Friday, May 29, 2020

তেনজিং নোরগের কাছে ওটা ছিল ‘‌চোমোলাংমা জয়’‌


২৯ মে, ১৯৫৩। দুপুর সাড়ে ১১ টা। এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়ালেন তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি। মানুষের সেই প্রথম এভারেস্ট জয়!‌ 



তেনজিং নোরগের
কাছে ওটা ছিল
‘‌চোমোলাংমা জয়’‌ 


নির্মলকুমার সাহা 



(‌এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন দেখা মানুষের শুরু ১৯০৭ সালে। শুরু হয় খোঁজখবর নেওয়া। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চাপা পড়ে যায় তোড়জোড়। যুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৯ সালে। অভিযানপ্রেমী মানুষ ফের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রথম এভারেস্ট অভিযান হয় ১৯২১ সালে। যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল হাওয়ার্ড-‌বেরি। ওই দলেরই সদস্য ছিলেন ড.‌ কেলাস। মূল শিবিরে পৌঁছনোর পথেই তিনি মারা যান। এভারেস্ট অভিযানের প্রথম শহীদ তিনিই। কিন্তু ওই মৃত্যু মানুষকে অভিযানে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। বরং উৎসাহ বাড়িয়েছে। ওই উৎসাহের হাত ধরেই প্রথম অভিযানের ৩২ বছর পর ১৯৫৩ সালের ২৯ মে সকাল সাড়ে ১১ টায় এভারেস্ট শীর্ষে পা রাখেন ভারতের তেনজি নোরগে এবং নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি। এভারেস্ট শীর্ষে মানুষের সেই প্রথম পা রাখা। সেই সফল এভারেস্ট অভিযানের ৬৭ বছর পূর্তিতে তেনজিং নোরগের ছোটবেলা থেকে এভারেস্ট জয় পর্যন্ত জীবনের কিছু কথা। পরের অংশ আবার পরে কখনও। রাজ্যের জঘন্য ইন্টারনেট পরিষেবার জন্য লেখাটা পোস্ট করতে দেরি হল।)‌


তেনজিংয়ের জন্ম শোলো খুম্বুর সা-‌চু গ্রামে লেখাপড়া না জানা, এক দরিদ্র শেরপা পরিবারে। বেড়ে ওঠা অবশ্য থামে গ্রামে। বাবা খাংলা লিমা, মা কিন-‌জোম। শুধু তেনজিংদের গ্রামে নয়, পুরো শোলো খুম্বুতেই তখন মাত্র কয়েকজন লামা ছিলেন যাঁরা লেখাপড়া জানতেন। সাধারণ মানুষদের একজনও লিখতে-‌পড়তে জানতেন না। কিন্তু তেনজিংয়ের মা-‌বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবেন। তাই শৈশবেই নিয়ে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ মঠে এক লামার কাছে। ছোটবেলায় তেনজিংয়ের নাম ছিল নামগিয়াল ওয়াংদি। তেনজিং লিখেছেন, ‘‌একবার রংপুরের এক বিখ্যাত লামার কাছে বাবা-‌মা আমাকে নিয়ে যান। তিনিই অনেক বই-‌পত্তর ঘেঁটে আমার নাম দেন তেনজিং নোরগে। তেনজিং মানে ধনবান বা ভাগ্যবান। নামটা আমার মা-‌বাবার খুব পছন্দ হয়েছিল।’‌
লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে থেকেই বাবা-‌মা তেনজিংকে ওই বৌদ্ধমঠে লামার কাছে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে বেশিদিন থাকা হয়ে ওঠেনি তেনজিংয়ের। একদিন এক বয়স্ক লামা রেগে কাঠের টুকরো দিয়ে তেনজিংয়ের মাথায় আঘাত করেন। ছুটে সোজা বাড়ি পৌঁছে যান তেনজিং। সব শুনে মা-‌বাবা আর ছেলেকে ওই মঠে পাঠাননি। ওখান থেকে পালিয়ে আসায় লেখাপড়া শেখার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়।
‘‌পালিয়ে আসা’‌ অবশ্য তেনজিংয়ের জীবনে ওখানেই শেষ নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া এক শেরপা গ্রামের ছোটদের নানা গল্প শোনাতেন। ওঁর কাছ থেকেই দার্জিলিং নামটা ও দার্জিলিংয়ের নানা গল্প তেনজিংয়ের প্রথম শোনা। কিন্তু কোথায় সেই দার্জিলিং?‌ সেই শেরপাই তেনজিংকে বুঝিয়ে দেন, তাঁদের গ্রাম থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে হাঁটতে শুরু করলেই দার্জিলিংয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে। তখনই তেনজিংয়ের মাথায় ঢুকে যায় দার্জিলিং। বয়স একটু একটু করে বাড়তে শুরু করে। শুরু হয় বাড়ি থেকে পালিয়ে দার্জিলিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে কাঠমান্ডুতে চলে যাওয়া, কয়েকদিন পর আবার ফিরেও আসা। এভাবেই ১৮ বছর বয়সে পৌঁছে যাওয়া। তারপর একদিন মা-‌বাবাকে না জানিয়ে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া। হাঁটা শুরু তেনজিংয়ের। লক্ষ্য দার্জিলিং।
গরীব শেরপারা দার্জিলিংয়ে তখন থাকতেন তুং সুং বস্তিতে। ওই শেরপাদের অধিকাংশই কুলির কাজ করতেন। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড় ডিঙিয়ে ওই বস্তিতে এসেই উঠলেন তেনজিং। থাকার জায়গা হওয়ার পর খিদে মেটাতে অন্যদের সঙ্গে কুলির কাজ শুরু করে দেন তেনজিং। যে স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন, তা ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করে। তাহলে কি কুলির কাজ করেই কাটবে পুরো জীবন?‌
বয়স তখন ২১। পাহাড় ঘেঁষা শেরপাদের ওই বস্তিতে বসেই একদিন তেনজিং শুনতে পেলেন একদল সাহেব নাকি পাহাড়ে উঠবেন। উদ্দেশ্য পর্যবেক্ষণ। ওই সাহেবরা শেরপাদের বস্তিতে এসেছেন মালপত্তর বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কুলি খুঁজতে। তেনজি জানতে পারলেন, কুলিদের এজন্য ভাল টাকাও দেবেন সাহেবরা। এরকম অভিযান ও অভিযাত্রীদের অনেক গল্প ওই বস্তিতে বসেই শুনেছেন তেনজিং। ওখানেই আলাপ হয়েছিল এক শেরপার সঙ্গে। পরে গভীর বন্ধুত্ব। যাঁর একটা পা কাটা পড়েছিল, হারাতে হয়েছিল চোখের দৃষ্টি, এরকম অভিযাত্রীদের মালপত্তর নিয়ে পাহাড়ে উঠতে গিয়েই। পড়ে গিয়েছিলেন বরফের ঝড়ে। এ সব জানা থাকলেও পিছিয়ে এলেন না তেনজিং। সেই ১৯৩৫ সালে এরিক শিপটনের সঙ্গে কুলি হিসেবে চলে গেলেন এভারেস্ট অভিযানে।
কুলি হিসেবে সেই এভারেস্ট অভিযানের অভিজ্ঞতা কেমন হয়েছিল?‌ আত্মজীবনীতে তেনজিং লিখেছেন, ‘‌সিকিম পর্বতমালার পথ ধরে এগোচ্ছিলাম আমরা। ২১০০০ ফুট উঠে দেখতে পেলাম একটি মৃতদেহ। পাশে একটি ডায়েরি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মৃত ব্যক্তির নাম উইলসন। তিনি ছিলেন একটু খ্যাপাটে। একাই এসেছিলেন এভারেস্ট জয় করতে। সবাই তাই নাম দিয়েছিলেন পাগলা সাহেব।.‌.‌.‌.‌ ওনাকে দেখেই মনের জোর বেড়ে গিয়েছিল। কোনওরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য ছাড়াই উনি যখন ২১০০০ ফুট উঠতে পেরেছিলেন, আমিই বা তাহলে কেন পারব না আরও ওপরে উঠতে?‌ জেদ বেড়ে গিয়েছিল।’‌
এরিক শিপটনের কুলি হিসেবে সেবার ২৪০০০ ফুট উঠেছিলেন তেনজিং। শিপটনের খুব পছন্দ হয়েছিল তেনজিংকে। এরপর কুলি হিসেবে তেনজিংয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। যাঁরাই এভারেস্ট অভিযানে আসেন, কুলি হিসেবে খোঁজেন তেনজিংকে। ফলে ঘনঘন আরও কিছু অভিযানে কুলি হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয় তেনজিংয়ের।
১৯৩৮ সাল। এবার পরিবর্তনের হাওয়া। একটি অভিযানে মূল দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ এসে যায় তেনজিংয়ের সামনে। উঠেছিলেন ২৬০০০ ফুট। তারপরই তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে অভিযানও বন্ধ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৫১ সালে এরিক শিপটন একটি বড় দল নিয়ে নেপালের মধ্যে দিয়ে এভারেস্ট অভিযানে যান। সেবারও শিপটন সঙ্গে চেয়েছিলেন তেনজিংকে। কিন্তু তেনজিং যেতে পারেননি। কারণ আগে থেকেই তিনি চুক্তিবদ্ধ ছিলেন একটি ফরাসি দলের নন্দাদেবী অভিযানে। এর একবছর পর, ১৯৫২ সালে আবার এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার সুযোগ আসে তেনজিংয়ের সামনে। সুইৎজারল্যান্ডের এক অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসেবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে থেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তেনজিং ও রেমন্ড ল্যাম্বার্ট উঠেছিলেন ২৮২১০ ফুট। এভারেস্টের শীর্ষ থেকে একহাজার ফুটেরও কম দূরে। তেনজিং লিখেছেন, ‘ল্যাম্বার্ট আর আমি প্রায় শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলাম। যদি অক্সিজেনের যন্ত্রপাতিগুলো আর একটু উন্নত হত বা আবহাওয়া ভাল থাকত, তা হলে সেই বছরই এভারেস্ট হার মানত।’‌
ব্যর্থ হলেও ওই বছরই তেনজিং নোরগের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর পরের বছরই তো স্বপ্নপূরণ।
২৯ মে, ১৯৫৩। দুপুর সাড়ে ১১ টা। এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়ালেন তেনজিং নোরগে এবং এডমন্ড হিলারি। মানুষের সেই প্রথম এভারেস্ট জয়!‌ কিন্তু তেনজিং নোরগের কাছে ওটা ছিল ‘‌চোমোলাংমা জয়’‌। কেন?‌ তেনজিং লিখেছেন, ‘‌ছোটবেলায় গ্রামের উত্তর দিকের উঁচু পাহাড়গুলোর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। এভারেস্ট নামে কোনও পাহাড়ের কথা তখন জানতাম না। জানতাম চোমোলাংমা। যার মানে জগদ্ধাত্রী বা হাওয়ার দেবী। মা ওই পাহাড়টার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলত, ওই সেই পাহাড় কোনও পাখিও যাকে টপকাতে পারবে না। ওই একই কথা অন্য শেরপা শিশুদেরও বলতেন তাদের ‌বাবা-‌মা।’‌ ‌
এভারেস্ট জয়ের সময় তেনজিং নোরগের ঠিক বয়স কত?‌ আত্মজীবনীতে তেনজিং লিখেছেন, ‘‌আমার বয়সের কোনও হিসেব নেই। শোলো খুম্বুর কোনও শেরপা সন্তানেরই থাকে না। সালের কোনও হিসেব না থাকা তিব্বতী ক্যালেন্ডার ওখানে ব্যবহার করা হয়। পশুপাখির নামে ওখানে বছর চিহ্নিত হয়। ৬ বছর পুরুষ, ৬ বছর স্ত্রী প্রাণীর নামে। আমার জন্মের বছরটি চিহ্নিত ছিল খরগোশের নামে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে মেলালে যা ১৯০২, ১৯১৪ কিংবা ১৯২৬ হবে। জন্ম ১৯২৬ সালে হওয়ার মতো ছোট আমি এখন নই। আবার ১৯০২ সালে জন্ম হওয়ার মতো বুড়োও নই। তাই ধরে নিতে পারি আমার জন্ম ১৯১৪ সালে।’‌
কিন্তু মাস?‌ তারিখ?‌ তেনজিং লিখেছেন, ‘‌বছরের কোন সময় জন্মেছিলাম, সেটা চিহ্নিত করা আরও কঠিন কাজ। আবহাওয়া ও শস্যফলনের হিসেব থেকে বলা যায়, সেটা মে মাস হতে পারে। পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে মে মাস আমার কাছে সৌভাগ্যের হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২৮ মে ল্যাম্বার্টের সঙ্গে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলাম এভারেস্টের চূড়ায়। আর একবছর একদিন পর তো পৌঁছে যাই এভারেস্টের শীর্ষেই। কেউ চাইলে ২৯ মে আমার জন্ম তারিখ ভাবতে পারেন।’‌
এভারেস্ট জয়ের আগে তেনজিং তাঁর জন্মদিন লিখতেন ১৫ মে, ১৯১৪। আর এভারেস্ট জয়ের পর তিনি সবাইকে বলতেন ২৯ মে-‌ই তাঁর জন্মদিন পালন করতে। আর যা আত্মজীবনীতে লিখে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তা হল তেনজিংয়ের মৃত্যুও মে মাসে। ৯ মে, ১৯৮৬। বাংলায় ২৫ বৈশাখ, ১৩৯৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে।
জেনজিংয়ের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও একজন রবীন্দ্রনাথের নাম। তিনি রবীন্দ্রনাথ মিত্র। ‌
তেনজিংয়ের সফল এভারেস্ট অভিযানের পরোক্ষে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ মিত্রও। তিনি ছিলেন দার্জিলিংয়ের একটি ছাপাখানার মালিক। ১৯৫১ সালে তাঁর সঙ্গে তেনজিংয়ের আলাপ। ধীরে ধীরে গভীর বন্ধুত্ব। অনেক গভীর সঙ্কটের সময় তেনজিংয়ের পাশে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ মিত্র। ১৯৫৩ সালেও এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার আগে এক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তেনজিংয়ের শরীর কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না। তেনজিংয়ের স্ত্রী আং লামু এভারেস্ট অভিযানে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। ‘‌Man of Everest‌‌’‌ বইয়ে তেনজিং লিখেছেন, ‘‌‘‌সেবার এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার কথা বলতেই আং লামু চিৎকার করে ওঠে, ‘‌তুমি কি মানুষ?‌’‌ ওর মাথায় তখন নানা রকম আশঙ্কা।’‌’‌
তেনজিংও ছিলেন দোটানায়। পড়েছিলেন চিন্তায়। তেনজিং লিখেছেন, ‘‌এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই দেখা করলাম রবীন্দ্রনাথ মিত্রর সঙ্গে। ওই শিক্ষিত বাঙালি যুবকের সঙ্গে দুবছর হল আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে। কোনও সমস্যার মুখোমুখি হলে আমি তার সঙ্গে আলোচনা করি। তার পরামর্শ নিই।’‌ তেনজিংয়ের কাছে সব শুনে রবীন্দ্রনাথ মিত্র বলেছিলেন, ‘‌এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে যদি সত্যি কোনও বিপদ ঘটে, আমি চেষ্টা করব চাঁদা তুলে তোমার পরিবারকে সাহায্য করতে।’‌ এতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন তেনজিং। অনেক বুঝিয়ে স্ত্রীর অনুমতিও আদায় করে নিয়েছিলেন।
এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে যে চারটি পতাকা তেনজিং পুতে দিয়েছিলেন, তার একটি ছিল ভারতের জাতীয় পতাকা। দার্জিলিং ছাড়ার আগে যেটি তেনজিংয়ের হাতে তুলে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মিত্র বলেছিলেন, ‘‌এটাকে ঠিক সময়ে এভারেস্টের মাথায় উড়িয়ে দিও।’‌ 

