সংস্কৃত ক্লাসে গিয়ে ছেলেদের অঙ্ক দিয়ে চুপ করিয়ে রাখতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধে সম্মত হয়ে সারদারঞ্জন ক্লাস নিলেন, তবে ছেলেদের তিনি আঁক কষালেন না, বিকল্পে পড়ালেন সংস্কৃতই। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থায় হিতে বিপরীত ঘটলো। ছেলেরা ক্লাসের পর বায়না ধরলো যে তাঁর কাছেই সংস্কৃত শিক্ষা করবে বলে। খবরটা অধ্যক্ষের কানে উঠতে তিনিও এক ঢিলে দুই পাখী মারার সঙ্কল্পে উৎফুল্ল হয়ে সারদারঞ্জনকে ভবিষ্যতে গণিত ও সংস্কৃত, দুটি অধ্যাপকের পদ যুগ্মভাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব জানালেন। নতুন প্রস্তাব গ্রহণে সারদারঞ্জনের আপত্তি ছিল না, যদি তাঁকে বর্ধিত হারে বেতন দেওয়া হয়। এই নিয়ে সারদাঞ্জনের সঙ্গে অধ্যক্ষ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘটলো মতানৈক্য, ফলে আলিগড়ের চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ডিরেক্টর ক্রফট সাহেবের অনুরোধে চলে আসেন বহরমপুর কলেজে।’
বহরমপুরে অবশ্য বেশিদিন থাকতে হয়নি সারদারঞ্জনকে। বহরমপুর ও ঢাকা, দুটিই সরকারি কলেজ। বহরমপুর থেকে বদলি হয়ে তাঁকে আসতে হয় ঢাকা কলেজে। একদা যে কলেজের ছাত্র ছিলেন, এবার সেখানে অধ্যাপক।
যখন যে কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন সেখানেই খেলাধুলোর, বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রসারে উদ্যোগী হয়েছেন নিজের ইচ্ছায়। আলিগড়ে গিয়েও ওখানকার ছাত্রদের মধ্যে ক্রিকেটে খেলা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারদারঞ্জন। আলিগড়ে ক্রিকেট খেলার চল সারদারঞ্জনের সময় থেকেই। অধ্যাপনার পাট চুকিয়ে চলে আসার পরও ক্রিকেট দল নিয়ে আলিগড়ে গিয়েছেন ম্যাচ খেলতে। আসলে আলিগড়ের ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তরিকভাবে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন যে নিজেকে আর বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। মেট্রোপলিটন বা বিদ্যাসাগর কলেজের ক্রিকেট দল ওঁর আমলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি ওই কলেজে গুরুত্ব পেয়েছে ফুটবলও। ওই সময় অনেকে ক্লাব পর্যায়ে একসঙ্গে একাধিক খেলায় অংশ নিতেন। কলেজ দলের হয়েও অনেকেই ফুটবল, ক্রিকেট সমান দক্ষতায় খেলেছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন না ‘চীনের প্রাচীর’গোষ্ঠ পালও। ফুটবলার হিসেবে বিখ্যাত হলেও ক্লাব পর্যায়ে গোষ্ঠ পাল চুটিয়ে খেলেছেন ক্রিকেট, হকিও। বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ক্রিকেটে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল সারদারঞ্জনের কাছে। হেমাঙ্গ বসু, জিতেন ব্যানার্জি, শৈলেশ বসু, তুলসী দত্ত, হাবুল মিত্রর মতো আরও অনেকেরও তাই। বিদ্যাসাগর কলেজের দল নিয়েও তিনি ভারতের নানা প্রান্তে গিয়েছেন, প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য। বিদ্যাসাগর কলেজের শতবর্ষের স্মারক গ্রন্থে ‘স্মৃতিকথা’-য় গোষ্ঠ পাল লিখেছেন, ‘মোহনবাগানের নামী ব্যাক আমি। কিন্তু হঠাৎ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। সারদারঞ্জন আমাকেও ঐ খেলার কৌশল হাতে ধরে শিখিয়েছেন। তারপরে কলেজ ও মোহনবাগানের হয়ে বহু সেঞ্চুরী করেছি। ...... ১৯১৯ সালে সারদারঞ্জন কলেজের দল নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সফরে গিয়েছিলেন। এ-দলে তুলসী দত্ত, হাবুল মিত্র, সুশান্ত ঘোষ, রবি মিত্র, হেমাঙ্গ বসু এবং আমি ছিলাম।.....সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা, কলেজে ক্রিকেট খেলে স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম। এলাহাবাদে কলেজের পক্ষে ক্রিকেট খেলে সেঞ্চুরী করেছিলাম।’
