সৈয়দ মোদি হত্যাকাণ্ডের
৩২ বছর পরও মেলেনি
অনেক প্রশ্নের জবাব
নির্মলকুমার সাহা
(১৯৮৮-র ২৮ জুলাই। ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের এক অভিশপ্ত দিন। পুরুষ সিঙ্গলসে ৮ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সৈয়দ মোদি গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে। আজ ৩২ বছর পরও যা পুরনো ব্যাডমিন্টন প্রেমীদের কষ্ট দেয়।)
প্রতিদিনের মতো সেদিনও লখনৌর কে ডি সিং বাবু স্টেডিয়ামে বিকেলে অনুশীলন করতে গিয়েছিলেন সৈয়দ মোদি। সাধারণত অনুশীলনে সঙ্গী হতেন স্ত্রী অমিতা মোদি। তিনিও বিখ্যাত ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। কিন্তু ১৯৮৮-র ২৮ জুলাইয়ের সেই অভিশপ্ত বিকেলে অমিতা সঙ্গে ছিলেন না। সৈয়দ মোদি ছিলেন একা। ওঁদের শিশু কন্যার বয়স তখন মাত্র ২ মাস। ফলে অনেকদিন ধরেই অনুশীলনে অনিয়মিত ছিলেন অমিতা। অনুশীলন শেষে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে প্রতিদিনই সৈয়দ মোদি যেতেন সামনের এক দোকানে স্ন্যাকস খেতে। সেদিনও যাচ্ছিলেন সেদিকেই। কিন্তু তার আগেই স্টেডিয়ামের গেটের কাছে যেতেই কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় একটা মারুতি গাড়ি। গাড়িতে আরোহী ছিলেন ৬ জন। মোদি আরও একটু এগোন। গাড়ির আরও কাছাকাছি পৌঁছে যান। তখনই গাড়ির ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে তাঁকে লক্ষ্য করে। গুলিবিদ্ধ সৈয়দ মোদি রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়। গুলির শব্দ শুনে আরও যাঁরা স্টেডিয়াম থেকে বেরোচ্ছিলেন ছুটে আসেন। আশপাশের মানুষরাও জড়ো হন। ততক্ষণে আততায়ীরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গেই দেশের অন্যতম সেরা ব্যাডমিন্টন তারকাকে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও কিছু করে উঠতে পারেননি। জানিয়ে দেন, হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যু ঘটেছে! মোদির বুকে চারটি গুলি লেগেছিল। যার মধ্যে একটা হৃদযন্ত্র বিদ্ধ করেছিল।
মৃত্যু কখন কীভাবে আসে, কেউ জানে না! সেদিন তো সৈয়দ মোদির লখনৌয়ে থাকারই কথা ছিল না। দিল্লিতে সেদিনই ছিল অর্জুন পুরস্কার প্রাপকদের এক সম্মেলন। ওই সম্মেলনে থাকার কথা ছিল ‘অর্জুন’ সৈয়দ মোদিরও। যাননি ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে। যাঁরা সৈয়দ মোদিকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা জানেন আপাদমস্তক ভদ্র, নম্র, শান্ত ওই খেলোয়াড়ের কোনও শত্রু থাকার কথা নয়। তবু কেন, কারা কেড়ে নিয়েছিলেন ২৬ বছরের চনমনে ওই তরুণের জীবন?
অভিযোগ উঠেছিল এই খুনের পেছনে রয়েছেন বিশিষ্ট রাজনীতিক সঞ্জয় সিং ও সৈয়দ মোদির স্ত্রী অমিতা। তা নিয়ে মামলা, পাল্টা মামলা চলেছিল অনেকদিন। গড়িয়েছিল সি বি আই পর্যন্ত। কিন্তু আমাদের দেশে যা হয়ে থাকে, একটা সময় সবই ধামাচাপা পড়ে যায়। ওটাও তাই হয়েছিল। তদন্তের ফল একটা ‘বিগ জিরো’। পরে একসময় সঞ্জয় সিংয়ের হাত ধরে রাজনীতিতেও চলে আসেন অমিতা। ১৯৯৫ সালে দু’জনে বিয়েটাও সেরে ফেলেন। শুধু অমিতার নয়, সঞ্জয়েরও ওটা ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। সঞ্জয়ের আগের স্ত্রী গরিমা ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংয়ের আত্মীয়া। তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবও তখন কম ছিল না। ফলে সঞ্জয়-গরিমার ডিভোর্স নিয়েও অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। তাই সঞ্জয়ের সঙ্গে অমিতার বিয়ে হতে একটু দেরিও হয়েছিল। সঞ্জয়ের সঙ্গে এ দল, ও দল করে এখনও রাজনীতিতেই আছেন অমিতা।
লখনৌর ক্রীড়ামহলে সৈয়দ মোদি ছিলেন প্রবল জনপ্রিয়। ওখানকার ক্রীড়ামহল এই হত্যাকাণ্ড সহজে মেনে নিতে চাননি। কিন্তু মেনে নিতে হয়েছিল রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবের কাছে।
সৈয়দ মেহদি হাসান জাইদি (Syed Mehdi Hassan Zaidi) এই নামটি ভারতীয় ব্যাডমিন্টন মহলে একেবারেই অপরিচিত। আসলে সৈয়দ মোদির পরিবারের দেওয়া পুরো নাম ছিল এটাই। শৈশবে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির সময় এক শিক্ষকের ভুলে ‘Mehdi’ হয়ে যায় ‘Modi’. পরে আর ওটা সংশোধন করেননি। ফলে সৈয়দ মোদি নামেই সর্বত্র পরিচিত। জন্ম উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলার সরদার নগরের (Sardarnagar) লাগোয়া কর্মা (Karma) গ্রামে, ১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সৈয়দ মোদির বাবা (Syed Meer Hassan Zaidi) কাজ করতেন সরদার নগরে একটি চিনি কারখানায়। তাঁর ৮ সন্তানের (৬ পুত্র, ২ কন্যা) মধ্যে সৈয়দ মোদি সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই সৈয়দ মোদির খেলাধুলোয় ছিল প্রবল আগ্রহ। কিন্তু ছেলের খেলাধুলোর জন্য বাড়তি টাকা খরচ করা বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মোদির খেলাধুলো নির্ভর করত দাদাদের দেওয়া টাকার ওপর।