Tuesday, May 26, 2020

‘‌আনলাকি’‌ নয়, ১৩ ছিল বলবীরের ‘‌লাকি নম্বর’‌



ভারতের ঘরে অলিম্পিক হকির আরেকটা পদক দেখে যেতে পারলেন না। জীবনের দৌড়েও হেরে গেলেন বলবীর সিং। ‘‌সেঞ্চুরি’‌-‌ও আর হল না।



‘‌আনলাকি’‌ নয়,
১৩ ছিল বলবীরের
‘‌লাকি নম্বর’‌


নির্মলকুমার সাহা


                   
কয়েক বছর ধরেই নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তা আবার কাটিয়ে উঠে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন ‘‌সেঞ্চুরি’‌-‌র দিকে। কিন্তু ‘‌সেঞ্চুরি’‌ আর হল না। বয়স ৯৬ বছর পূর্ণ হওয়ার কয়েকমাস আগেই সোমবার সকালে জীবনাবসান হল ভারতীয় হকির এক বর্ণময় চরিত্র বলবীর সিংয়ের।
স্বাধীনতার আগে টানা তিনটি অলিম্পিকে হকির সোনা জিতেছিল ভারত। যাতে প্রধান ভূমিকা ছিল ধ্যানচাঁদের। শেষটায় বার্লিনে তিনি ছিলেন অধিনায়ক। আর স্বাধীনতার পরে টানা তিনটি অলিম্পিকে হকিতে ভারতের সোনা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বলবীর সিং। যার শেষটায়, ১৯৫৬–য় মেলবোর্নে তিনি ছিলেন ভারতের নেতা।
ছিলেন সেন্টার ফরোয়ার্ড। সারা জীবনে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় করেছেন অজস্র গোল। তিনটি অলিম্পিকেও গোল করায় তিনি সফল। ১৯৪৮–এ লন্ডন অলিম্পিকে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক–সহ করেছিলেন ৬ গোল। ফাইনালে গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ৪–০ জেতা ম্যাচে প্রথম গোল দুটো ছিল বলবীরের। ১৯৫২–র হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের পতাকা ছিল বলবীরের হাতে। সেবারের অলিম্পিকে ভারতের ১৩ গোলের মধ্যে ৯টি এসেছিল বলবীরের স্টিক থেকে। যার পাঁচটি করেছিলেন ফাইনালে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে। যা এখনও একটি অলিম্পিক ফাইনালে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। ১৯৫৬–য় গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে করেছিলেন ৫ গোল। তারপর আহত হওয়ায় গ্রুপের বাকি ম্যাচে খেলতে পারেননি। পরে খেলেছিলেন সেমিফাইনাল ও ফাইনালে। ১৯৫৮ সালে এশিয়ান গেমসে রুপোজয়ী ভারতীয় দলেরও অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৭১–এ বিশ্বকাপে ছিলেন ভারতের কোচ। ভারত ‌তৃতীয়  হয়েছিল। একবারই ভারত বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ১৯৭৫ সালে। সেই দলের ম্যানেজার ছিলেন বলবীর।
বাবা-‌মা ছোট্টবেলাতেই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন হকি স্টিক, বল। পাড়ার মাঠে বয়সে একটু বড় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যাওয়ার পর, সাধারণত যা হয়, নতুন ও ছোট ছেলে বলে বলবীরকে সবাই জোর করেই গোলে দাঁড় করিয়ে দিত। গোলকিপার হিসেবেই বলবীরের হকি খেলা শুরু। কিন্তু বার্লিন অলিম্পিকে ধ্যানচাঁদ-‌রূপ সিংয়ের গোল-‌বন্যার পর, ১২ বছর বয়সেই পাকা সিদ্ধান্ত, আর গোলে নয়, খেলতে হবে ফরোয়ার্ডেই। করতে হবে গোল। সেই থেকে বলবীর সিং সেন্টার ফরোয়ার্ড।
১৯৫৭ সালে পান পদ্মশ্রী। খেলাধুলোয় প্রথম পদ্মশ্রী তিনিই। ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়ান গেমসে পূতাগ্নি জ্বালানোর সম্মান পেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে হকি ইন্ডিয়া দিয়েছিল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের সময় তিনি পেয়েছিলেন এক অনন্য সম্মান। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি অলিম্পিকের ইতিহাসের ১৬ জন কিংবদন্তিকে বিশেষ সম্মান জানিয়েছিল। সেই তালিকায় একমাত্র ভারতীয় ছিলেন বলবীর সিং।
হকিতে খুব সাড়া জাগানো বই, বলবীরের আত্মজীবনী ‘‌দ্য গোল্ডেন হ্যাটট্রিক’‌। যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। পরে তিনি আরও একটি বই লিখেছেন। ‘‌দ্য গোল্ডেন ইয়ার্ডস্টিক:‌ ইন কোয়েস্ট অফ হকি এক্সেলেন্স’‌ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। বলবীর সিং ও তাঁর দলের ১৯৪৮–এর লন্ডন অলিম্পিকের সোনা জয় নিয়ে হয়েছে সিনেমা ‘‌গোল্ড’‌।
তাঁর কন্যা, পুত্ররা সবাই সপরিবার কানাডায় থাকায় শেষ জীবনের অনেক বছরই বলবীরও কাটিয়েছেন ভ্যাঙ্কুয়ারে। পরে আবার ফিরে এসেছেন নিজের দেশে।
বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার ভবানীপুরে খালসা স্কুলের মাঠে দেখা হয়েছিল। বলবীর মজা করে বলেছিলেন, ‘‌আমার নামের মানে জানেন?‌ বলবীরকে দু’‌ভাগে ভেঙে ফেলুন। বল মানে শক্তি। আর বীর মানে সাহসী, দৃঢ়চেতা। আমি ওই দুটোর যোগফল।’‌
সত্যি, তিনি ছিলেন তাই। স্বাধীনতাত্তোর ভারতের হকিতে লেসলি ক্লডিয়াস, কে ডি সিং বাবু, কেশব দত্, কিষেণলাল, আর এস জেন্টলদের মাঝেও তাঁকে আলাদাকরে চিনতে অসুবিধা হত না। স্বাধীনতার আগে ধ্যানচাঁদ, আর স্বাধীনতার পরে বলবীর সিং শাসন করেছেন ভারতীয় হকি।
তিনটি অলিম্পিক সোনার মধ্যে প্রথমটাই ছিল বলবীরের কাছে বেশি স্মরণীয়। কেন?‌ তিনি এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বারবার। বলেছেন, ‘‌দেশ ভাগ ও ভারত স্বাধীন হওয়ার পর লন্ডনের সেই অলিম্পিকই ছিল প্রথম। স্বাধীন দেশ হিসেবে খেলতে গিয়েছিলাম আমরা। জানতাম সোনা জিতলে সেই প্রথম অলিম্পিকের বিজয় মঞ্চে উড়বে ভারতের তেরঙা। যা আমাদের সবাইকে আলাদাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর সেবার ফাইনালে আমাদের সামনে ছিল গ্রেট ব্রিটেন। যাদের হাত থেকে আমরা ছিনিয়ে নিয়েছিলাম স্বাধীনতা। ফাইনালে ওদের হারানোর জন্য আমাদের আলাদা তাগিদ ছিল। সেই ফাইনালটা জিততে পেরে তাই একটু বেশিই আনন্দ পেয়েছিলাম। ওই স্মৃতি কোনওদিন ভোলার নয়। ভুলতেও পারিনি।’‌
পুরনো দিনের গল্প করতে খুব ভালবাসতেন। রাজনৈতিক কারণে এখন ভারত–পাকিস্তান ক্রীড়া সম্পর্কও বেশ খারাপ জায়গায়। খেলা থেকে অবসরের অনেক পরে ১৯৭৫ সালে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন ভারতের ম্যানেজার। কুয়ালালামপুরে ফাইনালে ভারতের সামনে ছিল পাকিস্তান। খেলা ছিল ১৫ মার্চ, শনিবার। ভারতীয় দলে নানা ধর্মের খেলোয়াড়। সবাইকেই তিনি বলতেন, ‘‌তোমরা আলাদা আলাদা ধর্মে বিশ্বাসী হতেই পারো। কিন্তু মনে রেখো, এখানে খেলতে এসেছো, ভারতের হয়ে। তোমরা সবাই মাদার ইন্ডিয়ার সন্তান। ভারতের তেরঙা উঁচুতে তুলে ধরার জন্যই তোমাদের লড়তে হবে।’‌ একবার বলবীর ওই বিশ্বকাপের একটা গল্প শুনিয়েছিলেন এভাবে, ‘‌ফাইনালের আগের দিন ছিল শুক্রবার। আসলাম শের খান বলল, নমাজে যাবে। আমি, গুরচরণ ও ডাক্তার কারলা ওকে নিয়ে গেলাম ওখানকার রয়্যাল মসজিদে। শুক্রবারের সেই প্রার্থনায় আসলামের পেছনে ছিলাম আমরা তিনজন। প্রার্থনা শেষ হতেই একজন কিছু জানতে এগিয়ে এলেন আমার দিকে, আমার পাগড়ি দেখে। জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেন ওখানে?‌ আমি বললাম গুরুদওয়ারা, গীর্জা, মন্দির, মসজিদ আমরা যেখানেই যাই, ভগবান একজনই। একথা শুনে ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। বললেন, তোমাদের প্রার্থনা সফল হোক। কথা বলতে বলতেই মাথা উঁচু করে দেখি, ওঁর পেছনে পুরো পাকিস্তান দল। ওরাও এসেছিল ফাইনালের আগে প্রার্থনায়। আমরা কিন্তু ফাইনালে জিতেছিলাম।’‌
সেই চ্যাম্পিয়ন দলে ছিলেন অশোক কুমার। ফাইনালে জয়ের গোলটিও এসেছিল তাঁর স্টিক থেকেই। অনেক বছর আগে একটি গল্প শুনিয়েছিলেন অশোক কুমার, ‘‌ফাইনালে মাঠে নামার আগে ম্যানেজার বলবীর সিং খেলোয়াড়দের পকেটে একটি করে ছোট্ট কাপড়ের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ওটা পকেটে থাকলে নাকি ভাগ্য আমাদের সঙ্গে থাকবে। যাই হোক আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। তাতে ওই কাপড়ের টুকরোর কোনও ভূমিকা ছিল কিনা, তা বলতে পারব না।’‌
আক্ষরিক অর্থেই বলবীর ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। সব ধর্মের মানুষের সঙ্গেই তাঁর ছিল গভীর বন্ধুত্ব। ২০০৬ সালে একটি সংস্থা ‘‌বেস্ট শিখ হকি প্লেয়ার’‌ পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম ঘোষণা করেছিল। বলবীর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করে এভাবে কোনও পুরস্কার দেওয়া যায় না। এটা ঠিক নয়। পরে ভারতীয় হকির প্রসারের জন্য তিনি ওই পুরস্কার নিতে রাজি হয়েছিলেন। তবে উদ্যোক্তাদের বাধ্য করেছিলেন, পুরস্কারের নামে কিছু রদবদল ঘটাতে। তিনি বারবার বলেছেন, এই ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী দলীপ সিংয়ের কাছ থেকে।
এখন বন্ধ থাকলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হকি টেস্ট সিরিজ প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। কিন্তু দু’‌দেশের মধ্যে নিয়মিত হকি সিরিজ চালুর প্রয়োজনীয়তা তার অনেক আগেই বলবীর উপলব্ধি করেছিলেন। প্রস্তাবও দিয়েছিলেন হকি ফেডারেশন ও সরকারের কাছে। তাতে কোনও লাভ হয়নি। তিনি তখন পাঞ্জাব পুলিশে উচ্চপদে চাকরি করেন। খেলোয়াড়জীবনে একেবারে মধ্যগগনে। জাতীয় দলের সফর বিনিময়ের ব্যবস্থা করতে পারেননি। কিন্তু ১৯৫৩ সালে দুই দেশের দুই পাঞ্জাবের পুলিশ দলের মধ্যে খেলার আয়োজন করতে পেরেছিলেন। প্রথমে পশ্চিম পাঞ্জাবের পুলিশ দল এসেছিল এপারে। পরে এপারের পাঞ্জাব পুলিশ দল গিয়েছিল ওপারে। যে দলের অধিনায়ক ছিলেন বলবীর। এতটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ ছিল যে সেই সফরে খেলোয়াড়দের স্ত্রীরাও সঙ্গী হয়েছিলেন।
প্রচলিত আছে ‘‌আনলাকি থার্টিন’‌। বলবীর বলতেন, ‘‌আমার কাছে থার্টিন লাকি।’‌ আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া হকিতে তিনি অধিকাংশ সময়ই খেলেছেন ১৩ নম্বর জার্সি গায়ে। আত্মজীবনী ‘‌দ্য গোল্ডেন হ্যাটট্রিক’‌-‌এ তো '13: My Lucky Number' ‌‌শিরোনামে সাড়ে এগারো পাতার একটি অধ্যায়ই লিখে ফেলেছেন। ওই অধ্যায়টির একেবারে শেষ পর্বে তিনি লিখেছেন, তাঁর বাড়ির নম্বর ১৫৩৪, অফিসের নম্বর ৫৬২, ব্যক্তিগত গাড়ির নম্বর ৩১৬৩, অফিসের গাড়ির নম্বর ২৯০২। পাশাপাশি যোগ করলে প্রতিটির ফলই ১৩। একবার অফিসের সিনিয়রিটি নিয়ে মামলা হয়েছিল। বলবীর লিখেছেন, সেই মামলাটাও চলেছিল ১৩ নম্বর কোর্টে। শেষ করেছেন এভাবে, ‘‌কে বলেছেন, ১৩ আনলাকি নম্বর!‌’‌
বলবীরের সঙ্গে ফোনে শেষ কথা বলেছিলাম, প্রায় ৪ বছর আগে ২০১৬ সালের ২১ জুলাই। সামনে তখন রিও অলিম্পিক। ভারতের, বিশেষ করে হকি দলের অলিম্পিকে সম্ভাবনা নিয়ে কথা হয়েছিল। আশার কথা কিছু শোনাতে পারেননি। বরং কথাবার্তায় স্পষ্ট ছিল হতাশা। বলেছিলেন, ‘‌স্বাধীনতার ৬৯ বছর পরও ভারতে ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। আমরা চ্যাম্পিয়ন গড়তে জানি না। কেউ নিজের চেষ্টায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে এলে তাকে নিয়ে লাফালাফি করতে জানি। এটা কোনও ক্রীড়া সংস্কৃতি নয়। অলিম্পিকে দু-‌চারটে রুপো-‌ব্রোঞ্জ জিতেই লাফালাফি শুরু করে দিই। এত বড় দেশের পক্ষে এটা কোনও সাফল্যই নয়। এদেশে সত্যিকারের ক্রীড়া সংস্কৃতি থাকলে অলিম্পিকে আমাদের ফল অনেক ভাল হত।’‌
নিজের খেলা হকি নিয়ে বলেছিলেন, ‘‌অলিম্পিকে আটবারের সোনাজয়ী, এই ইতিহাসে চোখ ফেলেই আমরা এখন তৃপ্তি পাই। ওই আটটাকে কীভাবে নয় করা যায়, সেই পরিকল্পনা আমাদের নেই। তা যদি থাকত, তাহলে ৩৬ বছর ধরে সোনা তো দূরের ব্যাপার, অলিম্পিকের একটা রুপো বা ব্রোঞ্জের জন্য হা-‌হুতাশ করতে হত না।’‌
কথাবার্তা শেষ করেছিলেন এভাবে, ‘‌মৃত্যুর আগে ভারতের ঘরে অলিম্পিক হকির আরেকটা পদক দেখে যেতে চাই। সেই পদকটা সোনা হলে খুবই ভাল। এখন আমার আরও একটা ইচ্ছা, এতটা যখন চলে এসেছি, জীবনের দৌড়ে সেঞ্চুরিটা করে ফেলা।’‌
তাঁর ইচ্ছাপূরণ হল না। ভারতের ঘরে অলিম্পিক হকির আরেকটা পদক দেখে যেতে পারলেন না। জীবনের দৌড়েও হেরে গেলেন বলবীর সিং। ‘‌সেঞ্চুরি’‌-‌ও ‌আর হল না। 

