করোনা আতঙ্কেও বিশ্বের একটা বড় অংশ এখন উত্তাল জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা ঘিরে। বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ চলছে। লন্ডনের রাস্তায় প্রতিবাদে সামিল কলকাতায় খেলে যাওয়া নাইজেরিয়ান ফুটবলার চিমা ওকোরির মেয়ে নেনকাও।
ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট
এবং চিমার মেয়ে
নির্মলকুমার সাহা
করোনা আতঙ্কেও বিশ্বের একটা বড় অংশ এখন উত্তাল জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা ঘিরে। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করা হয়েছে ২৫ মে। তারপর ১১ দিন কেটে গেলেও বিশ্ব জুড়ে এখনও প্রতিবাদ চলছে। যে প্রতিবাদে সামিল নামী-অনামী অনেকেই। কলকাতায় অনেকদিন ফুটবল খেলে গিয়েছেন নাইজেরিয়ার চিমা ওকোরি। তাঁর মেয়ে নেনকা ওকোরি এখন লন্ডনে থাকেন। শুক্রবার সকালে ‘এই সময়’ পড়ে জানা গেল চিমার মেয়েও জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে লন্ডনের রাস্তায় মিছিলে হাঁটছেন। ওই প্রতিবাদের ধরণটা অবশ্যই একটু অন্যরকম। নেনকার গায়ের সাদা টি শার্টে ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’-এর সেই বিখ্যাত ছবি। হাতে কালো কালিতে লেখা প্ল্যাকার্ড।
খবরটা পড়তে পড়তেই মন চলে গেল ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’-এ। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হেনস্থা হওয়া নতুন নয়। কখনও কখনও সেটা আবার বেশি করে মাথা চাড়া দেয়। তখনও আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা নানাভাবে হেনস্থা করছিলেন কালো মানুষদের। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গরা। প্রতিবাদও চলছিল আমেরিকা জুড়ে। সেই প্রতিবাদ আন্দোলনের এক সৈনিক ছিলেন নিগ্রো তরুণ টমি স্মিথ। তিনি আবার ভাল দৌড়তেনও। সেই দৌড়ের ট্র্যাকেও তাঁকে এবং তাঁর মতো কালো মানুষদের সহ্য করতে হত অনেক লাঞ্ছনা, অপমান। এরকম চলতে চলতেই এসে যায় ১৯৬৮-র মেক্সিকো অলিম্পিক। হাজার চেষ্টাতেও আমেরিকার অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্স দল থেকে বাদ দেওয়া যায়নি নিগ্রো টমি স্মিথকে। বাদ দেওয়া যায়নি আরও কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গকেও। কীভাবে বাদ দেওয়া যাবে? ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ ছাড়া আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স হয় নাকি! কালোদের বাদ দেওয়া মানেই অলিম্পিকে আমেরিকার পদকের সংখ্যা অনেক কমে যাওয়া।
অলিম্পিক দলে সুযোগ পাওয়ার পর টমি স্মিথ দুরকম প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এক, সোনা জিততেই হবে। বিশ্ববাসীর কাছে আরও একবার প্রমাণ করতে হবে, আমেরিকায় অবহেলিত কালোরাই জগতের আলো। দুই, ট্র্যাকের বাইরেও তিনি যে কালোমানুষদের হয়ে প্রতিবাদের এক ঊজ্জ্বল প্রতীক, সেটাও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে হবে।
এই দু’রকম প্রস্তুতিতেই তিনি দেশে পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন আরেক ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ অ্যাথলিট জন কার্লোসকে। টমি স্মিথের মতো তিনিও ২০০ মিটার দৌড়তেন। মেক্সিকো অলিম্পিকের জন্য আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স দলে ২০০ মিটারে টমি স্মিথের সঙ্গে তিনিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলিটদের সংগঠন ‘অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’-এর সদস্য তিনিও।
