Saturday, May 2, 2020

চুনী গোস্বামীর ফুটবল শিক্ষাগুরু বলাইদাস জড়িয়ে বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও



ভালো ফুটবল খেললেও কোচ হিসেবেই বিখ্যাত বলাইদাস চ্যাটার্জি। ফুটবল কোচ হিসেবে সাফল্যে হারিয়ে গিয়েছে তাঁর আরও অনেক পরিচয়। যেমন ছিলেন ভালো অ্যাথলিট। খেলতেন হকি, ক্রিকেট, বাস্কেটবল। ছিলেন উন্নতমানের বক্সার। তিনি জড়িয়ে ভারতীয় বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও।


চুনী গোস্বামীর ফুটবল শিক্ষাগুরু বলাইদাস
জড়িয়ে বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও 


নির্মলকুমার সাহা


ভালো ফুটবল খেলতেন। তবু ভারতে ফুটবল কোচ হিসেবেই বিখ্যাত বি ডি চ্যাটার্জি। যাঁর পুরো নাম বলাইদাস চ্যাটার্জি। ফুটবল কোচ হিসেবে সাফল্যে হারিয়ে গিয়েছে তাঁর আরও অনেক পরিচয়। যেমন বলাইদাস ছিলেন ভালো অ্যাথলিট। খেলতেন হকি, ক্রিকেট, বাস্কেটবল। ছিলেন উন্নতমানের বক্সার। বক্সিংয়ের প্রথম জীবনে ছিলেন মিলটন কিউবসের ছাত্র। পরে অন্যদের দেখে নিজেই শিখতেন। বলাইদাস চ্যাটার্জি জড়িয়ে ভারতীয় বক্সিংয়ের একটি ট্র‌্যাজেডির সঙ্গেও।
১৬ জানুয়ারি ১৯২৬। ভবানীপুর কিং কার্নিভালে বক্সিং রিংয়ে বলাইদাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সার্জেন্ট ডে। ভারতের নামী বক্সার তিনি। রেলওয়ে পুলিশের ওই সার্জেন্ট বলাইদাসের ঘুসি সহ্য করতে পারেননি। রিং থেকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে। সেখানে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে জানা যায়, সার্জেন্ট ডে অসুস্থ ছিলেন। ডাঃ ই ডব্লু বাসেল তাঁকে পরীক্ষা করে রিংয়ে নামার অনুমতি দিয়েছিলেন। ওই ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। তা যাই হোক, ওটাই বাংলা তথা ভারতে খেলতে খেলতে মৃত্যুর প্রথম ঘটনা।
সদ্য প্রয়াত চুনী গোস্বামীর ফুটবল শিক্ষাগুরু ছিলেন বলাইদাস। গুরু-‌শিষ্যর প্রথম সাক্ষাৎ অবশ্য একটি বিতর্কের মধ্য দিয়েই। চুনীর বয়স তখন ৮, বলাইদাসের ৪৬ বছর। কীভাবে দেখা হয়েছিল দুজনের?‌ কী সেই বিতর্ক?‌ আত্মজীবনীতে (‌খেলতে খেলতে)‌ চুনী গোস্বামী যা বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। সেটা ১৯৪৬ সালের কথা। চুনী লিখেছেন, ‘‌‘‌আমরা, পাড়ার ছেলেরা দুই দলে ভাগ হয়ে খেলছি দেশপ্রিয় পার্কে। দাদা এক দলে, আমি আরেক দলে। সকলের পায়ের জুতো জড়ো করে মাঠের দুদিকে গোল পোস্ট বানানো হয়েছে। দুই দলে শুরু হল জোর খেলা। হঠাৎ একটা বল পেয়ে তিন চারজনকে কাটিয়ে আমি একটা শট মারতেই জুতোর গোল পোস্ট ভেঙে বল ঢুকে গেল গোলে। গো-‌ও-‌ল বলে আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের দলের আর সবাইও চিৎকার করতে করতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। দাদা ছুটে এসে বলল, ‘‌না, গোল হয়নি’‌। ওদের দলের আর সবাইও দাদার সঙ্গে গলা মিলিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে আরম্ভ করল। আমি বললাম, ‘‌আলবত গোল হয়েছে’‌‌। দাদার যুক্তি, ‘‌যদি গোল পোস্ট থাকত নিশ্চয়ই পোস্টে লেগে বল ফিরে আসত। সুতরাং গোল হতে পারে না’‌‌। আমি বললাম, ‘‌জুতোই যখন গোল পোস্ট এবং জুতোসমেত বল যখন গোলে ঢুকেছে তখন নিশ্চয়ই গোল’‌‌। গোল নিয়ে গন্ডগোল আর থামে না। অনেকক্ষণ ধরে কথা কাটাকাটি চলল। শেষ পর্যন্ত মারামারি বাধার উপক্রম।’’‌