জন্ম:‌ ১০ অক্টোবর ১৯২৪। 
মৃত্যু:‌ ২৫ মে ২০২০।  

Tuesday, May 19, 2020

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের হাতে খুন অলিম্পিক অধিনায়ক!‌



ভারতীয় অলিম্পিক হকি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক পৃথ্বীপাল সিং। ১৯৮৩ সালের ২০ মে সকালে লুধিয়ানায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই খুব কাছ থেকে আততায়ীরা গুলি করে তাঁকে। প্রথম বুলেটটি সরাসরি ঢুকে যায় মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যান ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাক। আততায়ীরা পালানোর সময় আরও একবার গুলি করে। 




বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে
ছাত্রদের হাতে খুন
অলিম্পিক অধিনায়ক!‌


নির্মলকুমার সাহা

‌‌‌‌‌‌
পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ বিভাগের প্রধান তখন ভারতীয় অলিম্পিক হকি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক পৃথ্বীপাল সিং। ১৯৮৩ সালের ২০ মে সকালে লুধিয়ানায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই প্রশাসনিক ব্লকের বাইরে নিজের মোটর বাইক পার্কিংয়ে রাখছিলেন। সেই সময়ই খুব কাছ থেকে আততায়ীরা গুলি করে পৃথ্বীপালকে। প্রথমে বুলেটটি সরাসরি ঢুকে যায় মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে যান ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাক। আততায়ীরা পালানোর সময় আরও একবার গুলি করে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তারদের কিছু আর করার ছিল না।তার আগেই মারা গিয়েছিলেন ভারতীয় হকির এক বর্ণময় চরিত্র।
পৃথ্বীপালের হত্যাকারীরা সবাই ছিল তরুণ। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পৃথ্বীপাল খুন হওয়ার একমাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে হিংসাত্মক কিছু ঘটনায় গুলি চলে। নিহত হয় এক ছাত্র। পাঞ্জাবের রাজ্যপাল এ পি শর্মা ওই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন। গঠিত হয় তদন্ত কমিশন। পৃথ্বীপালের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল ওই তদন্ত কমিশনে। সেই সাক্ষ্য আর দিয়ে উঠতে পারেননি। তার আগেই খুন হতে হয় তাঁকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’‌দল ছাত্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছিল। ওই বিবাদেরই করুণ পরিণতি এক গোষ্ঠীর ছাত্রদের হাতে অলিম্পিক অধিনায়ক পৃথ্বীপাল সিং খুন।
পৃথ্বীপালের জন্ম ১৯৩২ সালের ২৮ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতের নানকানা সাহিবে (যা এখন পাকিস্তানে)‌। ভারত ভাগের পর ওঁদের পরিবার চলে আসে এপারের পাঞ্জাবে। পৃথ্বীপালের বাবা সর্দার ওয়াধাওয়া সিং চণ্ডী ছিলেন স্কুল শিক্ষক। পাশাপাশি কৃষি বিশেষজ্ঞও। পৃথ্বীপাল শৈশব থেকেই লেখাপড়ায় ছিলেন ভাল ছাত্র। ১৯৫৬ সালে এম এস সি (‌এগ্রিকালচার)‌ পাশ‌ করেন লুধিয়ানার এগ্রিকালচার কলেজ থেকে। পরে ওটা মিশে যায় পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে, যেখানে তিনি খুন হন।
১৯৫৭ সালে বোম্বাইয়ে জাতীয় হকিতে পাঞ্জাবের হয়ে খেলতে নেমেই সবার নজর কাড়েন। পরের বছরই ভারতীয় হকি ফেডারেশন একাদশের হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলেন। ১৯৫৯-‌এর গোড়ায় পূর্ব আফ্রিকা সফর। সেই থেকে ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য। তখন থেকেই তাঁর অসম্ভব জোরে নেওয়া পেনাল্টি কর্নার হিট বিপক্ষের কাছে ত্রাস হয়ে ওঠে। ভারতের হয়ে খেলেছেন তিনটি অলিম্পিকে ১৯৬০, ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে। প্রথমবার রোমে জিতেছিলেন রুপো। মাঝে ১৯৬৪ সালে টোকিওতে সোনা। ১৯৬৮ সালে মেক্সিকো অলিম্পিকে গুরবক্স সিংয়ের সঙ্গে ছিলেন ভারতের যুগ্ম অধিনায়ক। মেক্সিকোয় ভারত জিতেছিল ব্রোঞ্জ পদক। রোমে ৫, টোকিওয় ১০ ও মেক্সিকোয় ৭ গোল করেছিলেন। রোমে ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ১-‌০ গোলে হেরে অলিম্পিক হকির সোনা হাতছাড়া করেছিল ভারত। ৪ বছর পর টোকিওয় সেই সোনা পুনরুদ্ধার ফাইনালে পাকিস্তানকে ১-‌০ গোলে হারিয়েই। দু’‌বার অলিম্পিক ফাইনাল খেলেছেন। সারা জীবনে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পেনাল্টি কর্নার থেকে অজস্র গোল করেছেন। কিন্তু অলিম্পিক ফাইনালে তাঁর কোনও গোল নেই। তবে টোকিওয় জয়ের গোলের পথটা গড়ে দিয়েছিলেন তিনিই। পৃথ্বীপালের নেওয়া পেনাল্টি কর্নার হিট গোলে ঢোকার মুখে পা দিয়ে আটকান পাকিস্তানের এক খেলোয়াড়। পেনাল্টি স্ট্রোক পায় ভারত। তা থেকে গোল করেন মোহিন্দার লাল। এশিয়ান গেমসে খেলেছেন ২ বার। ১৯৬২ সালে জাকার্তায় ভারত জিতেছিল রুপো, ১৯৬৬ সালে ব্যাঙ্ককে সোনা। মেক্সিকো অলিম্পিকের পরই অবসর নেন। পরে জাতীয় নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান হন।
হকি খেলোয়াড়দের মধ্যে পৃথ্বীপালই প্রথম অর্জুন পুরস্কার পান ১৯৬১ সালে। পদ্মশ্রী ১৯৬৭ সালে। পাঞ্জাবের জারখর স্টেডিয়ামে ২০০৯ সালে তাঁর মূর্তি বসেছে।
চাকরি জীবন শুরু পাঞ্জাব পুলিশে, ১৯৫৬ সালে। কিন্তু বেশি দিন সেখানে ছিলেন না। ভারতীয় হকির গোষ্ঠী রাজনীতির জন্য ১৯৬৩ সালে ওই চাকরি ছেড়ে যোগ দেন রেলওয়েজে। ২ বছরেরে মধ্যেই রেলের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে রেলওয়ে মিনিস্টার’‌স মেডেল পান। রেলের সেই চাকরিও একসময় ছেড়ে দেন। ১৯৬৮ সালে যোগ দেন লুধিয়ানায় পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে একই সঙ্গে সামলাতেন দুটো দায়িত্ব। ডিরেক্টর অফ স্পোর্টস এবং ডিরেক্টর অফ স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত ওই দুটো দায়িত্বই সামলেছেন।
আর্ম রেসলিংয়ের কোনও প্রতিযোগিতায় পৃথ্বীপাল কখনও নেমেছেন, এরকম তথ্য নেই। কিন্তু জোরালো পেনাল্টি কর্নার হিট নেওয়ার জন্য কবজির জোর ও দ্রুত মোচড় খুব দরকার হত। সেটা কাজে লাগিয়ে, তিনি যখন পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত, ছাত্রদের সঙ্গে আর্ম রেসলিংয়ে মেতে উঠতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিক্রিয়েশন রুমে সেই লড়াইয়ের বেশিরভাগই জিততেন পৃথ্বীপাল। বিখ্যাত Computer Scientist Jay Ranade নিউ ইয়র্কের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ওঠার আগে অনেকটা সময়ই কাটিয়ে গিয়েছেন পাঞ্জাবের লুধিয়ানায়। তাঁর জন্মও ওই শহরে। রানাডের আরেকটা পরিচয় তিনি আর্ম রেসলিংয়ে চারবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ২ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মার্শাল আর্টসে। উচ্চ পর্যায়ের না হলেও আরও আগে ভারোত্তোলন করতেন। লুধিয়ানায় থাকার সময় পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিক্রিয়েশন রুমে পৃথ্বীপাল সিংয়ের কাছেই রানাডের আর্ম রেসলিংয়ে হাতেখড়ি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওখানে কাটিয়ে পৃথ্বীপালের কাছ থেকে কবজির জোর বাড়ানোর উপায় জেনে নিতেন।

জন্ম:‌ ২৮ জানুয়ারি ১৯৩২।
মৃত্যু:‌ ২০ মে ১৯৮৩।‌‌‌‌‌‌‌‌‌

জয়পাল ছিলেন আদিবাসীদের অন্যতম কণ্ঠস্বর



ভারতের সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশিল তৈরিতে জয়পালের বিশেষ অবদান ছিল। ছিলেন অসামান্য বক্তা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনিকে‌ বিয়ে করলেও সেই পরিবারের রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন।