১৬ অক্টোবর ১৯৬৮। মেক্সিকো অলিম্পিকে ২০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ড গড়ে (১৯.৮৩ সেকেন্ড) সোনা জেতেন টমি স্মিথ। তিনি ভাঙেন জন কার্লোসেরই আগের বিশ্বরেকর্ড (১৯.৯২)। জন কার্লোস জেতেন ব্রোঞ্জ (২০.১০ সেকেন্ড)। অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ড গড়ে (২০.০৬ সেকেন্ড) রুপো পিটার নর্মানের। তখন অস্ট্রেলিয়ায় পিটার নর্মানের অন্য একটি পরিচয়ও ছিল। মানবাধিকার রক্ষায় যে কোনও প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতায় আন্দোলনে ছিলেন অক্লান্ত সৈনিক। ২০০ মিটার দৌড় শেষে পিটার নর্মানকে কাছে ডেকে নেন স্মিথ, কার্লোস। জানান তাঁদের পরিকল্পনার কথা। ঠিক হয় পদক নিতে বিজয়মঞ্চে এসেই তাঁরা জানাবেন প্রতিবাদ। পরিকল্পনা মতো খালি পায়ে হাতে কালো গ্লাভস পরে পদক নিতে উঠবেন স্মিথ, কার্লোস। আর পিটার নর্মান স্মিথ, কার্লোসের মতোই ‘অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’-এর ব্যাজ পরবেন। কিন্তু মঞ্চে ওঠার আগে গ্লাভস পরতে গিয়েই ধরা পড়ল একটি ভুল। অলিম্পিক ভিলেজ থেকে মাঠে আসার সময় কার্লোস কালো গ্লাভস আনতে ভুলে গিয়েছেন। এবার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেন পিটার। তিনি পরামর্শ দেন স্মিথের দুই হাতের দুটি গ্লাভস ভাগ করে পরতে। সেই মতো ডান হাতেরটা পরেন স্মিথ নিজে। আর বাঁ হাতেরটা পরেন কার্লোস। ছবি দেখলেই পরিষ্কার স্মিথ তুলে আছেন মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত। আর কার্লোস তুলে আছেন বাঁ হাত। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান যখন চলছে আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠতেই টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস কালো গ্লাভস পরা মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে ধরেন। দাঁড়িয়ে থাকেন মাথা নিচু করে। যা ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’ নামে পরিচিত। আর পিটার নর্মানের বুকে তখন ‘অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’-এর সেই ব্যাজ। অলিম্পিকের বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে এরকম প্রতিবাদ! হইচই পড়ে যায় বিশ্বজুড়ে। স্মিথ, কার্লোসকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনে আমেরিকা। নর্মানকে দেশে ফিরিয়ে না আনলেও অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক সংস্থা তাঁকে সতর্ক করে।
দেশে ফিরেও নানা সমস্যায় পড়তে হয় স্মিথ, কার্লোসকে। বেশ কয়েক বছর ওঁদের পরিবার, পরিজনদের ওপরও চলে অত্যাচার। সেই অত্যাচারের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন কার্লোসের স্ত্রী। সে এক অন্য কাহিনী। অন্য ইতিহাস।
মেক্সিকো অলিম্পিক থেকে ফিরে আমেরিকায় যখন স্মিথ, কার্লোসের জীবন নাজেহাল, তখনও অস্ট্রেলিয়ায় শোনা গিয়েছে পিটার নর্মানের প্রতিবাদী গলার আওয়াজ। স্মিথ, কার্লোসের প্রতিবাদের শরিক হওয়ার পর তিনি বেশ গর্বিতই ছিলেন। সেই ১৯৬৮ সালেই পিটার নর্মান বলেছিলেন, ‘আমি যে নীতি ও আদর্শে বিশ্বাস করি, বিশ্বের সেরা ক্রীড়াক্ষেত্রে সেই আদর্শের জন্য লড়াইয়ের শরিক হতে পেরে গর্বিত।’ পিটার নর্মান মারা যান ২০০৬ সালের ৩ অক্টোবর। জীবনাবসানের একবছর আগে ২০০৫ সালে তাঁর দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পড়লাম, তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘বছরের পর বছর কিছু মানুষের লড়াইয়ে বর্ণবৈষম্য, সামাজিক অবিচার অনেক কমেছে। এতে ভাল লাগে। কিন্তু খারাপ দিকটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এখনও তো সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ রয়েছে।’