১৪ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন মোদি। ওই বছর থেকেই এন আই এস পাতিয়ালার চিফ ব্যাডমিন্টন কোচ পি কে ভান্ডারির (Pushp Kumar Bhandari) কাছে কোচিং নিতে শুরু করেন। ১৯৮২ থেকে কোচিং নিয়েছেন ভারতের তখনকার জাতীয় কোচ দীপু ঘোষের কাছে।
১৯৮০ সালে সিনিয়র ন্যাশনালে প্রথম খেলতে নেমেই সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়ন। সেই থেকে টানা ১৯৮৭ পর্যন্ত জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মোদি। অর্জুন পুরস্কার পান ১৯৮১ সালে। আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে তাঁর সেরা সাফল্য ১৯৮২ সালে কমনওয়েলথ গেমসে সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়ন। এছাড়া সিঙ্গলসে আরও তিনটি আন্তর্জাতিক খেতাব জিতেছেন। ২ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনালে, ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে। একবার (১৯৮৫) চ্যাম্পিয়ন ইউ এস এস আর ইন্টারন্যাশনালে। ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়ান গেমসে সিঙ্গলসে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ পদক।
১৯৮৮-তে আর জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। সিনিয়র ন্যাশনালে সেবারই প্রথম হারেন। ১৯৮৭-র শেষ দিক থেকেই নিজের ফর্ম হারাতে শুরু করেছিলেন। এর কারণ ছিল দাম্পত্য জীবনের ঘোর সমস্যা।
১৯৭৮ সালে জুনিয়র ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে চিনের বেজিংয়ে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল সৈয়দ মোদির। বয়স তখন ১৬। তাঁর সমবয়সী অমিতা কুলকার্নিও (জন্ম ৪ অক্টোবর, ১৯৬২) ভারতের সেই দলে ছিলেন। ওখানেই দু’জনের ঘনিষ্ঠতার শুরু। বলা যায়, শুরু প্রেমপর্বও। একজন উত্তর ভারতের অতি সাধারণ এক মুসলিম পরিবারের ছেলে। আরেকজন মহারাষ্ট্রের এক বর্ধিষ্ণু, উচ্চ শিক্ষিত গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে। থাকেন মুম্বইয়ের অভিজাত এলাকায়। ওঁরা যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, দুই পরিবারের দিক থেকেই প্রবল আপত্তি ছিল। দুই পরিবার ও ওঁদের ঘনিষ্ঠ অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, এই বিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকবে না। দু’জনের মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন। ওই আপত্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে ১৯৮৪ সালে দু’জনে বিয়ে সেরে ফেলেন। কিন্তু বিয়ের অল্প কিছুদিন পর থেকেই দেখা দেয় নানা সমস্যা। অমিতার কার্যকলাপ, জীবনযাত্রার ধরন মেনে নিতে পারছিলেন না সৈয়দ মোদি। এর মধ্যেই লখনৌয়ে এক অনুষ্ঠানে অমিতার সঙ্গে পরিচয় হয় রাজনীতিবিদ সঞ্জয় সিংয়ের। কিছুদিন পর থেকেই অমিতা-সঞ্জয় ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না মোদি। যা নিয়ে সংসারের অশান্তি চরম আকার নেয়। যার প্রভাব পড়ে সৈয়দ মোদির খেলায়।
১৯৮৮ সালের মে মাসে অমিতা কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। ওই সন্তানের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। শোনা যায়, ঘনিষ্ঠমহলে সৈয়দ মোদি নিজেই নাকি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। সেই সময় আত্মহত্যার ভাবনাও নাকি সৈয়দ মোদির মাথায় এসেছিল। সৈয়দ মোদির মৃত্যুর পর আদালতেও সন্তানের বৈধতার প্রসঙ্গ উঠেছিল। মেয়ের নাম রাখা নিয়েও বিতর্ক ছিল। সৈয়দ মোদির সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই অমিতা মেয়ের হিন্দু নাম রেখেছিলেন ‘আকাঙ্ক্ষা’ (Aakanksha).
ভালো আছেন অমিতা। ভালো আছেন সঞ্জয়। কিন্তু ভালো নেই সৈয়দ মোদির পরিবার। ৩২ বছর পরও এই দুর্ভাগা দেশে ওই হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার পাননি ওঁর পরিবার! মেলেনি সৈয়দ মোদির পরিবারের অনেক প্রশ্নের জবাব।
No comments:
Post a Comment