জয়পাল ছিলেন
আদিবাসীদের
অন্যতম কণ্ঠস্বর


নির্মলকুমার সাহা


১৯২৬ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ভারতীয় আর্মি হকি দল। সেই দলের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই ১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত। ইংল্যান্ডে পড়তে বা অন্য কাজে যাওয়া অনেক ভারতীয়ই তখন হকি খেলতেন। তাঁদের খোঁজখবর নেওয়াও শুরু। জয়পাল সিং মুন্ডা তখন অক্সফোর্ডের ছাত্র। ফুলব্যাক হিসেবে দুর্দান্ত ফর্মে। শুধু ব্রিটেনে নয়, ইউরোপের নানা দেশেও ছাত্র দলের হয়ে খেলতে গিয়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন। ভারতের হকি কর্তারা যোগাযোগ করেছিলেন জয়পালের সঙ্গেও। তিনি অলিম্পিকে খেলতে আগ্রহী থাকলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন ভারতে এসে ট্রায়াল দিতে পারবেন না। কলকাতায় সেবছর আন্তঃ প্রাদেশিক হকি প্রতিযোগিতার পর তিনটে ট্রায়াল ম্যাচ হয়। সেই আন্তঃ প্রাদেশিক হকি প্রতিযোগিতা এবং ট্রায়াল ম্যাচে অংশ নেননি জয়পাল। কিন্তু তাঁকে এবং আরও দু’‌জনকে বিনা ট্রায়ালেই ভারতীয় দলে রাখা হয়েছিল। ওই ২ জন হলেন এস এম ইউসুফ এবং পতৌদি নবাব (‌সিনিয়র)‌। ভারতের হয়ে অলিম্পিকে খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাঁকে অবশ্য জীবনে একটা বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। জয়পাল তখন অক্সফোর্ডে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের (‌আই সি এস)‌ শিক্ষানবিস। তখনকার নিয়মানুযায়ী আই সি এস হওয়ার জন্য অক্সফোর্ডে দু’‌বছরের ট্রেনিং দরকার ছিল। ভারতের হয়ে খেলার জন্য অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ জয়পালকে ছুটি দিতে রাজি ছিলেন না। পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, আই এ এস এবং অলিম্পিকের মধ্যে যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে। জয়পাল দেশের হয়ে অলিম্পিকে খেলাটাই বেছে নিয়েছিলেন। তাই আই এ এস হওয়া আর হয়ে ওঠেনি।
ভারতের প্রথম অলিম্পিক হকি দল গড়া নিয়ে বিশেষ সমস্যা বা বিতর্ক ছিল না। কিন্তু অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে অনেক নাটক, অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। ‘‌অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’‌ নাকি ‘‌নেটিভ ইন্ডিয়ান’‌ ?‌ অধিনায়ক বাছার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য একেবারে আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি জয়পাল সিং মুন্ডাকে অধিনায়ক করা হয়েছিল। কিন্তু টানা পাঁচটি ম্যাচ জিতে, কোনও গোল না খেয়ে ভারত সোনা জিতলেও বিজয়মঞ্চে ওঠা হয়ে ওঠেনি অধিনায়ক জয়পালের। ফাইনালের আগেই তিনি আমস্টারডাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। ভারতীয় দলে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়দের ব্যবহার তাঁর ভালো লাগেনি। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়রা কখনও জয়পালকে অধিনায়ক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে নানা ভাবে অসহযোগিতাও করেছিলেন। ফলে বিরক্ত হয়ে আমস্টারডাম ছেড়েছিলেন জয়পাল। তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এরিক পিন্নিগার। অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দলের অভিযান শুরুর আগে অবশ্য অধিনায়ক হিসেবে তিনি একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। আমস্টারডামে অলিম্পিকে খেলতে যাওয়ার পথে ভারতীয় দল প্রথমে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে, কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে। তখন এখনকার মতো বিমান যাত্রা ছিল না। জাতীয় দল যেত জাহাজেই। ভারত থেকে জাহাজে লন্ডনের কাছাকাছি টিলবুরি বন্দরে গিয়ে নেমেছিল ভারতীয় দল। সেখানে আরও অনেকের সঙ্গে ভারতীয় খেলোয়াড়দের স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন অধিনায়ক জয়পালও। 
সেই যুগের সেরা ফুলব্যাক জয়পালের ওটাই ছিল প্রথম ও শেষ অলিম্পিক। কিন্তু ভারতীয় হকির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শেষ করে ১৯৩০ সালে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। চলে এসেছিলেন কলকাতায় মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে খেলতে। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪, মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। ছিলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক। মোহনবাগানে খেলতে খেলতে ১৯৩২ সালে অল্প কিছুদিনের জন্য বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনের (‌বি এইচ এ)‌ সচিবও হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশনেও ছিলেন বি এইচ এ-‌র প্রতিনিধি। ওই ১৯৩২সালেই কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তঃ প্রাদেশিক হকি প্রতিযোগিতায় বাংলা দলে জয়পাল না থাকায় বিস্মিত হয়েছিলেন হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ। পরে তিনি আত্মজীবনী ‘‌গোল’‌-‌এ লিখেছেন, ‘‌বাংলা দল নিয়ে আমার অসন্তোষ ছিল। জয়পাল তখন অক্সফোর্ড থেকে ফিরে কলকাতাতেই। মোহনবাগানের অধিনায়ক। বাংলার লেফট ব্যাক ছিল ব্রেনডিস। জয়পালের চেয়ে সে ভালো, এটা কেউ মানবেন না। কেন জয়পাল সেবার বাংলা দলে ছিল না, এটা আমার কাছে কোনও রহস্য ছিল না। বাংলার হকির খোঁজখবর রাখতাম। জানতাম, রাজনীতিটা কোথায়!‌’‌ তবে ১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দল পাঠানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জয়পাল। তাঁর উদ্যোগেই সেবছর অলিম্পিকে হকি দল পাঠানোর আর্থিক দায়িত্ব অনেকটাই নিয়েছিল বি এইচ এ।
জয়পাল সিংয়ের রাজনৈতিক জীবনও ছিল খুবই ঊজ্জ্বল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি ছিলেন শিক্ষাবিদ।
শুধু অলিম্পিক হকিতে ভারতের প্রথম সোনাজয়ী অধিনায়কই ছিলেন না। জয়পাল সিং মুন্ডা হয়ে উঠেছিলেন এদেশের আদিবাসীদের অন্যতম কণ্ঠস্বর। নির্বাচিত হয়েছিলেন সংবিধান পরিষদে। এই পরিষদই রচনা করেছিল ভারতের সংবিধান। সেই সুবাদে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশিল তৈরিতে জয়পালের বিশেষ অবদান ছিল। ছিলেন অসামান্য বক্তা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনিকে (‌তারা মজুমদার)‌ বিয়ে করলেও সেই পরিবারের রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। কংগ্রেসি রাজনীতির চক্ষুশূল হয়েও তিনি তৈরি করেছিলেন আদিবাসীদের জন্য ঝাড়খন্ড পার্টি। যে পার্টি ভবিষ্যতে আদিবাসীদের নিজস্ব দাবিদাওয়া জাতীয় পরিসরে তুলে ধরবে। এই কারণেই বলা হয়ে থাকে যে ইতিহাসের গর্ভ থেকে পৃথক রাজ্য ঝাড়খন্ডের জন্ম সম্ভব করেছিলেন জয়পাল। ১৯৪৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর সংবিধান পরিষদে প্রথমবার বক্তৃতা দেওয়ার অবকাশে জয়পাল নিজেকে ‘‌জংলি’‌ হিসেবে অবিহিত করে নিজের আদিবাসী পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, আদিবাসীরাই ভারতের আদিতম সন্তান। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচিতির জন্য তিনি কোনওভাবেই হীনমন্য নন।
ভারতের খেলাধুলো ও রাজনীতির এই ঊজ্জ্বল নক্ষত্রের শৈশবের নাম কিন্তু জয়পাল সিং মুন্ডা নয়। জন্মের পর পরিবারের লোকেরা নাম রেখেছিলেন প্রমোদ পাহান। জয়পালের বাবা আম্রু পাহান। মা রাধামুনি। জন্ম তখনকার বিহারের খুঁটির টাকরা গ্রামের পাহানটোলিতে। গ্রামের পাঠশালায় প্রথমে ভর্তি হলেও ৮ বছর বয়সে জয়পালের বাবা আম্রু পাহান ১৯১১ সালের ৩ জানুয়ারি তাঁর ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাঁচির সেন্ট পলস স্কুলে। সেখানকার প্রিন্সিপালের পরামর্শে স্কুলের খাতায় নাম লেখা হয়েছিল জয়পাল সিং মুন্ডা। সেই থেকেই তিনি ওই নামে পরিচিত। আর জন্মদিন?‌ আম্রু পাহান জানতেন না, স্কুলে ভর্তির জন্য জন্ম তারিখ দরকার হবে। তিনি ছেলের জন্মদিন কবে, তাও জানতেন না। মা রাধামুনি শুধু বলেছিলেন ৮ বছর আগে শীতকালে ছেলের জন্ম। কী আর করবেন, বয়স ৮ বছর শুনে স্কুলের ভর্তির খাতায় জন্মদিন লিখে নিয়েছিলেন ১৯০৩ সালের ৩ জানুয়ারি। সেই থেকে নাম জয়পাল সিং মুন্ডা। জন্ম তারিখও ৩ জানুয়ারি ১৯০৩।
সেন্ট পলস স্কুলের শিক্ষকদের উদ্যোগেই রাঁচি থেকে ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলেন জয়পাল। প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ওখানকার স্কুলে। স্কুল ও কলেজের পর্ব চুকিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তিনি ছিলেন ভারতীয় ছাত্রদের ডিবেটিং সোসাইটি অক্সফোর্ড মজলিসের সদস্য। টাকরা গ্রামে বা রাঁচিতে থাকার সময় খেলতেন সখের হকি। কিন্তু ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর নিয়মিত হকি খেলা শুরু করেন। ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির হকি দলের অধিনায়ক। ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে হকি দল গড়ে এই সময় ইউরোপের নানা দেশে খেলতেও গিয়েছেন।
ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় আসার পর চাকরি করতেন বার্মা-‌শেলে। ওই সময়ই বিয়ে করেছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনিকে (‌তারা মজুমদার)। ১২ বছর পর বিচ্ছেদ। পরে ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বিয়ে জাহা আরা জয়রতনমকে। বার্মা-‌শেলের সেই চাকরি অবশ্য বেশিদিন করেননি। এরপর করেছেন শিক্ষকতা। কিছুদিনের জন্য ঘানার এক কলেজেও পড়াতে গিয়েছিলেন। ওখান থেকে ফিরে মধ্যপ্রদেশের রাইপুরের রাজকুমার কলেজের প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপাল ও পরে প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও বেশিদিন থাকেননি। এরপরই ঢুকে পড়েছিলেন পুরোপুরি স্বাধীনতা আন্দোলনে, রাজনীতিতে। ১৯৩৮ সালে জয়পাল ও আরও কয়েকজনের উদ্যোগে আদিবাসী মহাসভার প্রতিষ্ঠা। শুরু থেকেই জয়পালই ছিলেন ওই পার্টির প্রধান। পরে ভারত স্বাধীন হলে আদিবাসী সমাজের উন্নয়নের জন্য আরও বড় আন্দোলনের তাগিদে ১৯৪৯ সালে আদিবাসী মহসভার অবলুপ্তি ঘটিয়ে তৈরি হয়েছিল ঝাড়খন্ড পার্টি। সেই পার্টিরও সভাপতি হয়েছিলেন জয়পাল। খুঁটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে ঝাড়খন্ড পার্টির টিকিটে টানা তিনবার (‌১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২)‌ সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ঝাড়খন্ড পার্টির একাংশ মিশে গিয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে। আদিবাসীদের বৃহত্তর স্বার্থে জয়পালও হেঁটেছিলেন সেই পথে। ফলে ১৯৬৭-‌র লোকসভা নির্বাচনে তিনি লড়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীকে। জিতেওছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশের শুরু থেকেই জয়পাল বিহার ভেঙে আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবি জানিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তা সম্ভব হয়নি। তবে আজীবন ওই লড়াইটা জারি রেখেছিলেন। বিহার ভেঙে তাঁর স্বপ্নের আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্য তৈরি হয় ২০০০ সালের ১৫ নভেম্বর। কিন্তু এর অনেক আগেই সাংসদ থাকাকালীনই ১৯৭০ সালের ২০ মার্চ তাঁর জীবনাবসান হয় দিল্লিতে।

জন্ম:‌ ৩ জানুয়ারি ১৯০৩।
মৃত্যু:‌ ২০ মার্চ ১৯৭০। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌

Saturday, May 16, 2020

আর্থিক অনটন!‌ উন্মাদ!‌ আধুনিক দাবার জনকের শেষ জীবনটা ভাল কাটেনি


‌উইলহেম স্টেইনিৎজ শুধু প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নন, দাবার একজন গ্রেট গবেষকও। স্টেইনিৎজের সময় থেকেই দাবার আধুনিক যুগ শুরু।



আর্থিক অনটন!‌ উন্মাদ!‌
আধুনিক দাবার জনকের
শেষ জীবনটা ভাল কাটেনি


নির্মলকুমার সাহা


এখন তিন-‌সাড়ে তিন বছর বয়সেও দাবা বোর্ডের সামনে বসে পড়ছে শিশুরা। শুধু ঘুঁটি নাড়াচাড়াই নয়, ওই বয়সেই খেলছে প্রতিযোগিতায়ও। কিন্তু তিনি দাবা শুরু করেছিলেন ১২ বছর বয়সে, এখন যে বয়সে অনেকে পৌঁছে যাচ্ছে গ্র‌্যান্ড মাস্টার হওয়ার দরজায়। এত ‘‌দেরি’-‌তে দাবা খেলা শুরু করে অবশ্য তাঁর বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি। দাবা ইতিহাসের পাতায় ঊজ্জ্বল হয়েই আছেন উইলহেম স্টেইনিৎজ। তিনিই দাবার প্রথম সরকারি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ১২ বছর বয়সে দাবা শুরু করলেও গুরুত্ব দেওয়া শুরু আরও অনেক পরে। জন্মস্থান (‌জন্ম ১৭ মে, ১৮৩৬)‌ প্রাগ ছেড়ে লেখাপড়ার জন্য ভিয়েনায় এসেই তিনি দাবা খেলাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। বয়স তখন ২০ পেরিয়ে গিয়েছে। অঙ্কের ভাল ছাত্র ছিলেন স্টেইনিৎজ। ম্যাথমেটিক্স নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্যই তাঁর ভিয়েনায় যাওয়া। কিন্তু অঙ্ক নয়, সেখানে গিয়ে বেশি মেতে ওঠেন দাবা নিয়ে। ১৮৫৯ সালে ভিয়েনা চেস চ্যাম্পিয়নশিপে তৃতীয় হন। ১৮৬১-‌তে চ্যাম্পিয়ন। ৩১ খেলায় ৩০ পয়েন্ট। তখনই তাঁকে ‘‌দ্য অস্ট্রিয়ান মরফি’‌ নামে ডাকা শুরু। ১৮৬২ সালে অস্ট্রিয়া দলের হয়ে লন্ডনে খেলতে যান। সেখানে তাঁর খেলা উচ্চ প্রশংসিত হয়। এবং তিনি পেশাদার দাবা খেলোয়াড় হয়ে থেকে যান সেখানেই। দাবা ইতিহাসে তিনিই প্রথম ঘোষিত পেশাদার খেলোয়াড়। তারপর অ্যাপিয়ারেন্স মানি ছাড়া তিনি কখনও কোথাও খেলেননি। উইলহেম স্টেইনিৎজকে বলা হয় ‘‌আধুনিক দাবার জনক’‌। আজ জন্মদিনে আধুনিক দাবার জনককে একটু ফিরে দেখা।
স্টেইনিৎজের আগে ফিলোডর, পল মরফি, অ্যান্ডারসন, স্টনটনের মতো নামী দাবাড়ুরা থাকলেও কেউই সরকারিভাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন না। সরকারিভাবে দাবার প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা হয় ১৮৮৬ সালে। আমেরিকার তিনটি শহরে পর্যায়ক্রমে খেলা হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক, সেন্ট লুই এবং নিউ ওরলিনস। সেই খেতাবি লড়াইয়ে স্টেইনিৎজের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জোহানেস জুকার্টট। ঠিক হয়েছিল প্রথম যিনি ১০টি গেম জিতবেন, তিনিই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবেন। প্রথম পাঁচটি গেমের শেষে জুকার্টট ৪-‌১ এগিয়ে যান। প্রায় সবাই নিশ্চিত হয়ে যান জুকার্টটই প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চলেছেন, তখনই ঘুরে দাঁড়ান স্টেইনিৎজ। জেতেন ১২.‌৫-‌৭.‌৫ পয়েন্টে। জয় ১০, ড্র ৫, হার ৫। অস্ট্রিয়ার স্টেইনিৎজ তখন আমেরিকায় থাকলেও সেদেশের নাগরিকত্ব ছিল না। কিন্তু ওই খেতাবি লড়াই শুরুর আগে তিনি দাবি জানান, বোর্ডে তাঁর সামনে রাখতে দিতে হবে আমেরিকার পতাকা। এই নিয়ে অনেকটা জল ঘোলা হয়। পরে ১৮৮৮ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব পান এবং উইলহেম নাম বদলে হন উইলিয়াম।
১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ পর্যন্ত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন স্টেইনিৎজ। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া ও খেতাব হারানোর মাঝে তাঁকে আরও তিনবার খেতাব রক্ষার লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। প্রথমে হাভানায় ১৮৮৯ সালে। সেবার স্টেইনিৎজের চ্যালেঞ্জার ছিলেন রাশিয়ার মিখাইল চিগোরিন। এটা ঠিক খেতাব রক্ষার লড়াই ছিল কি না, তা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। কারণ তখনও ফিডের (‌আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা)‌ জন্ম হয়নি। এত নিয়মকানুনও ছিল না। কে চ্যালেঞ্জার হবেন, সেটা অনেকটাই নির্ভর করত আগের বিশ্বচ্যাম্পিয়নের ওপর। তিনি সম্মতি না জানালে ওই খেলা হত না। চিগোরিনকে চ্যালেঞ্জার হিসেবে স্টেইনিৎজ মেনে নিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে সেই লড়াইয়ে স্টেইনিৎজ জিতে (‌জয় ১০, ড্র ১, হার ৬)‌ যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে আর বিতর্ক জমে থাকেনি।
১৮৯০-‌৯১ সালে স্টেইনিৎজ দ্বিতীয়বার খেতাব রক্ষার লড়াইয়ে নামেন নিউ ইয়র্কে ইসিডোর গুন্সবার্গের বিরুদ্ধে। বেস্ট অফ ২০ গেমের সেই লড়াইয়ে জিতে (‌জয় ৬, হার ৪, ড্র ৯)‌ স্টেইনিৎজ বিশ্ব খেতাব ধরে রাখেন। ‌‌
১৮৯২ সালে হাভানাতে আবার চিগোরিনের মুখোমুখি হন। এটাও ছিল বেস্ট অফ ২০ গেমের লড়াই। তাতে মীমাংসা না হলে টাইব্রেক। ২০ গেমের সেই লড়াই অমীমাংসিত ছিল। উভয়েই জিতেছিলেন ৮টি করে গেম। চারটি ড্র। টাইব্রেকে দুটিতে জয় স্টেইনিৎজের, একটি ড্র। ফলে বিশ্ব খেতাব স্টেইনিৎজের দখলেই থেকে যায়।
শেষ পর্যন্ত ১৮৯৪ সালে জার্মানির এমানুয়েল লাসকারের কাছে বিশ্ব খেতাব হারান স্টেইনিৎজ। সেবার খেলা হয়েছিল তিনটি শহরে। নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া ও মন্ট্রিল। ঠিক বেস্ট অফ ২০ নয়, নিয়ম করা হয়েছিল যিনি ১০টি গেম প্রথম জিতবেন, তিনিই হবেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। লাসকারের পক্ষে ফল ছিল জয় ১০, হার ৫, ড্র ৪। এমানুয়েল লাসকার খেতাব কেড়ে নেওয়ার পর ১৮৯৬-‌৯৭ সালে চ্যালেঞ্জার হয়েছিলেন স্টেইনিৎজ। কিন্তু সেবারও পারেননি। ওই একই নিয়মে লাসকার খেতাব দখলে রেখেছিলেন। ফল ছিল লাসকারের পক্ষে জয় ১০, হার ২, ড্র ৫। সেই শেষ। বিশ্ব খেতাবের লড়াইয়ে স্টেইনিৎজকে আর দেখা যায়নি।
সবাই বলেন, লেখাপড়ার সঙ্গে দাবা খেলার কোনও বিরোধ নেই। এই বক্তব্যের পক্ষে দেখা যায়, সেরা দাবাড়ুরা প্রায় সবাই লেখাপড়ায় খুব ভাল। ব্যতিক্রম ছিলেন না স্টেইনিৎজও। শুধু খেলোয়াড় নয়, দাবা লেখক হিসেবেও তিনি পৌঁছেছিলেন অন্য উচ্চতায়। ১৮৭২ থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লন্ডনের ‘‌দ্য ফিল্ড’‌ পত্রিকার দাবা প্রতিবেদক। শুধু খেলার চুলচেরা বিশ্লেষণই নয়, দাবা নিয়ে লিখতেন নানা স্বাদের লেখা। ১৮৮৫ সালে তাঁর হাত ধরেই প্রকাশিত হয় ‘‌ইন্টারন্যাশনাল চেস ম্যাগাজিন’‌। তিনিই প্রতিষ্ঠাতা-‌সম্পাদক। ১৮৯১ পর্যন্ত তিনি সম্পাদক ছিলেন। সিরিয়াস দাবা খেলা শুরুর অল্প পরেই তাঁকে সবাই বলতেন, ‘‌দ্য অস্ট্রিয়ান মরফি’‌। ১৮৯৪ সালে মরফি মারা যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে দীর্ঘ সিরিজ লিখেছিলেন স্টেইনিৎজ। ‘‌দ্য মডার্ন চেস ইনস্ট্রাক্টর’‌-‌এর মতো অতি প্রয়োজনীয় বইও ভবিষ্যতের দাবা খেলোয়াড়দের জন্য লিখে গিয়েছেন তিনি।
গ্যারি কাসপারভ '‌My Great Predecessors'‌ ‌বইয়ে লিখেছেন, ‘‌উইলহেম স্টেইনিৎজ শুধু প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নন, তিনি দাবার একজন গ্রেট গবেষকও।’‌ কাসপারভের মতে, স্টেইনিৎজের সময় থেকেই দাবার আধুনিক যুগ শুরু। ১৮৭৩ সালে ভিয়েনাতে এক প্রতিযোগিতায় ‘‌পজিশনাল প্লে’‌-‌র এক নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। পরবর্তী সময়ে যা আধুনিক দাবার ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। তাঁকে অনেকে বলেন ‘‌দাবার বিজ্ঞানী’‌।
১৮৯৯ সালের জুন মাস। ৬৩ বছর বয়সে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে খেলতে গিয়েছিলেন লন্ডনে। দারিদ্র‌্য তখন তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। যা তাঁকে মানসিক ভারসাম্যহীনও করে তুলেছিল। লন্ডনে জীবনের সেই শেষ প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেলেন না। ব্যর্থ হলেন আর্থিক পুরস্কার জিততে। আগের ৪০ বছরে যা আর কখনও হয়নি। ওই ব্যর্থতা মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রায় উন্মাদ হয়ে যান। মানসিক নানা হাসপাতালে চিকিৎসায়ও কোনও ফল পাওয়া যায়নি। মারা যান ১৯০০ সালের ১২ আগস্ট।
স্টেইনিৎজই দাবা ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি অ্যাপিয়ারেন্স ফি ছাড়া কোনও প্রতিযোগিতায় খেলতেন না। তবু দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই দাবা খেলোয়াড়ের শেষ জীবনও কেটেছে প্রবল দারিদ্র‌্যের মধ্যেই। শেষ বয়সে তিনি বলতেন, ‘‌খ্যাতি, জনপ্রিয়তা অনেক পেয়েছি। আর দরকার নেই। এখন আমার প্রয়োজন অর্থ।’‌
দাবা বোর্ডে নিত্যনতুন চাল বের করতে তাঁর মস্তিস্ক যতটা সচল ছিল, অর্থ জমানোর ক্ষেত্রে তা ছিল না।