সারদারঞ্জনের উদ্যোগে বাঙালি ক্লাবগুলোর মধ্যে টাউন-ই প্রথম ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নেয়। শুধু টাউন ক্লাবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা নয়, ১৯২০ সালে যখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়, সারদারঞ্জন ছিলেন প্রথম সভাপতি। স্পোর্টিং ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পেছনেও অবদান রয়েছে সারদারঞ্জনের। ওখানেও বাঙালি ছেলেদের প্রাধান্য দিয়ে ক্রিকেট দল গড়ায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। একদা নাটোর দল গড়ার ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। ১৯১৩-১৪ সালে তাঁর চেষ্টাতেই প্রথম ইংলিশ বনাম বেঙ্গলি স্কুল ক্রিকেট ম্যাচ হয়। কীভাবে ক্রিকেট খেলতে হয় এবং তার নিয়মকানুন নিয়ে ১৮৯৮ সালে তখনকার ‘মুকুল’ পত্রিকায় ছোটদের জন্য সারদারঞ্জন একটি লেখাও লিখেছিলেন। যার শিরোনাম ছিল ‘ক্রিকেট খেলা’।
শুধু নিজের ভাইদের নয়, সারদারঞ্জন তাঁর অন্য অনেক আত্মীয়কেও টেনে আনতে পেরেছিলেন ক্রিকেট মাঠে। যেমন সারদারঞ্জনের প্রভাবেই তাঁর দুই ভাগ্নে কার্তিক-গণেশ (বসু) বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ক্রিকেটে। সেই প্রভাবেই রায় ও বসু পরিবারের পরের প্রজন্মের আরও অনেকেও ক্রিকেটে ঝোঁকেন। সেই তালিকা দীর্ঘ। তাঁরাও প্রায় সবাই সারদারঞ্জনের মতোই জড়িয়ে পড়েছিলেন টাউন বা স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে।
ক্রিকেটে তিনি এতটাই আসক্ত ছিলেন যে শেষ বয়সেও শুধু দল গড়া বা খেলা শেখানোর মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি। বয়সের তোয়াক্কা না করে ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ খেলতে নেমে পড়তেন। সারদারঞ্জনের মৃত্যু ৬৭ বছর বয়সে (১ নভেম্বর, ১৯২৫) দেওঘরে। তার আগের বছরও (৬৬ বছর বয়সে) তিনি বিদ্যাসাগর কলেজের হয়ে ই বি আর ম্যানসনের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। প্রশংসনীয় ছিল তাঁর ওই উদ্যম।
শুধু ক্রিকেট শেখানো নয়, সবাই যাতে ক্রিকেট খেলার উন্নত সরঞ্জাম পান তার ব্যবস্থাও করেছিলেন সারদারঞ্জন। ১৮৯৯ সালে খুলেছিলেন ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকান, এস রায় অ্যান্ড কোং। সেখানে ছাত্ররা কম পয়সায় ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনতে পারতেন। শোনা যায়, প্রত্যেক ম্যাচের সেরা ব্যাটসম্যানকে তিনি নিজের দোকান থেকে দামী ব্যাট উপহার দিতেন। ওঁর দোকানে পাশাপাশি বিক্রি হত ফুটবলও। ওই দোকানে আর পাওয়া যেত মাছ ধরার বড়শি, ছিপ ও অন্যান্য সামগ্রী। এই ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকান খোলার অন্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল। বিদ্যাসাগর কলেজ তখন আর্থিক সমস্যায় ধুঁকছে। কলেজকে আর্থিক সহায়তা দেওয়াটা নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছিলেন সারদারঞ্জন। কলেজকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য আগেই, ১৮৯৪ সালে তিনি অবশ্য একটি প্রকাশনা সংস্থাও চালু করেছিলেন।
