তেনজিংয়ের জন্ম শোলো খুম্বুর সা-চু গ্রামে লেখাপড়া না জানা, এক দরিদ্র শেরপা পরিবারে। বেড়ে ওঠা অবশ্য থামে গ্রামে। বাবা খাংলা লিমা, মা কিন-জোম। শুধু তেনজিংদের গ্রামে নয়, পুরো শোলো খুম্বুতেই তখন মাত্র কয়েকজন লামা ছিলেন যাঁরা লেখাপড়া জানতেন। সাধারণ মানুষদের একজনও লিখতে-পড়তে জানতেন না। কিন্তু তেনজিংয়ের মা-বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন। তাই শৈশবেই নিয়ে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ মঠে এক লামার কাছে। ছোটবেলায় তেনজিংয়ের নাম ছিল নামগিয়াল ওয়াংদি। তেনজিং লিখেছেন, ‘একবার রংপুরের এক বিখ্যাত লামার কাছে বাবা-মা আমাকে নিয়ে যান। তিনিই অনেক বই-পত্তর ঘেঁটে আমার নাম দেন তেনজিং নোরগে। তেনজিং মানে ধনবান বা ভাগ্যবান। নামটা আমার মা-বাবার খুব পছন্দ হয়েছিল।’
লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে থেকেই বাবা-মা তেনজিংকে ওই বৌদ্ধমঠে লামার কাছে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকা হয়ে ওঠেনি তেনজিংয়ের। একদিন এক বয়স্ক লামা রেগে কাঠের টুকরো দিয়ে তেনজিংয়ের মাথায় আঘাত করেন। ছুটে সোজা বাড়ি পৌঁছে যান তেনজিং। সব শুনে মা-বাবা আর ছেলেকে ওই মঠে পাঠাননি। ওখান থেকে পালিয়ে আসায় লেখাপড়া শেখার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়।
‘পালিয়ে আসা’ অবশ্য তেনজিংয়ের জীবনে ওখানেই শেষ নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া এক শেরপা গ্রামের ছোটদের নানা গল্প শোনাতেন। ওঁর কাছ থেকেই দার্জিলিং নামটা ও দার্জিলিংয়ের নানা গল্প তেনজিংয়ের প্রথম শোনা। কিন্তু কোথায় সেই দার্জিলিং? সেই শেরপাই তেনজিংকে বুঝিয়ে দেন, তাঁদের গ্রাম থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে হাঁটতে শুরু করলেই দার্জিলিংয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে। তখনই তেনজিংয়ের মাথায় ঢুকে যায় দার্জিলিং। বয়স একটু একটু করে বাড়তে শুরু করে। শুরু হয় বাড়ি থেকে পালিয়ে দার্জিলিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে কাঠমান্ডুতে চলে যাওয়া, কয়েকদিন পর আবার ফিরেও আসা। এভাবেই ১৮ বছর বয়সে পৌঁছে যাওয়া। তারপর একদিন মা-বাবাকে না জানিয়ে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। হাঁটা শুরু তেনজিংয়ের। লক্ষ্য দার্জিলিং।
গরীব শেরপারা দার্জিলিংয়ে তখন থাকতেন তুং সুং বস্তিতে। ওই শেরপাদের অধিকাংশই কুলির কাজ করতেন। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় ডিঙিয়ে ওই বস্তিতে এসেই উঠলেন তেনজিং। থাকার জায়গা হওয়ার পর খিদে মেটাতে অন্যদের সঙ্গে কুলির কাজ শুরু করে দেন তেনজিং। যে স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন, তা ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করে। তাহলে কি কুলির কাজ করেই কাটবে পুরো জীবন?