জন্ম:‌ ১৭ মে, ১৮৩৬।
মৃত্যু:‌ ১২ আগস্ট, ১৯০০। 

Friday, May 15, 2020

‘‌ওগো বধূ সুন্দরী’-‌‌র লোলা বোস খেলার মাঠেও ছিলেন সফল


বাংলা চলচ্চিত্রের সফল অভিনেত্রী মীনাক্ষী খেলার জগতেও ছিলেন বিখ্যাত 


‘‌ওগো বধূ সুন্দরী’-‌‌র
লোলা বোস খেলার
মাঠেও ছিলেন সফল 



নির্মলকুমার সাহা


১৯৫২ সালে মস্কোতে হয়েছিল মহিলাদের প্রথম বিশ্ব ভলিবল প্রতিযোগিতা। অংশ নিয়েছিল সোবিয়েত ইউনিয়ন, পোলান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স ও ভারত। শুধু উত্তরপ্রদেশের মেয়েদের নিয়ে গড়া একটি ভারতীয় দল ওই বিশ্ব ভলিবল প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়েছিল। যে দলে ১২ জনের মধ্যে ৭ জন ছিলেন প্রবাসী বাঙালি মেয়ে। সেই প্রথম ভারতের কোনও মহিলা ভলিবল দলের বিদেশে খেলতে যাওয়া। ফল একেবারেই ভাল হয়নি। ৮ দলের প্রতিযোগিতায় ভারত পেয়েছিল অষ্টম স্থান। রাউন্ড রবিন লিগের সাতটি ম্যাচেই বিশ্রীভাবে হেরেছিল ভারত। কোনও ম্যাচেই একটি সেটও পায়নি। ওই দলের খেলোয়াড় ছিলেন মীনাক্ষী চৌধুরি। পরে নানা সময়ে তিনি বলেছেন, ‘‌সেবার মস্কো গিয়েই বুঝেছিলাম, খেলাধুলোয় আমরা কতটা পিছিয়ে। খেলাধুলোর মান সম্পর্কে আমার ধারণাই বদলে গিয়েছিল।’‌
১৯৫২ (‌মাদ্রাজ)‌, ১৯৫৩ (‌ত্রিবান্দ্রম)‌ ও ১৯৫৪ সালে (‌দিল্লি)‌ ভলিবলে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়া উত্তরপ্রদেশ দলে ছিলেন মীনাক্ষী। ১৯৫৩ সালে ছিলেন অধিনায়িকা।
শুধু ভলিবল নয়, মীনাক্ষী ছিলেন নানা খেলায় পারদর্শী। ১৯৫৪ সালে জাতীয় বাস্কেটবলের আসর বসেছিল কলকাতায়। মহিলা বিভাগে বাংলা বনাম উত্তরপ্রদেশ খেলা। এক দলে নির্মলা মুখার্জি, রেণু সিমলাই, মীনাক্ষী চৌধুরি, শুক্লা রায়, এষা চ্যাটার্জিরা। অন্য দলে রোজ, মার্গারেট, ডালসি, মেরিরা। কোনটা বাংলা দল, আর কোনটা উত্তরপ্রদেশ?‌ নামগুলো দেখে ভুল হওয়ারই সম্ভাবনা। আসলে উত্তরপ্রদেশ দলটা ছিল বাঙালি মেয়েতে ভর্তি। আর বাংলা দলে ঠাসা অবাঙালি মেয়ে। ওই উত্তরপ্রদেশ দলের মধ্যমণি ছিলেন মীনাক্ষী। বাংলার কাছে উত্তরপ্রদেশ হারলেও মীনাক্ষী বিস্তর প্রশংসা কুড়িয়ে ফিরেছিলেন। 
একসময় এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দলেই মীনাক্ষীর জায়গা ছিল পাকা। অ্যাথলেটিক্সের ডিসকাস, জ্যাভেলিন, শটপাটে ছিলেন দক্ষ। সাইক্লিং, ব্যাডমিন্টন, হকিও বাদ যায়নি মীনাক্ষীর খেলার তালিকা থেকে। ১৯৫৩ সালে সাইক্লিংয়ে এলাহাবাদ জেলা চ্যাম্পিয়ন। ১৯৫৪ সালে ব্যাডমিন্টনে ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন। ১৯৫৩ সালে উত্তরপ্রদেশ রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে মহিলা বিভাগে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন। সর্ব ভারতীয় আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিক্সে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের। হকিতে ছিলেন সেন্টার হাফ। ওঁদের হকি দল একাধিকবার এলাহাবাদ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
১৯৫৫ সালে ব্যাঙ্গালোরে (‌এখন বেঙ্গালুরু)‌ এসেছিলেন ১৯৫২-‌র অলিম্পিকে জ্যাভেলিন থ্রো-‌তে সোনাজয়ী ডানা জ্যাটোপকোভা। তাঁর সঙ্গে এগজিবিশনে নেমেছিলেন মীনাক্ষী। পরে মীনাক্ষী বলেছেন, ‘‌অবাক হয়ে শুধু দেখেছিলাম, কত দূর জ্যাভেলিন ছোঁড়া যায়!‌’‌
লেখাপড়ায়ও ছিলেন কৃতী ছাত্রী। ১৯৫০ সালে ইউ পি বোর্ডের প্রবেশিকা পরীক্ষায় পেয়েছিলেন চতুর্দশ স্থান। ১৯৫২ সালে ইন্টারমিডিয়েটে একাদশ স্থান। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পরে গ্র‌্যাজুয়েট হন। স্কুল ও কলেজ জীবনে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও। ১৯৫২ সালে এলাহাবাদে একটি সর্ব ভারতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন।
১৯৫৬ সালে বিয়ে হয় কলকাতার বাচস্পতি গোস্বামীর সঙ্গে। এলাহাবাদের পাট চুকিয়ে, চৌধুরি থেকে গোস্বামী হয়ে বিয়ের পর পাকাপাকি চলে আসেন কলকাতায়। বাস্কেটবলের টানে খেলতে গিয়েছিলেন রাখী সঙ্ঘে। কমবয়সীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে খেলা থেকে সরে আসেন। পরে ভর্তি হয়েছিলেন লাইফ সেভিং সোসাইটিতে সাঁতারের জন্য। এলাহাবাদে অনেক খেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেও সাঁতারটা সেভাবে করা হয়নি। কলকাতায় এসেই সাঁতার শুরু। সাঁতার থেকে ওয়াটার ব্যালে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে চলে আসা সিনেমায়। তারপর ‘‌ওগো বধূ সুন্দরী’‌র ‘‌লোলা বোস’‌ পাকাপাকি থেকে যান চলচ্চিত্র জগতেই। হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার এক সফল অভিনেত্রী। ওগো বধূ সুন্দরী, সম্রাট ও সুন্দরী, চৌধুরী পরিবার, জোয়ার ভাঁটা, ঘরের বউ, ছোট বউ, নিশান্তে সহ ২৮ টি বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছেন। দেখা গিয়েছে টিভি সিরিয়ালেও। একসময় অভিনেত্রী মীনাক্ষী গোস্বামীর পর্দার সাফল্যে চাপা পড়ে যান মাঠের মীনাক্ষী চৌধুরি। ৮ বছর আগে মৃত্যুর পরও যাবতীয় সম্মান দিয়েছিল চলচ্চিত্রমহলই। কিন্তু খেলার জগতে উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছিলেন মীনাক্ষী।

জন্ম:‌ ২১ মে ১৯৩৩।
মৃত্যু:‌ ৮ এপ্রিল ২০১২।‌‌‌

Tuesday, May 12, 2020

দাদার পরিচয়ে নয়, রূপ সিং বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছিলেন নিজের গুণে, নিজের যোগ্যতায়


 দাদার পরিচয়ে নয়, রূপ সিং বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছিলেন নিজের গুণে, নিজের যোগ্যতায়