ওই ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকানে মাছ ধরার সামগ্রী রাখার কারণটাও গুরুত্বপূর্ণ। সারদারঞ্জন পারদর্শী ছিলেন মাছ ধরায়ও। ওটাও ছিল তাঁর আরেকটি প্যাশন। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মাছ ধরতে যেতেন।
ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিংয়েই সারদারঞ্জনের দক্ষতা ছিল বেশি। মিডিয়াম পেস বল করতেন। বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার ডব্লু জি গ্রেসের সঙ্গে তাঁর চেহারায় অনেক সাদৃশ্য ছিল। দু’জনেই ছিলেন শ্মশ্রুধারী। তাই ‘বাংলার ক্রিকেটের জনক’-কে ‘বাংলার ডব্লু জি গ্রেস’-ও বলা হয়।
বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার ডব্লু জি গ্রেসের সঙ্গে তাঁর চেহারায় অনেক সাদৃশ্য ছিল। দু’জনেই ছিলেন শ্মশ্রুধারী। তাই ‘বাংলার ক্রিকেটের জনক’-কে ‘বাংলার ডব্লু জি গ্রেস’-ও বলা হয়।
‘বাংলার ক্রিকেটের জনক’
সারদারঞ্জন রায়
নির্মলকুমার সাহা
তাঁর পরিচয়ের শেষ নেই। বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ। বেশ কিছু অঙ্কের বইয়ের লেখক। একদা বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এরকম আরও অনেক পরিচয়। কিন্তু এসবের বাইরের অন্য একটি পরিচয়েই তিনি বেশি বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ‘বাংলার ক্রিকেটের জনক’। বাঙালিকে তিনিই প্রথম ক্রিকেট খেলার গুরুত্ব বোঝাতে পেরেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটে বাঙালির পথচলা শুরু। একাধারে ছিলেন ক্রিকেটার, কোচ, ক্রিকেট সংগঠক, ক্রিকেটের প্রচারক। তিনি অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়।
ময়মনসিংহের মসুয়ার কালীনাথ রায়ের পাঁচ ছেলে। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন। পাঁচ ভাইয়ের চারজন সারদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন পিতৃদত্ত নামেই পরিচিত। কিন্তু কামদারঞ্জন বিখ্যাত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে। কালীনাথ রায়ের এক আত্মীয় কামদারঞ্জনকে পাঁচ বছর বয়সে দত্তক নেওয়ার পর নাম রেখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। আর রায়ের পর ‘চৌধুরী’ হল সম্মানসূচক উপাধি।
মসুয়া গ্রামের ওই রায় পরিবারে শুধু সাহিত্যচর্চা নয়, ক্রীড়াচর্চাও গুরুত্ব পেত। বিশেষ করে ক্রিকেট। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্যই সারদারঞ্জনের। তিনিই ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে, অভিভাবক। তাঁর হাত ধরেই ওই পরিবারে ঢুকেছিল খেলাধুলো। পরিবারের সবাইকেই তিনি খেলাধুলোয় আগ্রহী করে তুলতে পেরেছিলেন। আর কমবেশি সব ভাইকেই টেনে আনতে পেরেছিলেন ক্রিকেট মাঠে। সারদারঞ্জনের মতোই শেষের তিনজন মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন টাউন ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। একসময় টাউন ক্লাবের হয়ে ৪ ভাই একসঙ্গেও খেলেছেন। উপেন্দ্রকিশোর