বয়স তখন ২১। পাহাড় ঘেঁষা শেরপাদের ওই বস্তিতে বসেই একদিন তেনজিং শুনতে পেলেন একদল সাহেব নাকি পাহাড়ে উঠবেন। উদ্দেশ্য পর্যবেক্ষণ। ওই সাহেবরা শেরপাদের বস্তিতে এসেছেন মালপত্তর বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কুলি খুঁজতে। তেনজি জানতে পারলেন, কুলিদের এজন্য ভাল টাকাও দেবেন সাহেবরা। এরকম অভিযান ও অভিযাত্রীদের অনেক গল্প ওই বস্তিতে বসেই শুনেছেন তেনজিং। ওখানেই আলাপ হয়েছিল এক শেরপার সঙ্গে। পরে গভীর বন্ধুত্ব। যাঁর একটা পা কাটা পড়েছিল, হারাতে হয়েছিল চোখের দৃষ্টি, এরকম অভিযাত্রীদের মালপত্তর নিয়ে পাহাড়ে উঠতে গিয়েই। পড়ে গিয়েছিলেন বরফের ঝড়ে। এ সব জানা থাকলেও পিছিয়ে এলেন না তেনজিং। সেই ১৯৩৫ সালে এরিক শিপটনের সঙ্গে কুলি হিসেবে চলে গেলেন এভারেস্ট অভিযানে।
কুলি হিসেবে সেই এভারেস্ট অভিযানের অভিজ্ঞতা কেমন হয়েছিল? আত্মজীবনীতে তেনজিং লিখেছেন, ‘সিকিম পর্বতমালার পথ ধরে এগোচ্ছিলাম আমরা। ২১০০০ ফুট উঠে দেখতে পেলাম একটি মৃতদেহ। পাশে একটি ডায়েরি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মৃত ব্যক্তির নাম উইলসন। তিনি ছিলেন একটু খ্যাপাটে। একাই এসেছিলেন এভারেস্ট জয় করতে। সবাই তাই নাম দিয়েছিলেন পাগলা সাহেব।.... ওনাকে দেখেই মনের জোর বেড়ে গিয়েছিল। কোনওরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য ছাড়াই উনি যখন ২১০০০ ফুট উঠতে পেরেছিলেন, আমিই বা তাহলে কেন পারব না আরও ওপরে উঠতে? জেদ বেড়ে গিয়েছিল।’
এরিক শিপটনের কুলি হিসেবে সেবার ২৪০০০ ফুট উঠেছিলেন তেনজিং। শিপটনের খুব পছন্দ হয়েছিল তেনজিংকে। এরপর কুলি হিসেবে তেনজিংয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। যাঁরাই এভারেস্ট অভিযানে আসেন, কুলি হিসেবে খোঁজেন তেনজিংকে। ফলে ঘনঘন আরও কিছু অভিযানে কুলি হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয় তেনজিংয়ের।
১৯৩৮ সাল। এবার পরিবর্তনের হাওয়া। একটি অভিযানে মূল দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ এসে যায় তেনজিংয়ের সামনে। উঠেছিলেন ২৬০০০ ফুট। তারপরই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে অভিযানও বন্ধ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৫১ সালে এরিক শিপটন একটি বড় দল নিয়ে নেপালের মধ্যে দিয়ে এভারেস্ট অভিযানে যান। সেবারও শিপটন সঙ্গে চেয়েছিলেন তেনজিংকে। কিন্তু তেনজিং যেতে পারেননি। কারণ আগে থেকেই তিনি চুক্তিবদ্ধ ছিলেন একটি ফরাসি দলের নন্দাদেবী অভিযানে। এর একবছর পর, ১৯৫২ সালে আবার এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার সুযোগ আসে তেনজিংয়ের সামনে। সুইৎজারল্যান্ডের এক অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসেবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে থেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তেনজিং ও রেমন্ড ল্যাম্বার্ট উঠেছিলেন ২৮২১০ ফুট। এভারেস্টের শীর্ষ থেকে একহাজার ফুটেরও কম দূরে। তেনজিং লিখেছেন, ‘ল্যাম্বার্ট আর আমি প্রায় শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলাম। যদি অক্সিজেনের যন্ত্রপাতিগুলো আর একটু উন্নত হত বা আবহাওয়া ভাল থাকত, তা হলে সেই বছরই এভারেস্ট হার মানত।’
ব্যর্থ হলেও ওই বছরই তেনজিং নোরগের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর পরের বছরই তো স্বপ্নপূরণ।