ধ্যানচাঁদের ভাইও
ছিলেন মহাতারকা


নির্মলকুমার সাহা


শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা হকি খেলোয়াড় রূপ সিং। হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের ছোট ভাই। কিন্তু দাদার পরিচয়ে নয়, তিনি বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছিলেন নিজের গুণে, নিজের যোগ্যতায়।
১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে ভারত ২৪-‌১ গোলে হারিয়েছিল আমেরিকাকে। একা রূপ সিং-‌ই করেছিলেন ১০ গোল। যা এখনও অলিম্পিকে এক ম্যাচে ব্যক্তিগত বেশি গোল করার রেকর্ড। ওটাই ছিল রূপের প্রথম অলিম্পিক। আর ওই ম্যাচটি অলিম্পিকে ছিল তাঁর দ্বিতীয় ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে জাপানের বিরুদ্ধে ভারত জিতেছিল ১১-‌১ গোলে। যাতে রূপ সিংয়ের গোল ছিল তিনটি। জাপানের বিরুদ্ধে ম্যাচটিতে একটি নজিরও তৈরি হয়েছিল। ভারতের হয়ে সেই প্রথম কোনও দাদা-‌ভাইয়ের একসঙ্গে অলিম্পিকে খেলা। সেন্টার ফরোয়ার্ড ধ্যানচাঁদ, লেফট ইন রূপ সিং। ধ্যানচাঁদের ওটা ছিল দ্বিতীয় অলিম্পিক। লস এঞ্জেলসে গোল করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ দাদাকে টপকে গিয়েছিলেন অনভিজ্ঞ ভাই। সেবার অলিম্পিকে সোনা জেতার পথে ভারতকে খেলতে হয়েছিল মাত্র দুটি ম্যাচ। দুই ম্যাচে ধ্যানচাঁদের গোল ছিল ১২ টি। রূপের ১৩।
১৯৩২ সালের পর দুই ভাই একসঙ্গে খেলেছিলেন আরও একটি অলিম্পিক। ১৯৩৬ সালে বার্লিনে। ধ্যানচাঁদের নেতৃত্বে সেখানেও ভারত জিতেছিল সোনার পদক। বার্লিনে দাদা-‌ভাই দুজনই করেছিলেন ১১টি করে গোল। অর্থাৎ দুটি অলিম্পিক মিলে গোল করায় দাদার (‌২৩ গোল)‌ চেয়ে এগিয়েই ছিলেন ভাই (‌২৪ গোল)‌।
বার্লিন অলিম্পিকের আগে ১৯৩৫ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ভারতীয় দল। সেই দলেও দাদার সঙ্গে ভাই ছিলেন। ওই সফরে ৪৮ ম্যাচে ভারত করেছিল ৫৮৪ গোল। ওখানে অবশ্য গোল করায় ভাইয়ের (‌১৮৫ গোল)‌ আগে ছিলেন দাদা (‌২০১ গোল)‌। ভারতের বিরুদ্ধে গোল হয়েছিল ৪০টি। 
অলিম্পিকে ভারত প্রথম হকি খেলতে গিয়েছিল ১৯২৮ সালে আমস্টারডামে। রূপের দাদা ধ্যানচাঁদ ছিলেন সেই ভারতীয় দলেও। আমস্টারডাম থেকে সোনা জিতে দেশে ফেরার পর অল্প কয়েকদিন ঝাঁসির বাড়িতে ছিলেন ধ্যানচাঁদ। ঝাঁসির প্রেমগঞ্জের সেই বাড়িতে সকাল, বিকেল, রাত—সবসময়ই নানা বয়সীদের ভিড় লেগে থাকত। স্কুলের ছাত্র, স্থানীয় হকি খেলোয়াড়, সাধারণ মানুষ—সকলেই আসতেন অলিম্পিকের সোনার পদক দেখতে। অলিম্পিকের গল্প শুনতে। সেই আগ্রহীদের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর ছোট ভাই রূপ সিং।
আত্মজীবনী ‘‌গোল’‌-‌এ ধ্যানচাঁদ লিখেছেন, ‘‌আমার ছোট ভাই রূপের মধ্যে সে সময় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম। ওর তখনও কিশোর বয়স। অলিম্পিক থেকে আমি ফেরার পর ও আমার ঘরেই থাকা শুরু করে। হকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমার কথোপকথন মন দিয়ে শুনতে থাকে। আমার বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, রূপ তাদের বলেছে, খুব মন দিয়ে হকি খেলবে। এমন কথাও বলেছে, তার লক্ষ্য হকি খেলে আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে হার মানানো।’‌
দাদার জনপ্রিয়তাকে হার মানাতে না পারলেও রূপ সিংও হকির মহাতারকা হয়ে উঠেছিলেন। বার্লিন অলিম্পিকে রূপ সিংয়ের খেলা এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে ৩৬ বছর পরও তা মনে রেখেছিলেন জার্মানরা। ১৯৭২ সালে আবার যখন জার্মানির অন্য শহর মিউনিখে অলিম্পিকের আসর বসে সেখানে গেমস ভিলেজের একটি রাস্তা রূপের নামে করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রূপ সিং আরও অন্ততঃ একটি অলিম্পিক খেলতেন। বাড়ত তাঁর গোল ও সোনার পদকের সংখ্যাও। কী আর করা যাবে!‌
ধ্যানচাঁদ লিখেছেন, ‘‌রূপের তুলনা হয় না। পাশে ও না থাকলে কোথায় থাকতাম আমি!‌ রূপ খেলা শিখেছে নিজের উৎসাহ আর চেষ্টাতেই। ঝাঁসিতে থাকার সময়েই হকিতে ওর হাতে খড়ি। একসঙ্গে অনেকদিন খেলেছি। বড় বলে আমি হয়ত রূপকে অল্পস্বল্প উপদেশও দিয়েছি। কিন্তু আমার জন্য রূপ সিং সর্বকালের অন্যতম সেরা হকি খেলোয়াড় হয়েছে, এটা ঠিক নয়। ও বড় হয়েছে নিজের সাধনাতেই।’‌
শেষ বয়সে একবার তো ধ্যানচাঁদ এমনও বলে ফেলেছিলেন, ‘‌রূপ আমার চেয়ে অনেক ভাল খেলোয়াড় ছিল।’‌
রূপ সিং খেলতেন ধ্যানচাঁদের পাশে ইনসাইড লেফটে। তাঁর খেলায় পাওয়ার, অনুমান ক্ষমতা এবং স্টিক ওয়ার্ক ছিল অতুলনীয়। গোলে নিতে পারতেন জোরালো হিট। ভাইয়ের ওই জোরালো হিট নিয়ে ধ্যানচাঁদ চিন্তিত ছিলেন। বহুবার ভাইকে সতর্ক করেছেন, যাতে ওরকম হিটে বিপক্ষের কোনও খেলোয়াড় আহত না হন। নিতে পারতেন ভাল পেনাল্টি কর্নার শটও। আক্ষরিক অর্থেই রূপ ছিলেন কমপ্লিট হকি খেলোয়াড়। ছিলেন যথার্থ স্পোর্টসম্যান। আম্পায়ারের কোনও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে বা বিপক্ষের খেলোয়াড়দের সঙ্গে তর্কে জড়াতে তাঁকে কখনও দেখা যায়নি।
সাজপোষাক, জীবনযাত্রায় রূপ ছিলেন খুব পরিচ্ছন্ন। ১৯৩২ সালে অলিম্পিক দলে নির্বাচিত হয়েও তিনি প্রথমে যেতে চাননি। আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার মতো ভাল পোষাক তাঁর ছিল না। ধ্যানচাঁদ নতুন জামা-‌প্যান্ট কিনে দেওয়ার পর তিনি লস এঞ্জেলস যেতে রাজি হয়েছিলেন।
সুমের সিংয়ের (‌পোশাকি নাম সমেশ্বর দত্ সিং)‌ তিন ছেলে। মূল সিং, ধ্যান সিং (‌ধ্যানচাঁদ)‌ ও রূপ সিং। রূপ সিংয়ের জন্ম জব্বলপুরে ১৯০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। দাদা ধ্যানচাঁদকে দেখেই হকিতে আসা। কিন্তু শুরু থেকে দাদার সঙ্গে একই দলে খেলা হয়ে ওঠেনি। লস এঞ্জেলস অলিম্পিকের কয়েকমাস আগে প্রথম দাদা-‌ভাই একসঙ্গে খেলেন। লস এঞ্জেলস যাওয়ার আগে দেশে ও বিদেশে ভারতীয় দল ১৫টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল। দাদা-‌ভাইয়ের মাঠের অসাধারণ বোঝাপড়াটা তৈরি হয়েছিল ওই প্রস্তুতি ম্যাচগুলো থেকেই।
চাকরি করতেন গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজ পরিবারের নিজস্ব সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীতে। ছিলেন ক্যাপ্টেন। তখন বিভিন্ন রাজ পরিবারে ক্রিকেট, গল্ফ, টেনিসের মতো খেলার কদর ছিল। নিয়মিত খেলা হত। রূপ সিংও ওই তিনটি খেলায় অংশ নিতেন। অবসরের পর আর্থিক অনটনে পড়েন। পেনশন পেতেন মাসিক ১৪৮ টাকা!‌ সংসার চালাতে হিমশিম। কী আর করবেন, সিন্ধিয়া পরিবারের ফাইফরমাশ খেটে, বাড়ির কাজকর্ম করে কিছু টাকা উপার্জন করতেন। এভাবেই সংসার চালাতেন অলিম্পিকে জোড়া সোনাজয়ী নায়ক। শেষ জীবনে প্রবল দারিদ্র‌্যই ছিল তাঁর সঙ্গী।
জীবনাবসান গোয়ালিয়রেই ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। পরের বছরই গোয়ালিয়রের হকি স্টেডিয়ামের নাম হয় ‘‌ক্যাপ্টেন রূপ সিং স্টেডিয়াম’‌। কিন্ত আমাদের এই ক্রিকেটসর্বস্ব দেশে কী আর হবে!‌ ১৯৮৮ সালে পরিকাঠামো বদল করে ওটাকে ক্রিকেট স্টেডিয়াম করে ফেলা হয়। একজন সফল ক্রীড়ানায়ককে মৃত্যুর পর দেওয়া সামান্য সম্মানটুকুও কেড়ে নেওয়া। নিজের দেশে না পেলেও বিদেশে মরণোত্তর সম্মান পেয়েছেন তিনি। ২০১২ সালে অলিম্পিকের সময় লন্ডনে ভারতের যে তিনজন খেলোয়াড়ের নামে টিউব স্টেশনের নামকরণ হয়েছিল, তাঁদের একজন রূপ সিং। বাকি দু’‌জন ধ্যানচাঁদ ও লেসলি ক্লডিয়াস।

জন্ম:‌ ৮ সেপ্টেম্বর ১৯০৮।
মৃত্যু:‌ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৭। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌

Thursday, May 7, 2020

অলিম্পিকে জোড়া সোনা জিতে পাওয়া বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা!‌


অলিম্পিকে জোড়া সোনা
জিতে পাওয়া বন্দুকের
গুলিতে আত্মহত্যা!‌


নির্মলকুমার সাহা


(‌আজ ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স ডে। এই বিশেষ দিনে ১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে সোনাজয়ী পার্সি উইলিয়ামসকে নিয়ে দু-‌চার কথা।)‌ 


১৫ বছর বয়সে কঠিন বাতঘটিত জ্বরে আক্রান্ত। ডাক্তার দেখিয়ে, অনেক চিকিৎসা করিয়েও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছিল, বেশি পরিশ্রমের কোনও ফিজিক্যাল ট্রেনিং করা যাবে না। কিন্তু শৈশব থেকেই তো নানা খেলায় উৎসাহী। ডাক্তারের ওই নির্দেশ কী করে মানা সম্ভব?‌ কী করে ছেড়ে দেবেন প্রিয় অ্যাথলেটিক্স?‌ ডাক্তারের সেই নির্দেশ অমান্য করেই একদিন স্কুলের প্রয়োজনে নেমে পড়েন একটি অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায়। তাতে সাফল্য পাওয়ায় ১৯২৪ সাল থেকে ফের পুরোপুরি স্প্রিন্টের অনুশীলন শুরু। ১৯২৭ সালের মধ্যেই পার্সি উইলিয়ামস হয়ে ওঠেন স্প্রিন্টে কানাডার মুখ।
১৯২৮ সালে কানাডার অলিম্পিক ট্রায়ালে ১০০ ও ২০০ মিটার দুটোতেই চ্যাম্পিয়ন। শুধু তাই নয়, ১০০ মিটারে তখনকার অলিম্পিক রেকর্ড (‌১০.‌৬ সেকেন্ড)‌ স্পর্শ করেন। তখন পার্সির কোচ ছিলেন বব গ্র‌্যাঙ্গার। পার্সি অলিম্পিকের ছাড়পত্র পেলেও কোচ হিসেবে বব গ্র‌্যাঙ্গারকে আমস্টারডাম পাঠাতে কানাডা রাজি ছিল না। নিজের পয়সায় আমস্টারডাম যাওয়াও তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব। কারণ বব গ্র‌্যাঙ্গার ট্রেনে ডাইনিং কারে বাসন পরিস্কারের অতি সামান্য একটা কাজ করতেন। কোচ ববকে আমস্টারডাম পাঠানোর উদ্যোগ নেন পার্সির মা ও ভ্যাঙ্কুবারের অ্যাথলেটিক্সপ্রেমীরা। তাঁরা ববের আমস্টারডাম যাওয়ার খরচ দিয়েছিলেন চাঁদা তুলে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, বব সঙ্গে গেলে পার্সি অলিম্পিকে সোনা জিতবেনই। তাঁদের ওই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছিলেন পার্সি উইলিয়য়ামস। সেবার অলিম্পিকে তিনি জোড়া সোনা জিতেছিলেন। ১০০ ও ২০০ মিটারে। ৪x‌‌১০০ মিটার রিলে দলেও পার্সি ছিলেন। ফাইনালে কানাডার রিলে দল বাতিল হয়ে গিয়েছিল। ১০০ মিটারে সোনা জিততে সময় নিয়েছিলেন ১০.‌৮ সেকেন্ড। রুপো ও ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন যথাক্রমে গ্রেট ব্রিটেনের জ্যাক লন্ডন (‌১০.‌৯)‌ ও জার্মানির জর্জ ল্যামার্স (‌১০.‌৯)‌। কানাডার কোনও অ্যাথলিটের অলিম্পিকে ১০০ মিটারে সেই প্রথম সোনা জয়। ২০০ মিটার সোনা জিততে পার্সির সময় লেগেছিল ২১.‌৮ সেকেন্ড। স্বভাবতই দেশে ফিরে পেয়েছিলেন বীরের সংবর্ধনা। পেয়েছিলেন নানা উপহার। যার মধ্যে ছিল একটি গাড়িও। পরে ভ্যাঙ্কুবারে একটি অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়াম গড়ে ওঠে পার্সির নামে। ওই স্টেডিয়ামে রয়েছে পার্সির মূর্তিও।
এখনকার কমনওয়েলথ গেমসের আগে নাম ছিল ব্রিটিশ এম্পায়ার গেমস। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ এম্পায়ার গেমসের প্রথম আসরে ১০০ গজের দৌড়েও সোনা জিতেছিলেন পার্সি। ওই প্রতিযোগিতার সময়ই পায়ের পেশিতে টান ধরে। তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই পেশির ওই সমস্যায় ভুগতেন। তা সত্ত্বেও ১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলেস অলিম্পিকেও কানাডা দলে সুযোগ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার ফল ভালো হয়নি। ১০০ মিটারে বিদায় নিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। কানাডার রিলে দলেও ছিলেন। রিলে দল পেয়েছিল চতুর্থ স্থান।
এরপরই প্রতিযোগিতামূলক অ্যাথলেটিক্স থেকে সরে দাঁড়ান। একটি বিমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও।
পার্সি উইলিয়ামসের জন্ম ১৯০৮ সালের ১৯ মে। বাবা ছিলেন ট্রামের কন্ডাকটর। শৈশব থেকেই নানা খেলায় উৎসাহ ছিল পার্সির। জীবনের প্রথম পদক পাওয়া সেই শৈশবে সাইকেল রেসে। টেনিসও খেলতেন তখন। আরেকটা প্রিয় খেলা ছিল শুটিং। পরে সব ছেড়ে অ্যাথলেটিক্স নিয়েই মেতেছিলেন। পার্সি যখন খুব ছোট, তখনই মা-‌বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সেই থেকে পার্সি মা-‌র কাছেই। আমস্টারডাম অলিম্পিকেও সঙ্গে গিয়েছিলেন মা চার্লটন। পার্সি বিয়ে করেননি। মাকে নিয়েই ছিল তাঁর সংসার। ১৯৭৭ সালে মা-‌র মৃত্যুর পর বড্ড একা হয়ে পড়েন। কৈশোরের সেই বাতের রোগ থেকে কখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি। মাঝেমধ্যেই ভুগতেন। বৃদ্ধ বয়সে সেই রোগটা আবার বেশিভাবে দেখা দেয়। ভীষণ কষ্ট পেতেন। একাকিত্বের জন্য মানসিক অবসাদও দেখা দেয়। অলিম্পিক থেকে জিতে আনা দুটি সোনার পদকই ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে দিয়ে দেন বি সি স্পোর্টস হল অফ ফেমে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই পদক দুটি চুরি হয়ে যায়। তাতে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। মদ্য পান বাড়িয়ে দেন। শেষ বয়সে তাঁর একমাত্র যাতায়াত ছিল স্থানীয় এক গল্ফ ক্লাবে। মদের বোতল চুরির দায়ে একদিন সেই ক্লাব থেকেও পার্সিকে বের করে দেওয়া হয়। এতে আরও ভেঙে পড়েন।
ভালবাসতেন নানারকম বন্দুক সংগ্রহ করতে। বাড়িতে অনেক বন্দুক ছিল। যার মধ্যে একটি অলিম্পিকে জোড়া সোনা জিতে দেশে ফেরার পর উপহার পেয়েছিলেন। ভ্যাঙ্কুবারে নিজের বাড়িতে সেই বন্দুকটি থেকেই মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন ১৯৮২ সালের ২৯ নভেম্বর।

জন্ম:‌ ১৯ মে, ১৯০৮।
মৃত্যু:‌ ২৯ নভেম্বর, ১৯৮২। 

Tuesday, May 5, 2020

‘‌দস্যুরাজ পান সিং, চম্বল কা শের’‌


ছিলেন দেশের নামী অ্যাথলিট। সেখান থেকেই পারিবারিক সম্পত্তির বিবাদে পান সিং টোমার হয়ে উঠেছিলেন চম্বলের দস্যু



