ভারতের সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশিল তৈরিতে জয়পালের বিশেষ অবদান ছিল। ছিলেন অসামান্য বক্তা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনিকে বিয়ে করলেও সেই পরিবারের রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন।
জয়পাল ছিলেন
আদিবাসীদের
অন্যতম কণ্ঠস্বর
নির্মলকুমার সাহা

ভারতের প্রথম অলিম্পিক হকি দল গড়া নিয়ে বিশেষ সমস্যা বা বিতর্ক ছিল না। কিন্তু অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে অনেক নাটক, অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান’ নাকি ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান’ ? অধিনায়ক বাছার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য একেবারে আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি জয়পাল সিং মুন্ডাকে অধিনায়ক করা হয়েছিল। কিন্তু টানা পাঁচটি ম্যাচ জিতে, কোনও গোল না খেয়ে ভারত সোনা জিতলেও বিজয়মঞ্চে ওঠা হয়ে ওঠেনি অধিনায়ক জয়পালের। ফাইনালের আগেই তিনি আমস্টারডাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। ভারতীয় দলে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়দের ব্যবহার তাঁর ভালো লাগেনি। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়রা কখনও জয়পালকে অধিনায়ক হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে নানা ভাবে অসহযোগিতাও করেছিলেন। ফলে বিরক্ত হয়ে আমস্টারডাম ছেড়েছিলেন জয়পাল। তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এরিক পিন্নিগার। অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দলের অভিযান শুরুর আগে অবশ্য অধিনায়ক হিসেবে তিনি একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন। আমস্টারডামে অলিম্পিকে খেলতে যাওয়ার পথে ভারতীয় দল প্রথমে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে, কিছু প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে। তখন এখনকার মতো বিমান যাত্রা ছিল না। জাতীয় দল যেত জাহাজেই। ভারত থেকে জাহাজে লন্ডনের কাছাকাছি টিলবুরি বন্দরে গিয়ে নেমেছিল ভারতীয় দল। সেখানে আরও অনেকের সঙ্গে ভারতীয় খেলোয়াড়দের স্বাগত জানাতে হাজির ছিলেন অধিনায়ক জয়পালও।
সেই যুগের সেরা ফুলব্যাক জয়পালের ওটাই ছিল প্রথম ও শেষ অলিম্পিক। কিন্তু ভারতীয় হকির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শেষ করে ১৯৩০ সালে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন। চলে এসেছিলেন কলকাতায় মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে খেলতে। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪, মোহনবাগানের হয়ে খেলেছেন। ছিলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক। মোহনবাগানে খেলতে খেলতে ১৯৩২ সালে অল্প কিছুদিনের জন্য বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনের (বি এইচ এ) সচিবও হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান হকি ফেডারেশনেও ছিলেন বি এইচ এ-র প্রতিনিধি। ওই ১৯৩২সালেই কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তঃ প্রাদেশিক হকি প্রতিযোগিতায় বাংলা দলে জয়পাল না থাকায় বিস্মিত হয়েছিলেন হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ। পরে তিনি আত্মজীবনী ‘গোল’-এ লিখেছেন, ‘বাংলা দল নিয়ে আমার অসন্তোষ ছিল। জয়পাল তখন অক্সফোর্ড থেকে ফিরে কলকাতাতেই। মোহনবাগানের অধিনায়ক। বাংলার লেফট ব্যাক ছিল ব্রেনডিস। জয়পালের চেয়ে সে ভালো, এটা কেউ মানবেন না। কেন জয়পাল সেবার বাংলা দলে ছিল না, এটা আমার কাছে কোনও রহস্য ছিল না। বাংলার হকির খোঁজখবর রাখতাম। জানতাম, রাজনীতিটা কোথায়!’ তবে ১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দল পাঠানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জয়পাল। তাঁর উদ্যোগেই সেবছর অলিম্পিকে হকি দল পাঠানোর আর্থিক দায়িত্ব অনেকটাই নিয়েছিল বি এইচ এ।
জয়পাল সিংয়ের রাজনৈতিক জীবনও ছিল খুবই ঊজ্জ্বল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি ছিলেন শিক্ষাবিদ।