ছোটদের জন্য লেখালেখি নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই ছোটদের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সন্দেশ’ প্রথম প্রকাশিত হয়। তবে তিনিও ক্রিকেটে আগ্রহী ছিলেন। সময় পেলেই ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতেন। ১৮৯৯ সালে পাতিয়ালার মহারাজার ক্রিকেট দল যখন কলকাতায় খেলতে এসেছিল, ইডেনে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে দর্শক আসনে ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। পাতিয়ালার ওই দলে ছিলেন রনজি। শুধু তাই নয়, রনজির ওই কলকাতা সফরের সময় তাঁকে নিয়ে তখনকার ‘প্রদীপ’ পত্রিকায় একটি লেখাও লিখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। যে লেখার শিরোনাম ছিল ‘রণজিৎ সিংহজী’।
সারদারঞ্জনের জন্ম ১৮৫৮ সালের ২৪ মে। ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার মসুয়া গ্রামে। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলের ছাত্র থাকার সময়ই ক্রিকেটে হাতেখড়ি। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুল থেকে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই ক্রিকেট খেলাটা নিয়মিত হয়ে যায়। শুরু হয় নিয়মিত ব্যায়ামচর্চাও। সারদারঞ্জন মনে করতেন, খেলাধুলো করতে হলে সবার আগে শরীর গড়তে হবে। ব্যায়ামচর্চার জন্য তিনি দলবল নিয়ে যেতেন ঢাকার তখনকার বিখ্যাত পালোয়ান অধীর ঘোষের আখড়ায়। ওটা অবশ্য অধীর গোয়ালার আখড়া নামেই বেশি পরিচিত ছিল। একা নন, তিনি শরীরচর্চা ও ক্রিকেট খেলায় সঙ্গী করে ফেলেছিলেন নিজের ভাইদের পাশাপাশি কলেজের অন্য ছাত্রদেরও। ঢাকায় আগে থেকেই ক্রিকেট খেলার চল ছিল। তা অবশ্যই বেশিমাত্রায় ইংরেজদের মধ্যেই। সারদারঞ্জন ঢাকায় যাওয়ার পর তাঁর উদ্যোগেই বাঙালি ছেলেদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার আগ্রহ দেখা দেয়। গড়ে ফেলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। অধ্যাপক হিসেবে পরে যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন, তখনও ছাত্রদের মধ্যে ক্রিকেট খেলা ছড়িয়ে দিতে ক্লান্তিহীন ছিলেন। ছাত্র ও অধ্যাপকদের নিয়ে ক্রিকেট দল গড়ে নানা জায়গায় খেলতে যাওয়াটা ছিল তাঁর নেশা।
ঢাকা কলেজের তখন অধ্যক্ষ মিস্টার বুথ, গণিতের অধ্যাপক সারদারঞ্জন। একসময় কলেজে ক্রিকেটের কর্মকাণ্ড চালাতে মিস্টার বুথের সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছেন সারদারঞ্জন। কিন্তু পরে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করেই তাঁর সঙ্গে সারদারঞ্জনের মতান্তর। ঢাকা কলেজের ক্রিকেট দল কলকাতায় এসেছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে। ছাত্রদের সঙ্গে সারদারঞ্জন ও আরও কয়েকজন অধ্যাপক ওই ম্যাচে অংশ নেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ হেরে যায়। হারের পর শুধু ছাত্রদের নিয়ে দল গড়ে আর একটা ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দেয় প্রেসিডেন্সি। অধ্যক্ষ বুথ ওই ম্যাচে একমাত্র অধ্যাপক সারদারঞ্জনকে খেলার অনুরোধ করেন। ওই অনুরোধ তিনি মেনে নিতে পারেননি। যা থেকে বিরোধ তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত চাকরিই ছেড়ে দেন সারদারঞ্জন। পরে বিদ্যাসাগরের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৮৮৮ সালে যোগ দেন মেট্রোপলিটন কলেজে। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর (২৯ জুলাই, ১৮৯১) পর কলেজ চালানোর দায়দায়িত্ব অনেকটাই নিতে হয় সারদারঞ্জনকে। সামলাতে হয় কলেজের আর্থিক সমস্যাও।