‘‌দস্যুরাজ পান সিং, চম্বল কা শের’‌


নির্মলকুমার সাহা


কয়েকদিন আগে মারা গেলেন অভিনেতা ইরফান খান। তাঁর মৃত্যুর পর আবার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কিছুটা প্রচারের আলোয় চলে এলেন অতীতের এক বিখ্যাত অ্যাথলিট। যিনি পরে চম্বলের দস্যু হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যখন ফেরার, তাঁর খোঁজ দিতে পারলে, পুলিশ ঘোষণা করেছিল ১০ হাজার টাকা পুরস্কার। পরে পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে তিনি নাকি মারাও গিয়েছিলেন। অ্যাথলিট থেকে চম্বলের ডাকাত হয়ে ওঠা সেই পান সিং টোমারের বায়োপিক মুক্তি পায় ২০১২ সালে। যেখানে পান সিং টোমারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সদ্য প্রয়াত ইরফান খান। ওখান থেকেই অভিনেতা হিসেবে তাঁর দুর্দান্ত উত্থান।
অ্যাথলিট পান সিং টোমারকে আমি দেখিনি। তবে তিনি যখন অ্যাথলেটিক্স করতেন সেই সময়ের অনেক অ্যাথলিটের সঙ্গেই বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। ১৯৫৮-‌র টোকিও এশিয়ান গেমসে জোড়া সোনা জিতেছিলেন ‘‌উড়ন্ত শিখ’‌ মিলখা সিং। সেই এশিয়াডেই ৩০০০ মিটার স্টিপলচেজে অংশ নিয়েছিলেন পান সিং টোমার। তার আগেই খুব কাছ থেকে পান সিংকে দেখেছেন মিলখা। দু’‌জনই চাকরি করতেন আর্মিতে। পান সিংয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই এখনও মিলখা বলেন, ‘‌শুনেছিলাম পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে ওদের সমস্যা ছিল। অনেক আগেই আর্মির চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যায়। পরে শুনি ডাকাত হয়ে গেছে!‌ যতটা শুনেছি সম্পত্তির ঝামেলাটা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে পান সিং ডাকাত হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেখান থেকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব ছিল না। ফিরতে পারেওনি। আরও পরে তো পুলিশের সঙ্গে লড়াইয়ে মারাও যায়। ব্যাপারটা ভীষণ কষ্টের!‌’
যোগিন্দার সিং সাইনি তখন সবে কোচিং শুরু করেছেন। বয়সে বছর দুয়েকের ছোট পান সিংয়ের সঙ্গে খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তাঁর। টোকিও থেকে ঘড়ি এনে তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন পান সিং। অনেক বছর আগে একবার হাতের সেই ঘড়ি দেখিয়ে যোগিন্দার সিং সাইনি বলেছিলেন, ‘টোকিও এশিয়ান গেমস থেকে ফিরে এটা আমাকে দিয়েছিল। খুব ভাল অ্যাথলিট ছিল। ছিল খুব আমুদে। কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল!‌ একজন জাতীয় অ্যাথলিটের এভাবে ডাকাত হয়ে যাওয়াটা অ্যাথলেটিক্সের জন্য কখনও ভালো বিজ্ঞাপন নয়।’‌
গ্রামের এবড়ো‌থেবড়ো মাঠে ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো করলেও স্টিপলচেজ সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না পান সিংয়ের। মিলিটারির চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর একটি বিতর্কিত ঘটনার মাধ্যমে ওঁর স্টিপলচেজে আসা। রুরকিতে পোস্টিং। একদিন সকালে প্যারেডের সময় ইনস্ট্রাকটরের সঙ্গে তর্ক করেন। শাস্তি হিসেবে একটানা অনেকক্ষণ মাঠে দৌড়তে হয় পান সিংকে। ওঁর সেই দৌড়ের ভঙ্গি খুব পছন্দ হয় মাঠে থাকা সারওয়ান সিংয়ের, যিনি ১৯৫৪ সালে এশিয়ান গেমসে ১১০ মিটার হার্ডলসে সোনা জিতেছিলেন। তিনি আর্মির ওই ইউনিটের অ্যাথলেটিক্স কোচ নারাঞ্জন সিংকে বলেন, ‘‌ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে একটু নজর দিলে ভালো অ্যাথলিট হবে। লং ডিসটান্স রান করতে পারবে।’‌
সেটা ১৯৫৫ সাল। তখনই পান সিংকে আর্মির ওই ইউনিটের (‌বি ই জি)‌ অ্যাথলেটিক্স ক্যাম্পে নেওয়ার উপায় ছিল না। আর্মির নিয়মে আটকে যাচ্ছিল। কিন্তু সারওয়ানের অনুরোধে কোচ নারাঞ্জন সিং নিয়মিত পরামর্শ দিতেন পানকে। ট্রেনিংয়ের সূচি তৈরি করে দিতেন। সেই সূচি মেনে একা একাই অনুশীলন করে যেতেন। ১৯৫৬ সালের ৭ নভেম্বর বি ই জি-‌র গ্রুপ ডে অ্যাথলেটিক মিটে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করার পর ডাক পান ক্যাম্পে। সারওয়ান ও কোচের পরামর্শে তখন থেকেই ৩০০০ মিটার স্টিপলচেজ ও ৫০০০ মিটার দৌড় বেছে নেন পান সিং।
গত শতাব্দীর পাঁচ ও ছয়ের দশক মিলিয়ে স্টিপলচেজে ৭ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। ১০ বছর জাতীয় রেকর্ড ছিল ওঁর দখলে। ১৯৫৮ সালে কটকে ন্যাশনাল গেমসে জাতীয় রেকর্ড গড়েছিলেন (‌৯:‌১২.‌৪)‌। দিল্লিতে ১৯৬৪ সালে ওপেন ন্যাশনালে সেই রেকর্ড আরও উন্নত (‌৯:‌০৪.‌০)‌ করে নিয়েছিলেন। টোকিও এশিয়ান গেমসের আগে ইন্দো-‌সিলোন অ্যাথলেটিক্স মিটেও ভারতের হয়ে অংশ নিয়েছেন। আর্মির সুবেদার পান সিং ভালো অ্যাথলিট হওয়ায় ছাড় পেয়েছিলেন, ১৯৬২ সালে চীন-‌ভারত ও ১৯৬৫-‌তে ভারত-‌পাকিস্তান যুদ্ধে অংশ নিতে হয়নি।

স্ত্রী ও পুত্র-‌কন্যাদের সঙ্গে পান সিং টোমার। 



                                                                             পান সিং টোমারের জন্ম চম্বল নদীর লাগোয়া মোরেনা জেলার ছোট গ্রাম ভিদোসায়, ১৯৩২ সালের ১ জানুয়ারি, এক রাজপুত পরিবারে। ভিদোসা গ্রাম ও তার কাছাকাছি অধিকাংশ চাষের জমিই একসময় ছিল পান সিংয়ের বাবা-‌কাকা ও পরিবারের অন্যদের। বিশাল সম্পত্তির দখল নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ, মারামারি শুরু। বিশেষ করে পান সিংয়ের বাবা ঈশ্বরী সিং ও কাকা দয়ারাম সিংয়ের মধ্যে। আর্মির চাকরির জন্য গ্রামের বাইরে থাকলেও ওসব খবর নিয়মিত পেতেন পান সিং। জানতে পারেন অনেক জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেননি। একসময় ঠিক করেন, আর চাকরি করবেন না। গ্রামে ফিরে যাবেন। ভেবেছিলেন অ্যাথলিট হিসেবে নিজের খ্যাতি প্রশাসনিক মহলে কাজে লাগিয়ে হয়ত বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধার করতে পারবেন। কিন্তু গ্রামে ফিরে অনেক আলোচনা, বৈঠকের পরও তা পারেননি।‌ তখন গোপনে চম্বলের কিছু ডাকাতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হাতে তুলে নেন অস্ত্র। একসময় লড়াইটা গিয়ে দাঁড়ায় দয়ারাম সিংয়ের নাতি বাবু সিং বনাম পান সিং।
১৯৭৭ সালে পান সিং হত্যা করেন বাবু সিং-‌কে। শরিকে শরিকে জমি নিয়ে বিবাদ তখন তুঙ্গে। একরাতে পান সিংয়ের বাড়িতে এসেছিলেন বাবু সিং ও তাঁর দলবল। পান সিংয়ের ৯৫ বছর বয়সী মা তখন একা বাড়িতে। শোনা যায়, তাঁকে মারধর করেছিলেন বাবু সিং। হুমকি দিয়ে বাবু বলেছিলেন, ছেলেকে সামলে রাখতে, তা না হলে ফল অন্যরকম হবে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে মা-‌র কাছ থেকে পান সিং ওই হুমকির কথা শোনেন। মা-‌ও নাকি ছেলেকে বলেছিলেন এর প্রতিশোধ নিতে হবে। পরের দিনই প্রতিশোধ নেন পান সিং। সঙ্গে ছিলেন ভাইপো বলবন্ত সিং। একসময় ওই বাবুর গুন্ডাবাহিনীর হাতে প্রাণ গিয়েছিল পান সিংয়ের দাদা ও বলবন্তের বাবা মাতাদিন সিংয়ের। চাষের জমিতে গিয়ে ওঁরা পেয়ে যান বাবুকে। কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সরাসরি গুলি করেন পান সিং। শোনা যায়, তারপর হত্যা করেন দয়ারাম-‌ঘনিষ্ঠ আরও আধডজন মানুষকে।
পান সিং তারপরই গা ঢাকা দেন। মাঝেমধ্যে তাঁর কার্যকলাপ টের পাওয়া যেত ওই গ্রামে গুলি-‌গোলার আচমকা শব্দে। ধীরে ধীরে একসময় চম্বলের ডাকাতদের একটি গোষ্ঠীর নেতা হয়ে ওঠেন। ‘‌দস্যুরাজ পান সিং, চম্বল কা শের’‌ বলে নিজের পরিচয় দিতে শুরু করেন। তখন আর শুধু নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তির জন্য নয়, পান সিংয়ের উপস্থিতি বোঝা যেত বিশাল চম্বল জুড়ে আরও অনেক অপরাধমূক কাজে। পুলিশ ও প্রশাসনের রাতের ঘুম কেড়ে নেন। দীর্ঘদিন ফেরার ছিলেন। অনেক চেষ্টাতেও পুলিশ ধরতে পারছিল না। কেউ খোঁজ দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করে পুলিশ। অবশেষে পাশের গ্রামের এক বাসিন্দা মোতিরামের কাছ থেকে পান সিংয়ের গতিবিধির খবর পায় পুলিশ। সেই অনুযায়ী ছক তৈরি হয়। পুলিশের সার্কেল ইনস্পেক্টর মহেন্দ্রপ্রতাপ সিং চৌহানের নেতৃত্বে স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের ৫০০ জনের দল পান সিংয়ের ডেরায় হানা দেয়। ১২ ঘণ্টা গুলির লড়াই চলে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী সেই লড়াইয়ে পান সিং ও তাঁর দলের আরও ১৪ জন নিহত হয়েছিলেন। এটা ১৯৮১ সালের ১ অক্টোবরের ঘটনা।
তখনকার কাগজের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মৃত্যুর আগে নাকি পান সিং কাতর গলায় বলেছিলেন, ‘‌এখানে কোনও রাজপুত আছে কি, যে আমাকে একটু জল দিতে পারে?‌’‌ ঘটনাচক্রে ওই পুলিশ দলে ছিলেন এক রাজপুত, হাবিলদার ত্রিভুবন সিং। জলের একটি বোতল নিয়ে পান সিংয়ের দিকে এগোচ্ছিলেন তিনি। সেটা দেখে সার্কেল ইনস্পেক্টর মহেন্দ্রপ্রতাপ সিং চৌহান চিৎকার করে ওঠেন, ‘‌ডাকাতের কোনও জাত হয় না, ওকে মরতে দাও।’‌
সেদিন সত্যিই কি পান সিং টোমার মারা গিয়েছিলেন?‌ এই প্রশ্নটা তুলে দিয়েছিলেন এশিয়াডে সোনাজয়ী সেই সারওয়ান সিং, যিনি ‘‌আবিস্কার’‌ করেছিলেন পান সিংকে। আর্থিক অনটনে আম্বালায় তখন ট্যাক্সি চালাতেন সারওয়ান। পুলিশ সরকারিভাবে পান সিংয়ের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করার বছর তিনেক পর আম্বালাতে গিয়েছিলাম। পান সিংয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই সারওয়ানকে বলেছিলেন, ‘‘‌‌পুলিশের সঙ্গে সেদিনের লড়াইয়ে ওর মারা যাওয়ার খবরটা মনে হয় ঠিক নয়। একদিন আম্বালার বাস স্ট্যান্ডের সামনের রাস্তায় আমি ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে, সামনে দিয়ে কয়েকজন সাধু যাচ্ছিল। ওদের মাঝ থেকে একজন ‘‌চাচাজি’‌ বলে আমাকে ডাকে। পান সিং যেভাবে ‘‌চাচাজি’‌ বলে আমাকে ডাকত, একেবারে সেভাবেই। এরপর আর কথা বাড়ায়নি। অন্য একজন সাধু শুধু বলেছিল,ওরা নৈনিতাল যাচ্ছে। গলার আওয়াজ শুনে আমার মনে হয়েছিল ওটা পান সিং।’‌’‌ 
২০১২ সালে পান সিংয়ের বায়োপিক বাজারে আসার পরে আরও একবার ফোনে কথা হয়েছিল সারওয়ান সিংয়ের সঙ্গে। পান সিংকে নিয়ে সিনেমা হওয়ায় তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। পাশাপাশি বলেছিলেন, ‘‌সিনেমার বেশ কিছু ঘটনার সঙ্গে বাস্তবের পান সিংয়ের মিল নেই। মনে হয় আকর্ষণীয় করার জন্য কোথাও কোথাও রদবদল বা অতিরঞ্জিত করতে হয়েছে। তাছাড়া ওর জীবনের অনেক কিছুই সেভাবে কখনও প্রকাশ্যে আসেনি। ওর অ্যাথলেটিক্স জীবনের কাহিনীও তো নানা জায়গায় নানাভাবে লেখা।’‌ এরপর সারওয়ানের সংযোজন, ‘‌আমি নাকি এশিয়ান গেমসের সোনার পদক দারিদ্র‌্যের জন্য বিক্রি করে দিয়েছি। এটাও ঠিক নয়। আমার বাড়িতে এখনও সাজানো আছে ওই সোনার পদক।’‌
পান সিং টোমারকে আমি কখনও দেখিনি। তবে একবার অল্প সময়ের জন্য দেখেছিলাম ওঁর বিধবা স্ত্রী ইন্দিরাকে। হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদকে নিয়ে একটি বই লেখার জন্য আটের দশকের শেষ দিকে কয়েকবার ঝাঁসিতে গিয়েছি। ওই রকমই এক সফরে ধ্যানচাঁদ-‌পুত্র অশোককুমার ওখানকার এক তরুণ মুকেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘‌এখানে যাঁরা বাবা সম্পর্কে পুরনো দিনের কথা বলতে পারবেন, ও তাঁদের সবার কাছে নিয়ে যাবে।’‌ শুধু ঝাঁসি শহরে নয়, জেলার অনেক জায়গাতেই ওঁর সঙ্গে গিয়েছি। একদিন ঝাঁসি জেলার বাবিনায় গিয়েছি। এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে মুকেশ বলেন, ‘‌পান সিংয়ের নাম শুনেছেন?‌ উনি তাঁর স্ত্রী ইন্দিরা। পান সিং নিহত হওয়ার পর ভিদোসা ছেড়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে উনি এখন এখানেই থাকেন।’‌ এগিয়ে গিয়ে পান সিং টোমার সম্পর্কে কিছু কথা শোনার আগ্রহ প্রকাশ করায় তিনি বললেন, ‘‌এখন মন ভালো নেই। পরে একদিন আসবেন অনেক কথা বলব।’‌ মন ভাল না থাকার কারণটা জানালেন মুকেশ। কয়েকদিন আগেই পান সিং-‌ইন্দিরার বড় ছেলে হনুমন্ত দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। পরে আর ঝাঁসি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ওঁর কাছ থেকে পান সিং টোমারের গল্পও আর শোনা হয়নি।