২৯ মে, ১৯৫৩। দুপুর সাড়ে ১১ টা। এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়ালেন তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি। মানুষের সেই প্রথম এভারেস্ট জয়! কিন্তু তেনজিং নোরগের কাছে ওটা ছিল ‘চোমোলাংমা জয়’। কেন? তেনজিং লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় গ্রামের উত্তর দিকের উঁচু পাহাড়গুলোর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। এভারেস্ট নামে কোনও পাহাড়ের কথা তখন জানতাম না। জানতাম চোমোলাংমা। যার মানে জগদ্ধাত্রী বা হাওয়ার দেবী। মা ওই পাহাড়টার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলত, ওই সেই পাহাড় কোনও পাখিও যাকে টপকাতে পারবে না। ওই একই কথা অন্য শেরপা শিশুদেরও বলতেন তাদের বাবা-মা।’
এভারেস্ট জয়ের সময় তেনজিং নোরগের ঠিক বয়স কত? আত্মজীবনীতে তেনজিং লিখেছেন, ‘আমার বয়সের কোনও হিসেব নেই। শোলো খুম্বুর কোনও শেরপা সন্তানেরই থাকে না। সালের কোনও হিসেব না থাকা তিব্বতী ক্যালেন্ডার ওখানে ব্যবহার করা হয়। পশুপাখির নামে ওখানে বছর চিহ্নিত হয়। ৬ বছর পুরুষ, ৬ বছর স্ত্রী প্রাণীর নামে। আমার জন্মের বছরটি চিহ্নিত ছিল খরগোশের নামে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মেলালে যা ১৯০২, ১৯১৪ কিংবা ১৯২৬ হবে। জন্ম ১৯২৬ সালে হওয়ার মতো ছোট আমি এখন নই। আবার ১৯০২ সালে জন্ম হওয়ার মতো বুড়োও নই। তাই ধরে নিতে পারি আমার জন্ম ১৯১৪ সালে।’
কিন্তু মাস? তারিখ? তেনজিং লিখেছেন, ‘বছরের কোন সময় জন্মেছিলাম, সেটা চিহ্নিত করা আরও কঠিন কাজ। আবহাওয়া ও শস্যফলনের হিসেব থেকে বলা যায়, সেটা মে মাস হতে পারে। পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে মে মাস আমার কাছে সৌভাগ্যের হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২৮ মে ল্যাম্বার্টের সঙ্গে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম এভারেস্টের চূড়ায়। আর একবছর একদিন পর তো পৌঁছে যাই এভারেস্টের শীর্ষেই। কেউ চাইলে ২৯ মে আমার জন্ম তারিখ ভাবতে পারেন।’
এভারেস্ট জয়ের আগে তেনজিং তাঁর জন্মদিন লিখতেন ১৫ মে, ১৯১৪। আর এভারেস্ট জয়ের পর তিনি সবাইকে বলতেন ২৯ মে-ই তাঁর জন্মদিন পালন করতে। আর যা আত্মজীবনীতে লিখে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তা হল তেনজিংয়ের মৃত্যুও মে মাসে। ৯ মে, ১৯৮৬। বাংলায় ২৫ বৈশাখ, ১৩৯৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে।
জেনজিংয়ের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও একজন রবীন্দ্রনাথের নাম। তিনি রবীন্দ্রনাথ মিত্র।
তেনজিংয়ের সফল এভারেস্ট অভিযানের পরোক্ষে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ মিত্রও। তিনি ছিলেন দার্জিলিংয়ের একটি ছাপাখানার মালিক। ১৯৫১ সালে তাঁর সঙ্গে তেনজিংয়ের আলাপ। ধীরে ধীরে গভীর বন্ধুত্ব। অনেক গভীর সঙ্কটের সময় তেনজিংয়ের পাশে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ মিত্র। ১৯৫৩ সালেও এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার আগে এক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তেনজিংয়ের শরীর কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না। তেনজিংয়ের স্ত্রী আং লামু এভারেস্ট অভিযানে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। ‘Man of Everest’ বইয়ে তেনজিং লিখেছেন, ‘‘সেবার এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার কথা বলতেই আং লামু চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি কি মানুষ?’ ওর মাথায় তখন নানা রকম আশঙ্কা।’’