মিস্টার বুথের সঙ্গে বিরোধ ও তাঁর বড় জ্যাঠামশাই সারদারঞ্জন সম্পর্কে ‘আর কোনোখানে’ বইয়ে বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদার লিখেছেন, ‘‘ওরকম তেজী মানুষ আজকাল কম দেখা যায়। এখন বোঝাপড়ার যুগ এসেছে, কিন্তু আমার বড় জ্যাঠামশাই বলতেন, ‘Compromise আবার কি? অন্যায়ের সঙ্গে কখনো Compromise হয় না, অন্যায় সর্বদা অন্যায়।’ কাজের বেলাও তাই। প্রথম সরকারী কলেজে চাকরিতে ঢুকেছেন, একাধারে পণ্ডিত ও খেলোয়াড়, ভবিষ্যতে অনেক উন্নতির সম্ভাবনা, তখনি গোল বাধল। ইংরেজ প্রিন্সিপাল আদেশ করলেন, একটা বিশেষ ম্যাচে কলেজের ক্রিকেট টীমে নামতে হবে। বড় জ্যাঠামশাই তো অবাক—‘ও তো ছাত্রদের টীম, অন্য কলেজের ছাত্রদের খেলা হবে, তাতে আমি কি করে খেলি?’ সাহেব বলল, ‘কেউ টের পাবে না আমরা জিতে যাব। আমি আদেশ করছি।’ শুনে বড় জ্যাঠামশাইয়ের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। বললেন, ‘এমন অন্যায় আদেশ আমি মানি না।’ ব্যস, অমন ভালো চাকরি তখনি ছেড়ে দিলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর কখনো ইংরেজ সরকারের চাকরি করবেন না। করেনও নি। এমন মানুষকে যে বিদ্যাসাগরমশাই খুঁজে-পেতে তাঁর কলেজে ঢোকাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি?’’
পরে মেট্রোপলিটন কলেজের নাম বদলে হয় বিদ্যাসাগর কলেজ। ১৯০৯ সালে বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ হন সারদারঞ্জন। ওই পদে ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
অন্যায়ের প্রতিবাদে আগে আরও একবার চাকরি ছেড়েছিলেন। সারদারঞ্জন ছিলেন ডবল এম এ, অঙ্কে ও সংস্কৃতে। তাঁর প্রথম চাকরি আলিগড় এম এ ও কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে। সেই চাকরি কেন ছেড়েছিলেন তা তুলে ধরা যাক বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় বসুর একটি লেখা থেকে, ‘একদিন সংস্কৃতের অধ্যাপক অনুপস্থিত হওয়ায় অধ্যক্ষ তাঁকে সংস্কৃত ক্লাসে গিয়ে ছেলেদের অঙ্ক দিয়ে চুপ করিয়ে রাখতে অনুরোধ করলেন। অনুরোধে সম্মত হয়ে সারদারঞ্জন ক্লাস নিলেন, তবে ছেলেদের তিনি আঁক কষালেন না, বিকল্পে পড়ালেন সংস্কৃতই। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থায় হিতে বিপরীত ঘটলো। ছেলেরা ক্লাসের পর বায়না ধরলো যে তাঁর কাছেই সংস্কৃত শিক্ষা করবে বলে। খবরটা অধ্যক্ষের কানে উঠতে তিনিও এক ঢিলে দুই পাখী মারার সঙ্কল্পে উৎফুল্ল হয়ে সারদারঞ্জনকে ভবিষ্যতে গণিত ও সংস্কৃত, দুটি অধ্যাপকের পদ যুগ্মভাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব জানালেন। নতুন প্রস্তাব গ্রহণে সারদারঞ্জনের আপত্তি ছিল না, যদি তাঁকে বর্ধিত হারে বেতন দেওয়া হয়। এই নিয়ে সারদাঞ্জনের সঙ্গে অধ্যক্ষ ও কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঘটলো মতানৈক্য, ফলে আলিগড়ের চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ডিরেক্টর ক্রফট সাহেবের অনুরোধে চলে আসেন বহরমপুর কলেজে।’