শুধু অলিম্পিক হকিতে ভারতের প্রথম সোনাজয়ী অধিনায়কই ছিলেন না। জয়পাল সিং মুন্ডা হয়ে উঠেছিলেন এদেশের আদিবাসীদের অন্যতম কণ্ঠস্বর। নির্বাচিত হয়েছিলেন সংবিধান পরিষদে। এই পরিষদই রচনা করেছিল ভারতের সংবিধান। সেই সুবাদে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশিল তৈরিতে জয়পালের বিশেষ অবদান ছিল। ছিলেন অসামান্য বক্তা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনিকে (তারা মজুমদার) বিয়ে করলেও সেই পরিবারের রাজনীতির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। কংগ্রেসি রাজনীতির চক্ষুশূল হয়েও তিনি তৈরি করেছিলেন আদিবাসীদের জন্য ঝাড়খন্ড পার্টি। যে পার্টি ভবিষ্যতে আদিবাসীদের নিজস্ব দাবিদাওয়া জাতীয় পরিসরে তুলে ধরবে। এই কারণেই বলা হয়ে থাকে যে ইতিহাসের গর্ভ থেকে পৃথক রাজ্য ঝাড়খন্ডের জন্ম সম্ভব করেছিলেন জয়পাল। ১৯৪৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর সংবিধান পরিষদে প্রথমবার বক্তৃতা দেওয়ার অবকাশে জয়পাল নিজেকে ‘জংলি’ হিসেবে অবিহিত করে নিজের আদিবাসী পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, আদিবাসীরাই ভারতের আদিতম সন্তান। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচিতির জন্য তিনি কোনওভাবেই হীনমন্য নন।
ভারতের খেলাধুলো ও রাজনীতির এই ঊজ্জ্বল নক্ষত্রের শৈশবের নাম কিন্তু জয়পাল সিং মুন্ডা নয়। জন্মের পর পরিবারের লোকেরা নাম রেখেছিলেন প্রমোদ পাহান। জয়পালের বাবা আম্রু পাহান। মা রাধামুনি। জন্ম তখনকার বিহারের খুঁটির টাকরা গ্রামের পাহানটোলিতে। গ্রামের পাঠশালায় প্রথমে ভর্তি হলেও ৮ বছর বয়সে জয়পালের বাবা আম্রু পাহান ১৯১১ সালের ৩ জানুয়ারি তাঁর ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন রাঁচির সেন্ট পলস স্কুলে। সেখানকার প্রিন্সিপালের পরামর্শে স্কুলের খাতায় নাম লেখা হয়েছিল জয়পাল সিং মুন্ডা। সেই থেকেই তিনি ওই নামে পরিচিত। আর জন্মদিন? আম্রু পাহান জানতেন না, স্কুলে ভর্তির জন্য জন্ম তারিখ দরকার হবে। তিনি ছেলের জন্মদিন কবে, তাও জানতেন না। মা রাধামুনি শুধু বলেছিলেন ৮ বছর আগে শীতকালে ছেলের জন্ম। কী আর করবেন, বয়স ৮ বছর শুনে স্কুলের ভর্তির খাতায় জন্মদিন লিখে নিয়েছিলেন ১৯০৩ সালের ৩ জানুয়ারি। সেই থেকে নাম জয়পাল সিং মুন্ডা। জন্ম তারিখও ৩ জানুয়ারি ১৯০৩।
সেন্ট পলস স্কুলের শিক্ষকদের উদ্যোগেই রাঁচি থেকে ইংল্যান্ডে লেখাপড়া করতে গিয়েছিলেন জয়পাল। প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ওখানকার স্কুলে। স্কুল ও কলেজের পর্ব চুকিয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তিনি ছিলেন ভারতীয় ছাত্রদের ডিবেটিং সোসাইটি অক্সফোর্ড মজলিসের সদস্য। টাকরা গ্রামে বা রাঁচিতে থাকার সময় খেলতেন সখের হকি। কিন্তু ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর নিয়মিত হকি খেলা শুরু করেন। ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির হকি দলের অধিনায়ক। ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে হকি দল গড়ে এই সময় ইউরোপের নানা দেশে খেলতেও গিয়েছেন।
ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় আসার পর চাকরি করতেন বার্মা-শেলে। ওই সময়ই বিয়ে করেছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনিকে (তারা মজুমদার)। ১২ বছর পর বিচ্ছেদ। পরে ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বিয়ে জাহা আরা জয়রতনমকে। বার্মা-শেলের সেই চাকরি অবশ্য বেশিদিন করেননি। এরপর করেছেন শিক্ষকতা। কিছুদিনের জন্য ঘানার এক কলেজেও পড়াতে গিয়েছিলেন। ওখান থেকে ফিরে মধ্যপ্রদেশের রাইপুরের রাজকুমার কলেজের প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপাল ও পরে প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও বেশিদিন থাকেননি। এরপরই ঢুকে পড়েছিলেন পুরোপুরি স্বাধীনতা আন্দোলনে, রাজনীতিতে। ১৯৩৮ সালে জয়পাল ও আরও কয়েকজনের উদ্যোগে আদিবাসী মহাসভার প্রতিষ্ঠা। শুরু থেকেই জয়পালই ছিলেন ওই পার্টির প্রধান। পরে ভারত স্বাধীন হলে আদিবাসী সমাজের উন্নয়নের জন্য আরও বড় আন্দোলনের তাগিদে ১৯৪৯ সালে আদিবাসী মহসভার অবলুপ্তি ঘটিয়ে তৈরি হয়েছিল ঝাড়খন্ড পার্টি। সেই পার্টিরও সভাপতি হয়েছিলেন জয়পাল। খুঁটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে ঝাড়খন্ড পার্টির টিকিটে টানা তিনবার (১৯৫২, ১৯৫৭ ও ১৯৬২) সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ঝাড়খন্ড পার্টির একাংশ মিশে গিয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে। আদিবাসীদের বৃহত্তর স্বার্থে জয়পালও হেঁটেছিলেন সেই পথে। ফলে ১৯৬৭-র লোকসভা নির্বাচনে তিনি লড়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীকে। জিতেওছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশের শুরু থেকেই জয়পাল বিহার ভেঙে আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবি জানিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তা সম্ভব হয়নি। তবে আজীবন ওই লড়াইটা জারি রেখেছিলেন। বিহার ভেঙে তাঁর স্বপ্নের আলাদা ঝাড়খন্ড রাজ্য তৈরি হয় ২০০০ সালের ১৫ নভেম্বর। কিন্তু এর অনেক আগেই সাংসদ থাকাকালীনই ১৯৭০ সালের ২০ মার্চ তাঁর জীবনাবসান হয় দিল্লিতে।
No comments:
Post a Comment