অলিম্পিকে জোড়া সোনা
জিতে পাওয়া বন্দুকের
গুলিতে আত্মহত্যা!
নির্মলকুমার সাহা
(আজ ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিক্স ডে। এই বিশেষ দিনে ১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে সোনাজয়ী পার্সি উইলিয়ামসকে নিয়ে দু-চার কথা।)
১৫ বছর বয়সে কঠিন বাতঘটিত জ্বরে আক্রান্ত। ডাক্তার দেখিয়ে, অনেক চিকিৎসা করিয়েও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছিল, বেশি পরিশ্রমের কোনও ফিজিক্যাল ট্রেনিং করা যাবে না। কিন্তু শৈশব থেকেই তো নানা খেলায় উৎসাহী। ডাক্তারের ওই নির্দেশ কী করে মানা সম্ভব? কী করে ছেড়ে দেবেন প্রিয় অ্যাথলেটিক্স? ডাক্তারের সেই নির্দেশ অমান্য করেই একদিন স্কুলের প্রয়োজনে নেমে পড়েন একটি অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায়। তাতে সাফল্য পাওয়ায় ১৯২৪ সাল থেকে ফের পুরোপুরি স্প্রিন্টের অনুশীলন শুরু। ১৯২৭ সালের মধ্যেই পার্সি উইলিয়ামস হয়ে ওঠেন স্প্রিন্টে কানাডার মুখ।
১৯২৮ সালে কানাডার অলিম্পিক ট্রায়ালে ১০০ ও ২০০ মিটার দুটোতেই চ্যাম্পিয়ন। শুধু তাই নয়, ১০০ মিটারে তখনকার অলিম্পিক রেকর্ড (১০.৬ সেকেন্ড) স্পর্শ করেন। তখন পার্সির কোচ ছিলেন বব গ্র্যাঙ্গার। পার্সি অলিম্পিকের ছাড়পত্র পেলেও কোচ হিসেবে বব গ্র্যাঙ্গারকে আমস্টারডাম পাঠাতে কানাডা রাজি ছিল না। নিজের পয়সায় আমস্টারডাম যাওয়াও তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব। কারণ বব গ্র্যাঙ্গার ট্রেনে ডাইনিং কারে বাসন পরিস্কারের অতি সামান্য একটা কাজ করতেন। কোচ ববকে আমস্টারডাম পাঠানোর উদ্যোগ নেন পার্সির মা ও ভ্যাঙ্কুবারের অ্যাথলেটিক্সপ্রেমীরা। তাঁরা ববের আমস্টারডাম যাওয়ার খরচ দিয়েছিলেন চাঁদা তুলে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, বব সঙ্গে গেলে পার্সি অলিম্পিকে সোনা জিতবেনই। তাঁদের ওই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছিলেন পার্সি উইলিয়য়ামস। সেবার অলিম্পিকে তিনি জোড়া সোনা জিতেছিলেন। ১০০ ও ২০০ মিটারে। ৪x১০০ মিটার রিলে দলেও পার্সি ছিলেন। ফাইনালে কানাডার রিলে দল বাতিল হয়ে গিয়েছিল। ১০০ মিটারে সোনা জিততে সময় নিয়েছিলেন ১০.৮ সেকেন্ড। রুপো ও ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন যথাক্রমে গ্রেট ব্রিটেনের জ্যাক লন্ডন (১০.৯) ও জার্মানির জর্জ ল্যামার্স (১০.৯)। কানাডার কোনও অ্যাথলিটের অলিম্পিকে ১০০ মিটারে সেই প্রথম সোনা জয়। ২০০ মিটার সোনা জিততে পার্সির সময় লেগেছিল ২১.৮ সেকেন্ড। স্বভাবতই দেশে ফিরে পেয়েছিলেন বীরের সংবর্ধনা। পেয়েছিলেন নানা উপহার। যার মধ্যে ছিল একটি গাড়িও। পরে ভ্যাঙ্কুবারে একটি অ্যাথলেটিক্স স্টেডিয়াম গড়ে ওঠে পার্সির নামে। ওই স্টেডিয়ামে রয়েছে পার্সির মূর্তিও।
এখনকার কমনওয়েলথ গেমসের আগে নাম ছিল ব্রিটিশ এম্পায়ার গেমস। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ এম্পায়ার গেমসের প্রথম আসরে ১০০ গজের দৌড়েও সোনা জিতেছিলেন পার্সি। ওই প্রতিযোগিতার সময়ই পায়ের পেশিতে টান ধরে। তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই পেশির ওই সমস্যায় ভুগতেন। তা সত্ত্বেও ১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলেস অলিম্পিকেও কানাডা দলে সুযোগ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেবার ফল ভালো হয়নি। ১০০ মিটারে বিদায় নিয়েছিলেন সেমিফাইনালে। কানাডার রিলে দলেও ছিলেন। রিলে দল পেয়েছিল চতুর্থ স্থান।
এরপরই প্রতিযোগিতামূলক অ্যাথলেটিক্স থেকে সরে দাঁড়ান। একটি বিমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও।
পার্সি উইলিয়ামসের জন্ম ১৯০৮ সালের ১৯ মে। বাবা ছিলেন ট্রামের কন্ডাকটর। শৈশব থেকেই নানা খেলায় উৎসাহ ছিল পার্সির। জীবনের প্রথম পদক পাওয়া সেই শৈশবে সাইকেল রেসে। টেনিসও খেলতেন তখন। আরেকটা প্রিয় খেলা ছিল শুটিং। পরে সব ছেড়ে অ্যাথলেটিক্স নিয়েই মেতেছিলেন। পার্সি যখন খুব ছোট, তখনই মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সেই থেকে পার্সি মা-র কাছেই। আমস্টারডাম অলিম্পিকেও সঙ্গে গিয়েছিলেন মা চার্লটন। পার্সি বিয়ে করেননি। মাকে নিয়েই ছিল তাঁর সংসার। ১৯৭৭ সালে মা-র মৃত্যুর পর বড্ড একা হয়ে পড়েন। কৈশোরের সেই বাতের রোগ থেকে কখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি। মাঝেমধ্যেই ভুগতেন। বৃদ্ধ বয়সে সেই রোগটা আবার বেশিভাবে দেখা দেয়। ভীষণ কষ্ট পেতেন। একাকিত্বের জন্য মানসিক অবসাদও দেখা দেয়। অলিম্পিক থেকে জিতে আনা দুটি সোনার পদকই ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে দিয়ে দেন বি সি স্পোর্টস হল অফ ফেমে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই পদক দুটি চুরি হয়ে যায়। তাতে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। মদ্য পান বাড়িয়ে দেন। শেষ বয়সে তাঁর একমাত্র যাতায়াত ছিল স্থানীয় এক গল্ফ ক্লাবে। মদের বোতল চুরির দায়ে একদিন সেই ক্লাব থেকেও পার্সিকে বের করে দেওয়া হয়। এতে আরও ভেঙে পড়েন।
ভালবাসতেন নানারকম বন্দুক সংগ্রহ করতে। বাড়িতে অনেক বন্দুক ছিল। যার মধ্যে একটি অলিম্পিকে জোড়া সোনা জিতে দেশে ফেরার পর উপহার পেয়েছিলেন। ভ্যাঙ্কুবারে নিজের বাড়িতে সেই বন্দুকটি থেকেই মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন ১৯৮২ সালের ২৯ নভেম্বর।
জন্ম: ১৯ মে, ১৯০৮।
মৃত্যু: ২৯ নভেম্বর, ১৯৮২।
No comments:
Post a Comment