বহরমপুরে অবশ্য বেশিদিন থাকতে হয়নি সারদারঞ্জনকে। বহরমপুর ও ঢাকা, দুটিই সরকারি কলেজ। বহরমপুর থেকে বদলি হয়ে তাঁকে আসতে হয় ঢাকা কলেজে। একদা যে কলেজের ছাত্র ছিলেন, এবার সেখানে অধ্যাপক।
যখন যে কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন সেখানেই খেলাধুলোর, বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রসারে উদ্যোগী হয়েছেন নিজের ইচ্ছায়। আলিগড়ে গিয়েও ওখানকার ছাত্রদের মধ্যে ক্রিকেটে খেলা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারদারঞ্জন। আলিগড়ে ক্রিকেট খেলার চল সারদারঞ্জনের সময় থেকেই। অধ্যাপনার পাট চুকিয়ে চলে আসার পরও ক্রিকেট দল নিয়ে আলিগড়ে গিয়েছেন ম্যাচ খেলতে। আসলে আলিগড়ের ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তরিকভাবে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিলেন যে নিজেকে আর বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। মেট্রোপলিটন বা বিদ্যাসাগর কলেজের ক্রিকেট দল ওঁর আমলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি ওই কলেজে গুরুত্ব পেয়েছে ফুটবলও। ওই সময় অনেকে ক্লাব পর্যায়ে একসঙ্গে একাধিক খেলায় অংশ নিতেন। কলেজ দলের হয়েও অনেকেই ফুটবল, ক্রিকেট সমান দক্ষতায় খেলেছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন না ‘চীনের প্রাচীর’গোষ্ঠ পালও। ফুটবলার হিসেবে বিখ্যাত হলেও ক্লাব পর্যায়ে গোষ্ঠ পাল চুটিয়ে খেলেছেন ক্রিকেট, হকিও। বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ক্রিকেটে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল সারদারঞ্জনের কাছে। হেমাঙ্গ বসু, জিতেন ব্যানার্জি, শৈলেশ বসু, তুলসী দত্ত, হাবুল মিত্রর মতো আরও অনেকেরও তাই। বিদ্যাসাগর কলেজের দল নিয়েও তিনি ভারতের নানা প্রান্তে গিয়েছেন, প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য। বিদ্যাসাগর কলেজের শতবর্ষের স্মারক গ্রন্থে ‘স্মৃতিকথা’-য় গোষ্ঠ পাল লিখেছেন, ‘মোহনবাগানের নামী ব্যাক আমি। কিন্তু হঠাৎ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। সারদারঞ্জন আমাকেও ঐ খেলার কৌশল হাতে ধরে শিখিয়েছেন। তারপরে কলেজ ও মোহনবাগানের হয়ে বহু সেঞ্চুরী করেছি। ...... ১৯১৯ সালে সারদারঞ্জন কলেজের দল নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সফরে গিয়েছিলেন। এ-দলে তুলসী দত্ত, হাবুল মিত্র, সুশান্ত ঘোষ, রবি মিত্র, হেমাঙ্গ বসু এবং আমি ছিলাম।.....সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা, কলেজে ক্রিকেট খেলে স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম। এলাহাবাদে কলেজের পক্ষে ক্রিকেট খেলে সেঞ্চুরী করেছিলাম।’
সারদারঞ্জনের উদ্যোগে বাঙালি ক্লাবগুলোর মধ্যে টাউন-ই প্রথম ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নেয়। শুধু টাউন ক্লাবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা নয়, ১৯২০ সালে যখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়, সারদারঞ্জন ছিলেন প্রথম সভাপতি। স্পোর্টিং ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠার পেছনেও অবদান রয়েছে সারদারঞ্জনের। ওখানেও বাঙালি ছেলেদের প্রাধান্য দিয়ে ক্রিকেট দল গড়ায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। একদা নাটোর দল গড়ার ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। ১৯১৩-১৪ সালে তাঁর চেষ্টাতেই প্রথম ইংলিশ বনাম বেঙ্গলি স্কুল ক্রিকেট ম্যাচ হয়। কীভাবে ক্রিকেট খেলতে হয় এবং তার নিয়মকানুন নিয়ে ১৮৯৮ সালে তখনকার ‘মুকুল’ পত্রিকায় ছোটদের জন্য সারদারঞ্জন একটি লেখাও লিখেছিলেন। যার শিরোনাম ছিল ‘ক্রিকেট খেলা’।