তেনজিংও ছিলেন দোটানায়। পড়েছিলেন চিন্তায়। তেনজিং লিখেছেন, ‘এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই দেখা করলাম রবীন্দ্রনাথ মিত্রর সঙ্গে। ওই শিক্ষিত বাঙালি যুবকের সঙ্গে দুবছর হল আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে। কোনও সমস্যার মুখোমুখি হলে আমি তার সঙ্গে আলোচনা করি। তার পরামর্শ নিই।’ তেনজিংয়ের কাছে সব শুনে রবীন্দ্রনাথ মিত্র বলেছিলেন, ‘এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে যদি সত্যি কোনও বিপদ ঘটে, আমি চেষ্টা করব চাঁদা তুলে তোমার পরিবারকে সাহায্য করতে।’ এতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন তেনজিং। অনেক বুঝিয়ে স্ত্রীর অনুমতিও আদায় করে নিয়েছিলেন।
এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে যে চারটি পতাকা তেনজিং পুতে দিয়েছিলেন, তার একটি ছিল ভারতের জাতীয় পতাকা। দার্জিলিং ছাড়ার আগে যেটি তেনজিংয়ের হাতে তুলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মিত্র বলেছিলেন, ‘এটাকে ঠিক সময়ে এভারেস্টের মাথায় উড়িয়ে দিও।’
২৯ মে, ১৯৫৩। দুপুর সাড়ে ১১ টা। এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়ালেন তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি। মানুষের সেই প্রথম এভারেস্ট জয়!
তেনজিং নোরগের
কাছে ওটা ছিল
‘চোমোলাংমা জয়’
নির্মলকুমার সাহা
(এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন দেখা মানুষের শুরু ১৯০৭ সালে। শুরু হয় খোঁজখবর নেওয়া। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চাপা পড়ে যায় তোড়জোড়। যুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৯ সালে। অভিযানপ্রেমী মানুষ ফের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রথম এভারেস্ট অভিযান হয় ১৯২১ সালে। যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল হাওয়ার্ড-বেরি। ওই দলেরই সদস্য ছিলেন ড. কেলাস। মূল শিবিরে পৌঁছনোর পথেই তিনি মারা যান। এভারেস্ট অভিযানের প্রথম শহীদ তিনিই। কিন্তু ওই মৃত্যু মানুষকে অভিযানে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। বরং উৎসাহ বাড়িয়েছে। ওই উৎসাহের হাত ধরেই প্রথম অভিযানের ৩২ বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৯ মে সকাল সাড়ে ১১ টায় এভারেস্ট শীর্ষে পা রাখেন ভারতের তেনজি নোরগে এবং নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি। এভারেস্ট শীর্ষে মানুষের সেই প্রথম পা রাখা। সেই সফল এভারেস্ট অভিযানের ৬৭ বছর পূর্তিতে তেনজিং নোরগের ছোটবেলা থেকে এভারেস্ট জয় পর্যন্ত জীবনের কিছু কথা। পরের অংশ আবার পরে কখনও। রাজ্যের জঘন্য ইন্টারনেট পরিষেবার জন্য লেখাটা পোস্ট করতে দেরি হল।)
তেনজিংয়ের জন্ম শোলো খুম্বুর সা-চু গ্রামে লেখাপড়া না জানা, এক দরিদ্র শেরপা পরিবারে। বেড়ে ওঠা অবশ্য থামে গ্রামে। বাবা খাংলা লিমা, মা কিন-জোম। শুধু তেনজিংদের গ্রামে নয়, পুরো শোলো খুম্বুতেই তখন মাত্র কয়েকজন লামা ছিলেন যাঁরা লেখাপড়া জানতেন। সাধারণ মানুষদের একজনও লিখতে-পড়তে জানতেন না। কিন্তু তেনজিংয়ের মা-বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন। তাই শৈশবেই নিয়ে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ মঠে এক লামার কাছে। ছোটবেলায় তেনজিংয়ের নাম ছিল নামগিয়াল ওয়াংদি। তেনজিং লিখেছেন, ‘একবার রংপুরের এক বিখ্যাত লামার কাছে বাবা-মা আমাকে নিয়ে যান। তিনিই অনেক বই-পত্তর ঘেঁটে আমার নাম দেন তেনজিং নোরগে। তেনজিং মানে ধনবান বা ভাগ্যবান। নামটা আমার মা-বাবার খুব পছন্দ হয়েছিল।’
লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে থেকেই বাবা-মা তেনজিংকে ওই বৌদ্ধমঠে লামার কাছে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকা হয়ে ওঠেনি তেনজিংয়ের। একদিন এক বয়স্ক লামা রেগে কাঠের টুকরো দিয়ে তেনজিংয়ের মাথায় আঘাত করেন। ছুটে সোজা বাড়ি পৌঁছে যান তেনজিং। সব শুনে মা-বাবা আর ছেলেকে ওই মঠে পাঠাননি। ওখান থেকে পালিয়ে আসায় লেখাপড়া শেখার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়।
‘পালিয়ে আসা’ অবশ্য তেনজিংয়ের জীবনে ওখানেই শেষ নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া এক শেরপা গ্রামের ছোটদের নানা গল্প শোনাতেন। ওঁর কাছ থেকেই দার্জিলিং নামটা ও দার্জিলিংয়ের নানা গল্প তেনজিংয়ের প্রথম শোনা। কিন্তু কোথায় সেই দার্জিলিং? সেই শেরপাই তেনজিংকে বুঝিয়ে দেন, তাঁদের গ্রাম থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে হাঁটতে শুরু করলেই দার্জিলিংয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে। তখনই তেনজিংয়ের মাথায় ঢুকে যায় দার্জিলিং। বয়স একটু একটু করে বাড়তে শুরু করে। শুরু হয় বাড়ি থেকে পালিয়ে দার্জিলিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে কাঠমান্ডুতে চলে যাওয়া, কয়েকদিন পর আবার ফিরেও আসা। এভাবেই ১৮ বছর বয়সে পৌঁছে যাওয়া। তারপর একদিন মা-বাবাকে না জানিয়ে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। হাঁটা শুরু তেনজিংয়ের। লক্ষ্য দার্জিলিং।
গরীব শেরপারা দার্জিলিংয়ে তখন থাকতেন তুং সুং বস্তিতে। ওই শেরপাদের অধিকাংশই কুলির কাজ করতেন। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় ডিঙিয়ে ওই বস্তিতে এসেই উঠলেন তেনজিং। থাকার জায়গা হওয়ার পর খিদে মেটাতে অন্যদের সঙ্গে কুলির কাজ শুরু করে দেন তেনজিং। যে স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন, তা ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করে। তাহলে কি কুলির কাজ করেই কাটবে পুরো জীবন?
বয়স তখন ২১। পাহাড় ঘেঁষা শেরপাদের ওই বস্তিতে বসেই একদিন তেনজিং শুনতে পেলেন একদল সাহেব নাকি পাহাড়ে উঠবেন। উদ্দেশ্য পর্যবেক্ষণ। ওই সাহেবরা শেরপাদের বস্তিতে এসেছেন মালপত্তর বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কুলি খুঁজতে। তেনজি জানতে পারলেন, কুলিদের এজন্য ভাল টাকাও দেবেন সাহেবরা। এরকম অভিযান ও অভিযাত্রীদের অনেক গল্প ওই বস্তিতে বসেই শুনেছেন তেনজিং। ওখানেই আলাপ হয়েছিল এক শেরপার সঙ্গে। পরে গভীর বন্ধুত্ব। যাঁর একটা পা কাটা পড়েছিল, হারাতে হয়েছিল চোখের দৃষ্টি, এরকম অভিযাত্রীদের মালপত্তর নিয়ে পাহাড়ে উঠতে গিয়েই। পড়ে গিয়েছিলেন বরফের ঝড়ে। এ সব জানা থাকলেও পিছিয়ে এলেন না তেনজিং। সেই ১৯৩৫ সালে এরিক শিপটনের সঙ্গে কুলি হিসেবে চলে গেলেন এভারেস্ট অভিযানে।
কুলি হিসেবে সেই এভারেস্ট অভিযানের অভিজ্ঞতা কেমন হয়েছিল? আত্মজীবনীতে তেনজিং লিখেছেন, ‘সিকিম পর্বতমালার পথ ধরে এগোচ্ছিলাম আমরা। ২১০০০ ফুট উঠে দেখতে পেলাম একটি মৃতদেহ। পাশে একটি ডায়েরি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মৃত ব্যক্তির নাম উইলসন। তিনি ছিলেন একটু খ্যাপাটে। একাই এসেছিলেন এভারেস্ট জয় করতে। সবাই তাই নাম দিয়েছিলেন পাগলা সাহেব।.... ওনাকে দেখেই মনের জোর বেড়ে গিয়েছিল। কোনওরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য ছাড়াই উনি যখন ২১০০০ ফুট উঠতে পেরেছিলেন, আমিই বা তাহলে কেন পারব না আরও ওপরে উঠতে? জেদ বেড়ে গিয়েছিল।’
