বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বি ও এ) আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি ওখানকার কর্মকর্তারা। আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষপূর্তি। আজকের দিনটিও কেটে যাবে নীরবেই!
আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি
নির্মলকুমার সাহা
(প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ান পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি। আজ ১৫ আগস্ট ২০২০, অলিম্পিকের ট্র্যাকে তাঁর পা রাখার ১০০ বছর পূর্তি। এই উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে বিশেষ লেখা।)
পুনেতে ডেকান জিমখানার মাঠে ১৯১৯ সালে একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তখন ডেকান জিমখানার সভাপতি স্যর ডোরাবজি টাটা। ওই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলার সময়েই তিনি সবার সঙ্গে কথা বলেন ১৯২০ সালের অলিম্পিকে ভারতীয় দল পাঠানোর ব্যাপারে। ওই প্রতিযোগিতায় পুরস্কার দিতে এসেছিলেন তখনকার বোম্বাইয়ের গভর্নর লয়েড জর্জ। ডোরাবজি টাটা তাঁকে অনুরোধ করেন যাতে তিনি অলিম্পিকে দল পাঠানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হন। ভারত তখন পরাধীন। ব্রিটিশ অলিম্পিক কমিটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক সংস্থার সঙ্গে কথা বলে ভারতীয় দল পাঠানোর ছাড়পত্র পাওয়া যায় ১৯২০-র ফেব্রুয়ারিতে। তারপরই শুরু হয় দল গড়ার কাজ। এপ্রিল মাসে পুনেতেই ট্রায়ালের ব্যবস্থা হয়।
বাংলা থেকে পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জির সঙ্গে ট্রায়ালে গিয়েছিলেন আরও ৩ জন। বলাইদাস চ্যাটার্জি, সমর সাহা ও রবীন রক্ষিত। কিন্তু ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলার একমাত্র পূর্ণচন্দ্র। ট্রায়ালের পর কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু অ্যাথলেটিক্স ও কুস্তি দল পাঠানো হবে। অ্যাথলেটিক্স দলে ছিলেন ৪ জন। পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি, পি ডি চোগলে, এইচ ডি কাইকাডি, এস ভি ডাতার। কুস্তি দলে ছিলেন ডি ডি সিন্দে, কে টি নাভালে। অ্যান্টোয়ার্পে গেলেও কাইকাডি অবশ্য প্রতিযোগিতায় নামেননি। ১৯০০ সালে কলকাতার ছেলে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নর্মান প্রিচার্ড নিজের উদ্যোগে প্যারিস অলিম্পিকে অংশ নিয়ে পদক জিতলেও সরকারিভাবে অলিম্পিকে ভারতীয় দলের অংশ নেওয়া ১৯২০ সালেই প্রথম। যার এবার শতবর্ষপূর্তি। বাঙালির অলিম্পিক অভিযানেরও তাই।
সেবার অলিম্পিকে অ্যাথলেটিক্স হয়েছিল ১৫ থেকে ২৩ আগস্ট। প্রথম দিনই ছিল পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জির ইভেন্ট ১০০ মিটার দৌড়ের হিট। অলিম্পিকের লড়াইয়ে বাঙালির প্রথম অংশ নিতে নামা সেই ১৫ আগস্ট। হিটে পূর্ণচন্দ্র ছিলেন ২ নম্বর গ্রুপে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা না থাকায় ফল অবশ্য ভাল হয়নি। ওই গ্রুপে ছিলেন পাঁচজন। পূর্ণচন্দ্র শেষ করেছিলেন সবার শেষে, অর্থাৎ পাঁচ নম্বরে। বিদায় নিয়েছিলেন হিট থেকেই। সেই অলিম্পিকে ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন ২২ দেশের ৬০ অ্যাথলিট।
সেই অলিম্পিকে পূর্ণচন্দ্র অংশ নিয়েছিলেন আরও একটি ইভেন্টেও। সেটা ৪০০ মিটার দৌড়। যা হয়েছিল ১৯-২০ আগস্ট। অংশ নিয়েছিলেন ১৬ দেশের ৩৭ জন অ্যাথলিট। হিটে পূর্ণচন্দ্র ছিলেন ৮ নম্বর গ্রুপে। পেয়েছিলেন ৪ জনের মধ্যে চতুর্থ স্থান (সময় ৫৩.১ সেকেন্ড)। একই কারণে, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার অভাবে ৪০০ মিটারেও হিট থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি নাম তুলে ফেলেছিলেন ইতিহাসের পাতায়। সেবার অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মার্চপাস্টে ভারতীয় দলের পতাকা বাহক ছিলেন প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ান পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি। আর তাঁর ফিনিশিং ওখানে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