‌এরকম সময়েই ওখানে ছেলেদের মাঝে এসে দাঁড়ান বলাইদাস চ্যাটার্জি। তিনি গোলের পেছনের বেঞ্চিতে বসে অনেকক্ষণ ধরে ছোটদের ওই ঝগড়া দেখছিলেন। এবার ছেলেদের কাছে এসে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তারপর চুনীকে কাছে ডেকে ওই ‌শটটির প্রশংসা করেও বলেন, ‘‌কিন্তু গোল হয়নি‌।’‌ এতেও চুনীকে শান্ত করা যায়নি। আত্মজীবনীতে চুনী লিখেছেন, ‘‌‘বললাম, ‌আপনার কথা আমরা মানব কেন?‌ আপনি বললেই হল?‌‌‌ ইতিমধ্যে বেশ ভিড় জমে গেছে। আমাদের দলের দু’‌তিনজন বন্ধু সমর্থক বলল, ‌‘‌যাকগে, উনি যখন বলছেন, ছেড়ে দে’‌‌। আমি বললাম, ‌‘‌ছাড়ব কেন?‌ উনি কে?‌’‌‌ এক বন্ধু বলল, ‌‘‌জানিস না?‌ উনিই হচ্ছেন বিখ্যাত খেলোয়াড় বি ডি চ্যাটার্জি। এখন মোহনবাগান ক্লাবের ও ভারতীয় দলের ফুটবল কোচ। একজন বড় রেফারিও’‌‌। আমি আর প্রতিবাদ করতে পারলাম না। বলাইদা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‌‘‌তুমি তো সুন্দর খেল। আমি তোমাকে খেলা শেখাব’‌‌।.‌.‌.‌বলাইদার সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয় এবং বলতে গেলে সেইদিন থেকে চুনী গোস্বামীর খেলোয়াড়-‌জীবনের সূচনা। সেইদিন থেকেই বলাইদা আমার শিক্ষাগুরু এবং অভিভাবকের মতো হয়ে উঠলেন। তাঁরই হাত ধরে মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুতে আমার প্রবেশ।’‌
বলাইদাস চ্যাটার্জি আর চুনী গোস্বামীর মেলবন্ধনের বাকিটা তো ইতিহাস।
বলাইদাস চ্যাটার্জির জন্ম ১৯০০ সালের ১০ মার্চ। জীবনের শুরুটা ছিল কঠিন। মাত্র দেড় বছর বয়সেই মা মারা যান। বয়স যখন দশ, হারান বাবাকে। শৈশবের অনেকটা সময় মা-‌বাবা হারা বলাইদাসের কেটেছে দাদুর কাছে হুগলি জেলার ডুমুরদহে। পরে কলকাতায় দাদার কাছে চলে আসেন। উত্তর কলকাতায় দাদার কাছে থেকেই চলতে থাকে লেখাপড়া, খেলাধুলো। অ্যাথলিট হিসেবেই মোহনবাগানে প্রথম যোগ দেওয়া। পরে ১৯২১ সালে সবুজ-‌মেরুনে সই করেন ফুটবলার বলাইদাস। তার আগের তিন বছর (‌১৯১৮-‌১৯২০)‌ ফুটবল খেলেছেন এরিয়ানের হয়ে। এভাবেই মোহনবাগানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। যে সম্পর্ক আর কখনও ছিন্ন হয়নি। মোহনবাগানের হয়ে  অ্যাথলেটিক্স, ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, হকিও খেলেছেন। ওঁর এবং পি সি ব্যানার্জির হাত ধরেই মোহনবাগানের অ্যাথলেটিক্সের উত্থান। ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার আগেই অ্যাথলিট হিসেবে সারা ভারতে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন বলাইদাস।
ঠিক হয় ১৯২০ সালে অ্যান্টুওয়ার্প অলিম্পিকে ভারত অ্যাথলেটিক্স দল পাঠাবে। ভারতীয় দল গড়ার জন্য ট্রায়ালের আয়োজন করা হয়েছিল পুনেয়। সেখানে ডাক পেয়েছিলেন বলাইদাস। অনেকেই ভেবেছিলেন অলিম্পিকের দলেও সুযোগ পেয়ে যাবেন। আশায় ছিলেন বলাইদাসও। কিন্তু মোহনবাগানের আরেক অ্যাথলিট পি সি ব্যানার্জি সুযোগ পেলেও বলাইদাস পাননি। ফলে তাঁর আর অলিম্পিয়ান হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু পরে দুবার দুটি আলাদা খেলার কোচ হিসেবে অলিম্পিকে গিয়েছেন। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে ছিলেন ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ। আর তার পরেরবার ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ছিলেন ভারতীয় বক্সিং দলের কোচ-‌কাম-‌সহকারী ম্যানেজার।
অ্যান্টুওয়ার্প অলিম্পিকের ভারতীয় দলে সুযোগ না পেয়ে এতটাই হতাশ হয়েছিলেন, শোনা যায়, কলকাতা ফেরার পথে ট্রেনে বসেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জানতে পেরে এক বন্ধু অনেক বুঝিয়ে বিরত করেছিলেন।