এরিক শিপটনের কুলি হিসেবে সেবার ২৪০০০ ফুট উঠেছিলেন তেনজিং। শিপটনের খুব পছন্দ হয়েছিল তেনজিংকে। এরপর কুলি হিসেবে তেনজিংয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। যাঁরাই এভারেস্ট অভিযানে আসেন, কুলি হিসেবে খোঁজেন তেনজিংকে। ফলে ঘনঘন আরও কিছু অভিযানে কুলি হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয় তেনজিংয়ের।
১৯৩৮ সাল। এবার পরিবর্তনের হাওয়া। একটি অভিযানে মূল দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ এসে যায় তেনজিংয়ের সামনে। উঠেছিলেন ২৬০০০ ফুট। তারপরই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে অভিযানও বন্ধ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৫১ সালে এরিক শিপটন একটি বড় দল নিয়ে নেপালের মধ্যে দিয়ে এভারেস্ট অভিযানে যান। সেবারও শিপটন সঙ্গে চেয়েছিলেন তেনজিংকে। কিন্তু তেনজিং যেতে পারেননি। কারণ আগে থেকেই তিনি চুক্তিবদ্ধ ছিলেন একটি ফরাসি দলের নন্দাদেবী অভিযানে। এর একবছর পর, ১৯৫২ সালে আবার এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার সুযোগ আসে তেনজিংয়ের সামনে। সুইৎজারল্যান্ডের এক অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসেবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে থেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তেনজিং ও রেমন্ড ল্যাম্বার্ট উঠেছিলেন ২৮২১০ ফুট। এভারেস্টের শীর্ষ থেকে একহাজার ফুটেরও কম দূরে। তেনজিং লিখেছেন, ‘ল্যাম্বার্ট আর আমি প্রায় শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলাম। যদি অক্সিজেনের যন্ত্রপাতিগুলো আর একটু উন্নত হত বা আবহাওয়া ভাল থাকত, তা হলে সেই বছরই এভারেস্ট হার মানত।’
ব্যর্থ হলেও ওই বছরই তেনজিং নোরগের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর পরের বছরই তো স্বপ্নপূরণ।
২৯ মে, ১৯৫৩। দুপুর সাড়ে ১১ টা। এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়ালেন তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি। মানুষের সেই প্রথম এভারেস্ট জয়! কিন্তু তেনজিং নোরগের কাছে ওটা ছিল ‘চোমোলাংমা জয়’। কেন? তেনজিং লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় গ্রামের উত্তর দিকের উঁচু পাহাড়গুলোর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। এভারেস্ট নামে কোনও পাহাড়ের কথা তখন জানতাম না। জানতাম চোমোলাংমা। যার মানে জগদ্ধাত্রী বা হাওয়ার দেবী। মা ওই পাহাড়টার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলত, ওই সেই পাহাড় কোনও পাখিও যাকে টপকাতে পারবে না। ওই একই কথা অন্য শেরপা শিশুদেরও বলতেন তাদের বাবা-মা।’
এভারেস্ট জয়ের সময় তেনজিং নোরগের ঠিক বয়স কত? আত্মজীবনীতে তেনজিং লিখেছেন, ‘আমার বয়সের কোনও হিসেব নেই। শোলো খুম্বুর কোনও শেরপা সন্তানেরই থাকে না। সালের কোনও হিসেব না থাকা তিব্বতী ক্যালেন্ডার ওখানে ব্যবহার করা হয়। পশুপাখির নামে ওখানে বছর চিহ্নিত হয়। ৬ বছর পুরুষ, ৬ বছর স্ত্রী প্রাণীর নামে। আমার জন্মের বছরটি চিহ্নিত ছিল খরগোশের নামে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মেলালে যা ১৯০২, ১৯১৪ কিংবা ১৯২৬ হবে। জন্ম ১৯২৬ সালে হওয়ার মতো ছোট আমি এখন নই। আবার ১৯০২ সালে জন্ম হওয়ার মতো বুড়োও নই। তাই ধরে নিতে পারি আমার জন্ম ১৯১৪ সালে।’