পূর্ণচন্দ্রর জন্ম ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসে কলীঘাটের ২৯ হালদার পাড়া রোডে মামা বাড়িতে। ওঁর বাবা দীনবন্ধু ব্যানার্জি ছিলেন বিহারের ভাগলপুর আদালতের সরকারি উকিল। তাই কলকাতায় জন্ম হলেও পূর্ণচন্দ্রর শৈশব কেটেছে ভাগলপুরে। ওখান থেকে পূর্ণচন্দ্র কলকাতায় চলে আসেন ১৯১৬ সালে। কলকাতায় ফেরার আগেই অবশ্য অ্যাথলেটিক্স চর্চা শুরু। শৈশবে দিদি ছাড়া বাড়ির আর কারও কাছ থেকে সেভাবে খেলাধুলোর ব্যাপারে উৎসাহ পাননি। দিদির হাত ধরেই ভাগলপুরে ছোটদের কয়েকটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। পূর্ণচন্দ্র তখন ওখানকার জেলা সি এম এস স্কুলের ছাত্র। কোনও কোচের তত্ত্বাবধানে নয়, ওখানে একা একাই অনুশীলন করতেন। নিজের গতি বাড়ানোর জন্য পরিচিত একজনকে বলতেন দ্রুত সাইকেল চালাতে। দৌড়ে তাঁকে ধরার চেষ্টা করতেন পূর্ণচন্দ্র।
কলকাতায় আসার পর প্রথমে বিভিন্ন স্পোর্টসে জুনিয়র বিভাগে অংশ নিতেন। পরে নাম লেখান মোহনবাগানে। তারপর কখনও আর মোহনবাগান ছাড়েননি। অ্যাথলেটিক্স থেকে অবসর নেওয়ার পরও তাঁর সঙ্গে মোহনবাগানের সম্পর্ক ছিল অটুট।
ভাগলপুরের মতোই কলকাতায় আসার পরও প্রথমে সেভাবে কোনও কোচ ছিল না পূর্ণচন্দ্রর। পরে ওয়াই এম সি এ-র মিস্টার বাক কিছুটা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। বেলজিয়ামের অ্যান্টোয়ার্পে অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়ার আগে সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র। তাতে তাঁর প্রস্তুতি কিছুটা ব্যাহত হয়েছিল। অলিম্পিকের আগে ভারতীয় দল প্রথমে গিয়েছিল লন্ডনে। ওখানে ইংরেজ কোচ এইচ প্যারির তত্ত্বাবধানে অ্যাথলিটরা ৬ সপ্তাহ অনুশীলন করেছিলেন।
পুরো নাম পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি হলেও ভারতের ক্রীড়াজগতে অবশ্য পরিচিত ছিলেন পি সি ব্যানার্জি নামেই। আর ঘনিষ্ঠমহলে পুঁইয়া ব্যানার্জি। শুধু অ্যাথলেটিক্সে নয়, পূর্ণচন্দ্রর দাপট ছিল অন্য অনেক খেলায়ও। মোহনবাগানের জুনিয়র দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। বিলিয়ার্ড, রাগবি, গলফ, টেনিস, সাঁতার, অশ্বারোহণেও তিনি নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন।
পূর্ণচন্দ্র একসময় লন্ডনের রয়্যাল ভেটেরেনারি কলেজের ছাত্র ছিলেন। ওখান থেকে ফিরে যুক্ত হয়েছিলেন মুক্তেশ্বরের ভেটেরেনারি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। অবসরের আগে বাংলার ভেটেরেনারি দপ্তরে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে ছিলেন।
পরিবারে আগে খেলাধুলোয় উৎসাহ না থাকলেও পূর্ণচন্দ্রর সাফল্যে পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। পূর্ণচন্দ্রর ভাইদের মধ্যে প্রকাশচন্দ্র অ্যাথলেটিক্স করতেন। প্রফুল্লচন্দ্র খেলতেন ফুটবল। পূর্ণচন্দ্রর বড় ছেলে প্রবীরকুমার ব্যানার্জি দূরপাল্লার দৌড়ে অংশ নিতেন। ১৯৫৩ সালে লিভারপুলের কাছে বার্কেনহেডে ক্রশ কান্ট্রি দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। ছোটছেলে প্রদোষ খেলতেন বাস্কেটবল। জাতীয় প্রতিযোগিতায় বাংলার প্রতিনিধিত্বও করেছেন।
শেষ বয়সে পূর্ণচন্দ্র কলকাতায় থাকতেন বালিগঞ্জের ৭২ নম্বর রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে। ওই বাড়িতেই জীবনাবসান ১৯৫৪ সালের ১৩ নভেম্বর। ওখানেই থাকতেন তাঁর দুই ছেলে। একসময় ওই বাড়িতে বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি পূর্ণচন্দ্রর সব স্মারক, ছবি, সার্টিফিকেট সযত্নে আগলে রাখতেন দুই পুত্র। পূর্ণচন্দ্রর জন্ম শতবর্ষেও একাধিকবার গিয়েছি ওই বাড়িতে। তখন ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলে প্রবীরকুমার বারবার বলতেন, ‘শতবর্ষে বাবা কি একটু সম্মান পেতে পারতেন না? এখন তো শহর জুড়ে মূর্তির ছড়াছড়ি। শতবর্ষে বাবার একটা মূর্তি কি বসানো যেত না? নিদেন পক্ষে বাবার নামে একটা রাস্তা?’ মূর্তি বসেনি, তাঁর নামে রাস্তা হয়নি। তাঁর স্মৃতি জড়িয়ে থাকা রাজা বসন্ত রায় রোডের সেই বাড়িটিও এখন আর নেই। শহর জুড়ে এখন যা হচ্ছে, সেই আধুনিক কালচারে নতুন চেহারা নিয়েছে।
জন্ম শতবর্ষে পাননি, আজ অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার শতবর্ষ পূর্তিতেও ‘সম্মান’ পাচ্ছেন না পূর্ণচন্দ্র ব্যানার্জি। বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বি ও এ) আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি ওখানকার কর্মকর্তারা। আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষপূর্তি। আজকের দিনটিও কেটে যাবে নীরবেই!