মেক্সিকো অলিম্পিকের পরও স্মিথ, কার্লোসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল পিটার নর্মানের। তিনজনের শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৫ সালে। ১৯৬৮-র সেই প্রতিবাদের স্মরণে আমেরিকার সান জোসেতে স্মিথ, কার্লোসের মূর্তির আবরণ উন্মোচনের অনুষ্ঠানে। সেখানে পিটার নর্মান বলেছিলেন, ‘এ তো এক পরিবারের তিন সদস্যের ফের দেখা হওয়ার মতো ঘটনা।’ ওই ঘটনা নিয়ে পিটার নর্মানের ভাইপো ম্যাথু নর্মানের তৈরি করা তথ্যচিত্র ‘স্যালুট’ আলোড়ন তুলেছিল। ম্যাথুরই লেখা বই ‘দ্য পিটার নর্মান স্টোরি’। সেখানেও গুরুত্ব পেয়েছে মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই প্রতিবাদ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই টমি স্মিথের আত্মজীবনী ‘Silent Gesture’-এও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’। একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমেরিকা সম্পর্কে স্মিথের ধারণাটা এরকম, ‘যদি আমরা কোনও সাফল্য পাই, আমরা বিশ্বের খেলার মাঠে কোথাও জিতি, তখন কিছুদিনের জন্য আমাদের আমেরিকান হিসেবেই ধরা হয়। তখন আমরা ব্ল্যাক আমেরিকান নই। কিন্তু আমরা কিছু খারাপ করলে, খেলার মাঠে ব্যর্থ হলেই জোর গলায় আমাদের নিগ্রো বলা হয়। আমি কিন্তু সবসময় আমাকে কৃষ্ণাঙ্গই মনে করি। এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমি গর্বিত। শুধু আমি কেন, আমার মতো আরও অনেকেই।’
করোনা আতঙ্কেও বিশ্বের একটা বড় অংশ এখন উত্তাল জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা ঘিরে। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করা হয়েছে ২৫ মে। তারপর ১১ দিন কেটে গেলেও বিশ্ব জুড়ে এখনও প্রতিবাদ চলছে। যে প্রতিবাদে সামিল নামী-অনামী অনেকেই। কলকাতায় অনেকদিন ফুটবল খেলে গিয়েছেন নাইজেরিয়ার চিমা ওকোরি। তাঁর মেয়ে নেনকা ওকোরি এখন লন্ডনে থাকেন। শুক্রবার সকালে ‘এই সময়’ পড়ে জানা গেল চিমার মেয়েও জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে লন্ডনের রাস্তায় মিছিলে হাঁটছেন। ওই প্রতিবাদের ধরণটা অবশ্যই একটু অন্যরকম। নেনকার গায়ের সাদা টি শার্টে ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’-এর সেই বিখ্যাত ছবি। হাতে কালো কালিতে লেখা প্ল্যাকার্ড।
খবরটা পড়তে পড়তেই মন চলে গেল ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’-এ। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হেনস্থা হওয়া নতুন নয়। কখনও কখনও সেটা আবার বেশি করে মাথা চাড়া দেয়। তখনও আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা নানাভাবে হেনস্থা করছিলেন কালো মানুষদের। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গরা। প্রতিবাদও চলছিল আমেরিকা জুড়ে। সেই প্রতিবাদ আন্দোলনের এক সৈনিক ছিলেন নিগ্রো তরুণ টমি স্মিথ। তিনি আবার ভাল দৌড়তেনও। সেই দৌড়ের ট্র্যাকেও তাঁকে এবং তাঁর মতো কালো মানুষদের সহ্য করতে হত অনেক লাঞ্ছনা, অপমান। এরকম চলতে চলতেই এসে যায় ১৯৬৮-র মেক্সিকো অলিম্পিক। হাজার চেষ্টাতেও আমেরিকার অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্স দল থেকে বাদ দেওয়া যায়নি নিগ্রো টমি স্মিথকে। বাদ দেওয়া যায়নি আরও কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গকেও। কীভাবে বাদ দেওয়া যাবে? ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ ছাড়া আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স হয় নাকি! কালোদের বাদ দেওয়া মানেই অলিম্পিকে আমেরিকার পদকের সংখ্যা অনেক কমে যাওয়া।
অলিম্পিক দলে সুযোগ পাওয়ার পর টমি স্মিথ দুরকম প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এক, সোনা জিততেই হবে। বিশ্ববাসীর কাছে আরও একবার প্রমাণ করতে হবে, আমেরিকায় অবহেলিত কালোরাই জগতের আলো। দুই, ট্র্যাকের বাইরেও তিনি যে কালোমানুষদের হয়ে প্রতিবাদের এক ঊজ্জ্বল প্রতীক, সেটাও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে হবে।
এই দু’রকম প্রস্তুতিতেই তিনি দেশে পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন আরেক ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ অ্যাথলিট জন কার্লোসকে। টমি স্মিথের মতো তিনিও ২০০ মিটার দৌড়তেন। মেক্সিকো অলিম্পিকের জন্য আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স দলে ২০০ মিটারে টমি স্মিথের সঙ্গে তিনিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলিটদের সংগঠন ‘অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’-এর সদস্য তিনিও।
১৬ অক্টোবর ১৯৬৮। মেক্সিকো অলিম্পিকে ২০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ড গড়ে (১৯.৮৩ সেকেন্ড) সোনা জেতেন টমি স্মিথ। তিনি ভাঙেন জন কার্লোসেরই আগের বিশ্বরেকর্ড (১৯.৯২)। জন কার্লোস জেতেন ব্রোঞ্জ (২০.১০ সেকেন্ড)। অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ড গড়ে (২০.০৬ সেকেন্ড) রুপো পিটার নর্মানের। তখন অস্ট্রেলিয়ায় পিটার নর্মানের অন্য একটি পরিচয়ও ছিল। মানবাধিকার রক্ষায় যে কোনও প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতায় আন্দোলনে ছিলেন অক্লান্ত সৈনিক। ২০০ মিটার দৌড় শেষে পিটার নর্মানকে কাছে ডেকে নেন স্মিথ, কার্লোস। জানান তাঁদের পরিকল্পনার কথা। ঠিক হয় পদক নিতে বিজয়মঞ্চে এসেই তাঁরা জানাবেন প্রতিবাদ। পরিকল্পনা মতো খালি পায়ে হাতে কালো গ্লাভস পরে পদক নিতে উঠবেন স্মিথ, কার্লোস। আর পিটার নর্মান স্মিথ, কার্লোসের মতোই ‘অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’-এর ব্যাজ পরবেন। কিন্তু মঞ্চে ওঠার আগে গ্লাভস পরতে গিয়েই ধরা পড়ল একটি ভুল। অলিম্পিক ভিলেজ থেকে মাঠে আসার সময় কার্লোস কালো গ্লাভস আনতে ভুলে গিয়েছেন। এবার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেন পিটার। তিনি পরামর্শ দেন স্মিথের দুই হাতের দুটি গ্লাভস ভাগ করে পরতে। সেই মতো ডান হাতেরটা পরেন স্মিথ নিজে। আর বাঁ হাতেরটা পরেন কার্লোস। ছবি দেখলেই পরিষ্কার স্মিথ তুলে আছেন মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত। আর কার্লোস তুলে আছেন বাঁ হাত। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান যখন চলছে আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠতেই টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস কালো গ্লাভস পরা মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে ধরেন। দাঁড়িয়ে থাকেন মাথা নিচু করে। যা ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’ নামে পরিচিত। আর পিটার নর্মানের বুকে তখন ‘অলিম্পিক প্রজেক্ট ফর হিউম্যান রাইটস’-এর সেই ব্যাজ। অলিম্পিকের বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে এরকম প্রতিবাদ! হইচই পড়ে যায় বিশ্বজুড়ে। স্মিথ, কার্লোসকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনে আমেরিকা। নর্মানকে দেশে ফিরিয়ে না আনলেও অস্ট্রেলিয়ার অলিম্পিক সংস্থা তাঁকে সতর্ক করে।
দেশে ফিরেও নানা সমস্যায় পড়তে হয় স্মিথ, কার্লোসকে। বেশ কয়েক বছর ওঁদের পরিবার, পরিজনদের ওপরও চলে অত্যাচার। সেই অত্যাচারের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন কার্লোসের স্ত্রী। সে এক অন্য কাহিনী। অন্য ইতিহাস।
মেক্সিকো অলিম্পিক থেকে ফিরে আমেরিকায় যখন স্মিথ, কার্লোসের জীবন নাজেহাল, তখনও অস্ট্রেলিয়ায় শোনা গিয়েছে পিটার নর্মানের প্রতিবাদী গলার আওয়াজ। স্মিথ, কার্লোসের প্রতিবাদের শরিক হওয়ার পর তিনি বেশ গর্বিতই ছিলেন। সেই ১৯৬৮ সালেই পিটার নর্মান বলেছিলেন, ‘আমি যে নীতি ও আদর্শে বিশ্বাস করি, বিশ্বের সেরা ক্রীড়াক্ষেত্রে সেই আদর্শের জন্য লড়াইয়ের শরিক হতে পেরে গর্বিত।’ পিটার নর্মান মারা যান ২০০৬ সালের ৩ অক্টোবর। জীবনাবসানের একবছর আগে ২০০৫ সালে তাঁর দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে পড়লাম, তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘বছরের পর বছর কিছু মানুষের লড়াইয়ে বর্ণবৈষম্য, সামাজিক অবিচার অনেক কমেছে। এতে ভাল লাগে। কিন্তু খারাপ দিকটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এখনও তো সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ রয়েছে।’
মেক্সিকো অলিম্পিকের পরও স্মিথ, কার্লোসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল পিটার নর্মানের। তিনজনের শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৫ সালে। ১৯৬৮-র সেই প্রতিবাদের স্মরণে আমেরিকার সান জোসেতে স্মিথ, কার্লোসের মূর্তির আবরণ উন্মোচনের অনুষ্ঠানে। সেখানে পিটার নর্মান বলেছিলেন, ‘এ তো এক পরিবারের তিন সদস্যের ফের দেখা হওয়ার মতো ঘটনা।’ ওই ঘটনা নিয়ে পিটার নর্মানের ভাইপো ম্যাথু নর্মানের তৈরি করা তথ্যচিত্র ‘স্যালুট’ আলোড়ন তুলেছিল। ম্যাথুরই লেখা বই ‘দ্য পিটার নর্মান স্টোরি’। সেখানেও গুরুত্ব পেয়েছে মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই প্রতিবাদ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই টমি স্মিথের আত্মজীবনী ‘Silent Gesture’-এও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে মেক্সিকো অলিম্পিকের সেই ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’। একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমেরিকা সম্পর্কে স্মিথের ধারণাটা এরকম, ‘যদি আমরা কোনও সাফল্য পাই, আমরা বিশ্বের খেলার মাঠে কোথাও জিতি, তখন কিছুদিনের জন্য আমাদের আমেরিকান হিসেবেই ধরা হয়। তখন আমরা ব্ল্যাক আমেরিকান নই। কিন্তু আমরা কিছু খারাপ করলে, খেলার মাঠে ব্যর্থ হলেই জোর গলায় আমাদের নিগ্রো বলা হয়। আমি কিন্তু সবসময় আমাকে কৃষ্ণাঙ্গই মনে করি। এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আমি গর্বিত। শুধু আমি কেন, আমার মতো আরও অনেকেই।’
No comments:
Post a Comment