কিন্তু মাস? তারিখ? তেনজিং লিখেছেন, ‘বছরের কোন সময় জন্মেছিলাম, সেটা চিহ্নিত করা আরও কঠিন কাজ। আবহাওয়া ও শস্যফলনের হিসেব থেকে বলা যায়, সেটা মে মাস হতে পারে। পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে মে মাস আমার কাছে সৌভাগ্যের হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২৮ মে ল্যাম্বার্টের সঙ্গে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম এভারেস্টের চূড়ায়। আর একবছর একদিন পর তো পৌঁছে যাই এভারেস্টের শীর্ষেই। কেউ চাইলে ২৯ মে আমার জন্ম তারিখ ভাবতে পারেন।’
এভারেস্ট জয়ের আগে তেনজিং তাঁর জন্মদিন লিখতেন ১৫ মে, ১৯১৪। আর এভারেস্ট জয়ের পর তিনি সবাইকে বলতেন ২৯ মে-ই তাঁর জন্মদিন পালন করতে। আর যা আত্মজীবনীতে লিখে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তা হল তেনজিংয়ের মৃত্যুও মে মাসে। ৯ মে, ১৯৮৬। বাংলায় ২৫ বৈশাখ, ১৩৯৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে।
জেনজিংয়ের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও একজন রবীন্দ্রনাথের নাম। তিনি রবীন্দ্রনাথ মিত্র।
তেনজিংয়ের সফল এভারেস্ট অভিযানের পরোক্ষে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ মিত্রও। তিনি ছিলেন দার্জিলিংয়ের একটি ছাপাখানার মালিক। ১৯৫১ সালে তাঁর সঙ্গে তেনজিংয়ের আলাপ। ধীরে ধীরে গভীর বন্ধুত্ব। অনেক গভীর সঙ্কটের সময় তেনজিংয়ের পাশে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ মিত্র। ১৯৫৩ সালেও এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার আগে এক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তেনজিংয়ের শরীর কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না। তেনজিংয়ের স্ত্রী আং লামু এভারেস্ট অভিযানে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। ‘Man of Everest’ বইয়ে তেনজিং লিখেছেন, ‘‘সেবার এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার কথা বলতেই আং লামু চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি কি মানুষ?’ ওর মাথায় তখন নানা রকম আশঙ্কা।’’
তেনজিংও ছিলেন দোটানায়। পড়েছিলেন চিন্তায়। তেনজিং লিখেছেন, ‘এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই দেখা করলাম রবীন্দ্রনাথ মিত্রর সঙ্গে। ওই শিক্ষিত বাঙালি যুবকের সঙ্গে দুবছর হল আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে। কোনও সমস্যার মুখোমুখি হলে আমি তার সঙ্গে আলোচনা করি। তার পরামর্শ নিই।’ তেনজিংয়ের কাছে সব শুনে রবীন্দ্রনাথ মিত্র বলেছিলেন, ‘এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে যদি সত্যি কোনও বিপদ ঘটে, আমি চেষ্টা করব চাঁদা তুলে তোমার পরিবারকে সাহায্য করতে।’ এতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন তেনজিং। অনেক বুঝিয়ে স্ত্রীর অনুমতিও আদায় করে নিয়েছিলেন।
এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে যে চারটি পতাকা তেনজিং পুতে দিয়েছিলেন, তার একটি ছিল ভারতের জাতীয় পতাকা। দার্জিলিং ছাড়ার আগে যেটি তেনজিংয়ের হাতে তুলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মিত্র বলেছিলেন, ‘এটাকে ঠিক সময়ে এভারেস্টের মাথায় উড়িয়ে দিও।’