Saturday, May 2, 2020

চুনী গোস্বামীর ফুটবল শিক্ষাগুরু বলাইদাস জড়িয়ে বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও



ভালো ফুটবল খেললেও কোচ হিসেবেই বিখ্যাত বলাইদাস চ্যাটার্জি। ফুটবল কোচ হিসেবে সাফল্যে হারিয়ে গিয়েছে তাঁর আরও অনেক পরিচয়। যেমন ছিলেন ভালো অ্যাথলিট। খেলতেন হকি, ক্রিকেট, বাস্কেটবল। ছিলেন উন্নতমানের বক্সার। তিনি জড়িয়ে ভারতীয় বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও।


চুনী গোস্বামীর ফুটবল শিক্ষাগুরু বলাইদাস
জড়িয়ে বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও 


নির্মলকুমার সাহা


ভালো ফুটবল খেলতেন। তবু ভারতে ফুটবল কোচ হিসেবেই বিখ্যাত বি ডি চ্যাটার্জি। যাঁর পুরো নাম বলাইদাস চ্যাটার্জি। ফুটবল কোচ হিসেবে সাফল্যে হারিয়ে গিয়েছে তাঁর আরও অনেক পরিচয়। যেমন বলাইদাস ছিলেন ভালো অ্যাথলিট। খেলতেন হকি, ক্রিকেট, বাস্কেটবল। ছিলেন উন্নতমানের বক্সার। বক্সিংয়ের প্রথম জীবনে ছিলেন মিলটন কিউবসের ছাত্র। পরে অন্যদের দেখে নিজেই শিখতেন। বলাইদাস চ্যাটার্জি জড়িয়ে ভারতীয় বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও।
১৬ জানুয়ারি ১৯২৬। ভবানীপুর কিং কার্নিভালে বক্সিং রিংয়ে বলাইদাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সার্জেন্ট ডে। ভারতের নামী বক্সার তিনি। রেলওয়ে পুলিশের ওই সার্জেন্ট বলাইদাসের ঘুসি সহ্য করতে পারেননি। রিং থেকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে। সেখানে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে জানা যায়, সার্জেন্ট ডে অসুস্থ ছিলেন। ডাঃ ই ডব্লু বাসেল তাঁকে পরীক্ষা করে রিংয়ে নামার অনুমতি দিয়েছিলেন। ওই ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। তা যাই হোক, ওটাই বাংলা তথা ভারতে খেলতে খেলতে মৃত্যুর প্রথম ঘটনা।
সদ্য প্রয়াত চুনী গোস্বামীর ফুটবল শিক্ষাগুরু ছিলেন বলাইদাস। গুরু-‌শিষ্যর প্রথম সাক্ষাৎ অবশ্য একটি বিতর্কের মধ্য দিয়েই। চুনীর বয়স তখন ৮, বলাইদাসের ৪৬ বছর। কীভাবে দেখা হয়েছিল দুজনের?‌ কী সেই বিতর্ক?‌ আত্মজীবনীতে (‌খেলতে খেলতে)‌ চুনী গোস্বামী যা বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। সেটা ১৯৪৬ সালের কথা। চুনী লিখেছেন, ‘‌‘‌আমরা, পাড়ার ছেলেরা দুই দলে ভাগ হয়ে খেলছি দেশপ্রিয় পার্কে। দাদা এক দলে, আমি আরেক দলে। সকলের পায়ের জুতো জড়ো করে মাঠের দুদিকে গোল পোস্ট বানানো হয়েছে। দুই দলে শুরু হল জোর খেলা। হঠাৎ একটা বল পেয়ে তিন চারজনকে কাটিয়ে আমি একটা শট মারতেই জুতোর গোল পোস্ট ভেঙে বল ঢুকে গেল গোলে। গো-‌ও-‌ল বলে আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের দলের আর সবাইও চিৎকার করতে করতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। দাদা ছুটে এসে বলল, ‘‌না, গোল হয়নি’‌। ওদের দলের আর সবাইও দাদার সঙ্গে গলা মিলিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে আরম্ভ করল। আমি বললাম, ‘‌আলবত গোল হয়েছে’‌‌। দাদার যুক্তি, ‘‌যদি গোল পোস্ট থাকত নিশ্চয়ই পোস্টে লেগে বল ফিরে আসত। সুতরাং গোল হতে পারে না’‌‌। আমি বললাম, ‘‌জুতোই যখন গোল পোস্ট এবং জুতোসমেত বল যখন গোলে ঢুকেছে তখন নিশ্চয়ই গোল’‌‌। গোল নিয়ে গন্ডগোল আর থামে না। অনেকক্ষণ ধরে কথা কাটাকাটি চলল। শেষ পর্যন্ত মারামারি বাধার উপক্রম।’’‌
‌এরকম সময়েই ওখানে ছেলেদের মাঝে এসে দাঁড়ান বলাইদাস চ্যাটার্জি। তিনি গোলের পেছনের বেঞ্চিতে বসে অনেকক্ষণ ধরে ছোটদের ওই ঝগড়া দেখছিলেন। এবার ছেলেদের কাছে এসে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তারপর চুনীকে কাছে ডেকে ওই ‌শটটির প্রশংসা করেও বলেন, ‘‌কিন্তু গোল হয়নি‌।’‌ এতেও চুনীকে শান্ত করা যায়নি। আত্মজীবনীতে চুনী লিখেছেন, ‘‌‘বললাম, ‌আপনার কথা আমরা মানব কেন?‌ আপনি বললেই হল?‌‌‌ ইতিমধ্যে বেশ ভিড় জমে গেছে। আমাদের দলের দু’‌তিনজন বন্ধু সমর্থক বলল, ‌‘‌যাকগে, উনি যখন বলছেন, ছেড়ে দে’‌‌। আমি বললাম, ‌‘‌ছাড়ব কেন?‌ উনি কে?‌’‌‌ এক বন্ধু বলল, ‌‘‌জানিস না?‌ উনিই হচ্ছেন বিখ্যাত খেলোয়াড় বি ডি চ্যাটার্জি। এখন মোহনবাগান ক্লাবের ও ভারতীয় দলের ফুটবল কোচ। একজন বড় রেফারিও’‌‌। আমি আর প্রতিবাদ করতে পারলাম না। বলাইদা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‌‘‌তুমি তো সুন্দর খেল। আমি তোমাকে খেলা শেখাব’‌‌।.‌.‌.‌বলাইদার সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয় এবং বলতে গেলে সেইদিন থেকে চুনী গোস্বামীর খেলোয়াড়-‌জীবনের সূচনা। সেইদিন থেকেই বলাইদা আমার শিক্ষাগুরু এবং অভিভাবকের মতো হয়ে উঠলেন। তাঁরই হাত ধরে মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুতে আমার প্রবেশ।’‌
বলাইদাস চ্যাটার্জি আর চুনী গোস্বামীর মেলবন্ধনের বাকিটা তো ইতিহাস।
বলাইদাস চ্যাটার্জির জন্ম ১৯০০ সালের ১০ মার্চ। জীবনের শুরুটা ছিল কঠিন। মাত্র দেড় বছর বয়সেই মা মারা যান। বয়স যখন দশ, হারান বাবাকে। শৈশবের অনেকটা সময় মা-‌বাবা হারা বলাইদাসের কেটেছে দাদুর কাছে হুগলি জেলার ডুমুরদহে। পরে কলকাতায় দাদার কাছে চলে আসেন। উত্তর কলকাতায় দাদার কাছে থেকেই চলতে থাকে লেখাপড়া, খেলাধুলো। অ্যাথলিট হিসেবেই মোহনবাগানে প্রথম যোগ দেওয়া। পরে ১৯২১ সালে সবুজ-‌মেরুনে সই করেন ফুটবলার বলাইদাস। তার আগের তিন বছর (‌১৯১৮-‌১৯২০)‌ ফুটবল খেলেছেন এরিয়ানের হয়ে। এভাবেই মোহনবাগানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। যে সম্পর্ক আর কখনও ছিন্ন হয়নি। মোহনবাগানের হয়ে  অ্যাথলেটিক্স, ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, হকিও খেলেছেন। ওঁর এবং পি সি ব্যানার্জির হাত ধরেই মোহনবাগানের অ্যাথলেটিক্সের উত্থান। ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার আগেই অ্যাথলিট হিসেবে সারা ভারতে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন বলাইদাস।
ঠিক হয় ১৯২০ সালে অ্যান্টুওয়ার্প অলিম্পিকে ভারত অ্যাথলেটিক্স দল পাঠাবে। ভারতীয় দল গড়ার জন্য ট্রায়ালের আয়োজন করা হয়েছিল পুনেয়। সেখানে ডাক পেয়েছিলেন বলাইদাস। অনেকেই ভেবেছিলেন অলিম্পিকের দলেও সুযোগ পেয়ে যাবেন। আশায় ছিলেন বলাইদাসও। কিন্তু মোহনবাগানের আরেক অ্যাথলিট পি সি ব্যানার্জি সুযোগ পেলেও বলাইদাস পাননি। ফলে তাঁর আর অলিম্পিয়ান হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু পরে দুবার দুটি আলাদা খেলার কোচ হিসেবে অলিম্পিকে গিয়েছেন। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে ছিলেন ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ। আর তার পরেরবার ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ছিলেন ভারতীয় বক্সিং দলের কোচ-‌কাম-‌সহকারী ম্যানেজার।
অ্যান্টুওয়ার্প অলিম্পিকের ভারতীয় দলে সুযোগ না পেয়ে এতটাই হতাশ হয়েছিলেন, শোনা যায়, কলকাতা ফেরার পথে ট্রেনে বসেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জানতে পেরে এক বন্ধু অনেক বুঝিয়ে বিরত করেছিলেন।
ওই সময়ে বাংলার অন্যতম সেরা অ্যাথলিট ছিলেন বলাইদাস। তিনি ছিলেন অলরাউন্ড অ্যাথলিট। বিভিন্ন ইভেন্ট করতেন। দৌড়, হার্ডলস, হাই জাম্প, লং জাম্প— কোনওটাতেই পিছিয়ে ছিলেন না। ১৯২৪ সালে প্রথম বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপে ৭টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৬টিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ২২০ গজ দৌড়, ৪৪০ গজ দৌড়, ১১০ গজ হার্ডলস, ২২০ গজ হার্ডলস, লং জাম্প ও হাই জাম্প। বাংলায় পেন্টাথলন শুরু হয় তাঁরই উদ্যোগে। বেঙ্গল মিটে চ্যাম্পিয়নও হন পেন্টাথলনে। তখন ভারতীয় অলিম্পিক মিট হত। তাতেও পেন্টাথলনে একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
১৯২৩ সালে মোহনবাগান হকি দলের অধিনায়ক ছিলেন বলাইদাস। সেবার দ্বিতীয় ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের বছর প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায় মোহনবাগান। তখন মোহনবাগানের ফুটবল দলেরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ওই বছরই খেলেছিলেন আই এফ এ শিল্ড ফাইনাল। সেবারই রোভার্স কাপে প্রথম খেলার আমন্ত্রণ পায় মোহনবাগান। খেলেন বলাইদাসও। পরের বছর প্রথম খেলেন ডুরান্ড কাপে। তখন মোহনবাগানের নিয়মিত সেন্টার হাফ তিনি। ১৯২৪ সালে জাভা সফরে বেঙ্গল জিমখানা দলেও ছিলেন। তখন প্রতিবছরই হত ইউরোপিয়ান্স বনাম ইন্ডিয়ান্স একাদশের একটি করে খেলা। মোট পাঁচবার (‌১৯২০, ১৯২১, ১৯২৩, ১৯২৪ ও ১৯২৫ সালে)‌ ইন্ডিয়ান্স একাদশের হয়ে ওই ম্যাচ খেলেছেন। ১৯২৭ সালে প্রচণ্ড চোট পান হাঁটুতে। মালাইচাকি ভেঙে যায়। ফলে ফুটবল, হকি থেকে সরে যান। মাঝেমধ্যে অবশ্য মাঠে নেমেছেন। কিন্তু আগের সেই দাপট আর ছিল না। ক্রিকেট অবশ্য তারপরও খেলেছেন নিয়মিত। ওই চোটের কারণে একসময় সব খেলা থেকেই দূরে সরে যেতে হয়। তখন থেকেই নিজেকে কোচ হিসেবে তৈরি করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। শুরু করেন ফুটবল রেফারিংও।
১৯৩৯ সালে মোহনবাগান প্রথম কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই দলের কোচ (‌তখন অবশ্য ট্রেনার বলা হত)‌ ছিলেন বলাইদাস। তাঁর কোচিংয়েই ১৯৫৪ সালে মোহনবাগানের প্রথম দ্বিমুকুট (‌লিগ ও শিল্ড)‌ জয়। দীর্ঘদিন মোহনবাগানের ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ছিলেন মোহনবাগানের ফুটবল সচিব।
ছোটদের খেলা শেখাতেও ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর উদ্যোগেই মোহনবাগানে ছোটদের দল তৈরি হয়, ১৯৪৪ সালে। তাঁর কোচিংয়ে বাংলা সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে একাধিকবার।
ফুটবল রেফারি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে চীনের একটি দল এসেছিল কলকাতায়। সিভিল মিলিটারির বিরুদ্ধে খেলায় রেফারি ছিলেন বলাইদাস। ইন্ডিয়ান্স বনাম ইউরোপিয়ান্স খেলায় তিনবার (‌১৯৩৭, ১৯৩৮ ও ১৯৪০)‌ বাঁশি মুখে মাঠে নেমেছিলেন।
কলকাতায় বেসবল ও রাগবি খেলার প্রবর্তকও তিনি। একসময় মহিলাদের ফুটবল খেলা শেখানোর চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। নানা কারণে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। পরে অবশ্য এখানে মহিলাদের ফুটবল খেলানো শুরু করেন সুশীল ভট্টাচার্য।
খাঁটি মোহনবাগানী বলতে যা বোঝায় বলাইদাস ছিলেন ঠিক তাই। যতদিন বেঁচে ছিলেন (‌মৃত্যু ৯ মার্চ, ১৯৭৪)‌ জড়িয়ে ছিলেন মোহনবাগানের সঙ্গেই। ২০১৩ সালে মরণোত্তর ‘‌মোহনবাগানরত্ন’‌ দেওয়া হয় বলাইদাস চ্যাটার্জিকে।



আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...