ওই সময়ে বাংলার অন্যতম সেরা অ্যাথলিট ছিলেন বলাইদাস। তিনি ছিলেন অলরাউন্ড অ্যাথলিট। বিভিন্ন ইভেন্ট করতেন। দৌড়, হার্ডলস, হাই জাম্প, লং জাম্প— কোনওটাতেই পিছিয়ে ছিলেন না। ১৯২৪ সালে প্রথম বেঙ্গল চ্যাম্পিয়নশিপে ৭টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৬টিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ২২০ গজ দৌড়, ৪৪০ গজ দৌড়, ১১০ গজ হার্ডলস, ২২০ গজ হার্ডলস, লং জাম্প ও হাই জাম্প। বাংলায় পেন্টাথলন শুরু হয় তাঁরই উদ্যোগে। বেঙ্গল মিটে চ্যাম্পিয়নও হন পেন্টাথলনে। তখন ভারতীয় অলিম্পিক মিট হত। তাতেও পেন্টাথলনে একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
১৯২৩ সালে মোহনবাগান হকি দলের অধিনায়ক ছিলেন বলাইদাস। সেবার দ্বিতীয় ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের বছর প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায় মোহনবাগান। তখন মোহনবাগানের ফুটবল দলেরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ওই বছরই খেলেছিলেন আই এফ এ শিল্ড ফাইনাল। সেবারই রোভার্স কাপে প্রথম খেলার আমন্ত্রণ পায় মোহনবাগান। খেলেন বলাইদাসও। পরের বছর প্রথম খেলেন ডুরান্ড কাপে। তখন মোহনবাগানের নিয়মিত সেন্টার হাফ তিনি। ১৯২৪ সালে জাভা সফরে বেঙ্গল জিমখানা দলেও ছিলেন। তখন প্রতিবছরই হত ইউরোপিয়ান্স বনাম ইন্ডিয়ান্স একাদশের একটি করে খেলা। মোট পাঁচবার (‌১৯২০, ১৯২১, ১৯২৩, ১৯২৪ ও ১৯২৫ সালে)‌ ইন্ডিয়ান্স একাদশের হয়ে ওই ম্যাচ খেলেছেন। ১৯২৭ সালে প্রচণ্ড চোট পান হাঁটুতে। মালাইচাকি ভেঙে যায়। ফলে ফুটবল, হকি থেকে সরে যান। মাঝেমধ্যে অবশ্য মাঠে নেমেছেন। কিন্তু আগের সেই দাপট আর ছিল না। ক্রিকেট অবশ্য তারপরও খেলেছেন নিয়মিত। ওই চোটের কারণে একসময় সব খেলা থেকেই দূরে সরে যেতে হয়। তখন থেকেই নিজেকে কোচ হিসেবে তৈরি করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। শুরু করেন ফুটবল রেফারিংও।
১৯৩৯ সালে মোহনবাগান প্রথম কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই দলের কোচ (‌তখন অবশ্য ট্রেনার বলা হত)‌ ছিলেন বলাইদাস। তাঁর কোচিংয়েই ১৯৫৪ সালে মোহনবাগানের প্রথম দ্বিমুকুট (‌লিগ ও শিল্ড)‌ জয়। দীর্ঘদিন মোহনবাগানের ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ছিলেন মোহনবাগানের ফুটবল সচিব।
ছোটদের খেলা শেখাতেও ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর উদ্যোগেই মোহনবাগানে ছোটদের দল তৈরি হয়, ১৯৪৪ সালে। তাঁর কোচিংয়ে বাংলা সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে একাধিকবার।
ফুটবল রেফারি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে চীনের একটি দল এসেছিল কলকাতায়। সিভিল মিলিটারির বিরুদ্ধে খেলায় রেফারি ছিলেন বলাইদাস। ইন্ডিয়ান্স বনাম ইউরোপিয়ান্স খেলায় তিনবার (‌১৯৩৭, ১৯৩৮ ও ১৯৪০)‌ বাঁশি মুখে মাঠে নেমেছিলেন।
কলকাতায় বেসবল ও রাগবি খেলার প্রবর্তকও তিনি। একসময় মহিলাদের ফুটবল খেলা শেখানোর চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। নানা কারণে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। পরে অবশ্য এখানে মহিলাদের ফুটবল খেলানো শুরু করেন সুশীল ভট্টাচার্য।
খাঁটি মোহনবাগানী বলতে যা বোঝায় বলাইদাস ছিলেন ঠিক তাই। যতদিন বেঁচে ছিলেন (‌মৃত্যু ৯ মার্চ, ১৯৭৪)‌ জড়িয়ে ছিলেন মোহনবাগানের সঙ্গেই। ২০১৩ সালে মরণোত্তর ‘‌মোহনবাগানরত্ন’‌ দেওয়া হয় বলাইদাস চ্যাটার্জিকে।



No comments:

Post a Comment

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...