শুধু নিজের ভাইদের নয়, সারদারঞ্জন তাঁর অন্য অনেক আত্মীয়কেও টেনে আনতে পেরেছিলেন ক্রিকেট মাঠে। যেমন সারদারঞ্জনের প্রভাবেই তাঁর দুই ভাগ্নে কার্তিক-গণেশ (বসু) বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন বাংলার ক্রিকেটে। সেই প্রভাবেই রায় ও বসু পরিবারের পরের প্রজন্মের আরও অনেকেও ক্রিকেটে ঝোঁকেন। সেই তালিকা দীর্ঘ। তাঁরাও প্রায় সবাই সারদারঞ্জনের মতোই জড়িয়ে পড়েছিলেন টাউন বা স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে।
ক্রিকেটে তিনি এতটাই আসক্ত ছিলেন যে শেষ বয়সেও শুধু দল গড়া বা খেলা শেখানোর মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি। বয়সের তোয়াক্কা না করে ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে ম্যাচ খেলতে নেমে পড়তেন। সারদারঞ্জনের মৃত্যু ৬৭ বছর বয়সে (১ নভেম্বর, ১৯২৫) দেওঘরে। তার আগের বছরও (৬৬ বছর বয়সে) তিনি বিদ্যাসাগর কলেজের হয়ে ই বি আর ম্যানসনের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন। প্রশংসনীয় ছিল তাঁর ওই উদ্যম।
শুধু ক্রিকেট শেখানো নয়, সবাই যাতে ক্রিকেট খেলার উন্নত সরঞ্জাম পান তার ব্যবস্থাও করেছিলেন সারদারঞ্জন। ১৮৯৯ সালে খুলেছিলেন ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকান, এস রায় অ্যান্ড কোং। সেখানে ছাত্ররা কম পয়সায় ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনতে পারতেন। শোনা যায়, প্রত্যেক ম্যাচের সেরা ব্যাটসম্যানকে তিনি নিজের দোকান থেকে দামী ব্যাট উপহার দিতেন। ওঁর দোকানে পাশাপাশি বিক্রি হত ফুটবলও। ওই দোকানে আর পাওয়া যেত মাছ ধরার বড়শি, ছিপ ও অন্যান্য সামগ্রী। এই ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকান খোলার অন্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল। বিদ্যাসাগর কলেজ তখন আর্থিক সমস্যায় ধুঁকছে। কলেজকে আর্থিক সহায়তা দেওয়াটা নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছিলেন সারদারঞ্জন। কলেজকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য আগেই, ১৮৯৪ সালে তিনি অবশ্য একটি প্রকাশনা সংস্থাও চালু করেছিলেন।
ওই ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকানে মাছ ধরার সামগ্রী রাখার কারণটাও গুরুত্বপূর্ণ। সারদারঞ্জন পারদর্শী ছিলেন মাছ ধরায়ও। ওটাও ছিল তাঁর আরেকটি প্যাশন। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মাছ ধরতে যেতেন।
ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিংয়েই সারদারঞ্জনের দক্ষতা ছিল বেশি। মিডিয়াম পেস বল করতেন। বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটার ডব্লু জি গ্রেসের সঙ্গে তাঁর চেহারায় অনেক সাদৃশ্য ছিল। দু’জনেই ছিলেন শ্মশ্রুধারী। তাই ‘বাংলার ক্রিকেটের জনক’-কে ‘বাংলার ডব্লু জি গ্রেস’-ও বলা হয়।
No comments:
Post a Comment