Wednesday, June 3, 2020

মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল স্টেলা ‘‌Woman with intersex variation’‌





একজনের হাতে ছিল বন্দুক। সেটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে যান স্টেলা। এমন সময়ই গুলি এসে লাগে পেটের নিচের অংশে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অপারেশন টেবিলে মারা যান অলিম্পিক সোনাজয়ী তারকা। 




মৃত্যুর পর জানা
গিয়েছিল স্টেলা
‘‌Woman with
intersex variation’‌



নির্মলকুমার সাহা


আমেরিকার হয়ে অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অংশ নিয়েছিলেন পোলান্ডের হয়ে। তাতে অবশ্য স্টেলা ওয়ালশের সোনা জেতা আটকায়নি। ১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন পোলান্ডের জাতীয় নায়িকা।
আমেরিকার বদলে কেন পোলান্ড?‌ স্টেলার জন্ম পোলান্ডের রুপিনে, ১৯১১ সালের ৩ এপ্রিল। নাম ছিল স্ট্যানিস্লায়া ওয়ালাসিউইকজ। তিন মাস বয়সেই বাবা (‌জুলিয়ান ওয়ালাসিউইকজ)‌ ও মা-‌র (‌ভেরোনিকা)‌ হাত ধরে চলে যেতে হয়েছিল আমেরিকায়। সন্তানকে নিয়ে জুলিয়ান ও ভেরোনার আমেরিকায় পা রাখার কারণ ছিল আর্থিক অনটন। আমেরিকায় গিয়ে যদি কোনও কাজ পাওয়া যায়। আমেরিকায় গিয়ে ওঁরা সংসার পেতেছিলেন ক্লিভল্যান্ডে। জুলিয়ান একটা স্টিল কারখানায় কাজও জুটিয়ে নিয়েছিলেন। আমেরিকায় যাওয়ার পরই ওখানে সহজবোধ্য হওয়ার জন্য জুলিয়ান-‌ভেরোনা মেয়ের আরও একটা নাম রেখেছিলেন, স্টেলা ওয়ালশ। পরে ওই নামেই তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন।
আর্থিক সঙ্কটের মাঝেও মেয়েকে অ্যাথলিট হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করেন জুলিয়ান-‌ভেরোনিকা। ক্লিভল্যান্ডে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্টেলার অ্যাথলেটিক্স চর্চা শুরু। ওখানকার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্যও আসতে থাকে। ১৯২৭ সালে আমেরিকায় সিনিয়রদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেন। পরের বছরই, ১৯২৮ সালে আমস্টারডামে অলিম্পিক। আমেরিকার অলিম্পিক দলের প্রস্তুতি শিবিরেও ডাক পান। আমেরিকার অলিম্পিক দলে ওঁর সুযোগ পাওয়া যখন নিশ্চিত তখনই আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। বয়স ২১ বছর না হওয়ায় আমেরিকার নাগরিকত্ব পাননি।
আমস্টারডাম অলিম্পিকে যেতে না পারলেও ওখানে একজনের সাফল্য দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্টেলাকে। তিনি পোলান্ডের হালিনা কোনোপাকা। যিনি মহিলাদের ডিসকাস থ্রো-‌তে সোনা জিতেছিলেন। অলিম্পিকের ইতিহাসে পোলান্ডের ওটাই ছিল প্রথম সোনা। বলতে গেলে সেদিন থেকেই ১৯৩২-‌এর অলিম্পিকের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন স্টেলা। ১৯৩০ সালের মে মাসে ১০০ গজ ১১ সেকেন্ডের কমে দৌড়ন। পরপর আরও সাফল্য। ১৯৩২-‌এ নিজেদের দেশে অলিম্পিক। আমেরিকানরা মহিলাদের ১০০ মিটারের সোনার পদকটা তখন থেকেই দেখতে শুরু করেন স্টেলার গলায়। স্টেলাও শুরু করে দেন অলিম্পিকের প্রস্তুতি। লক্ষ্য ১০০ মিটারের সোনা। কিন্তু অলিম্পিকের ঠিক কাছাকাছি এসেই দেখা দেয় ঘোর সমস্যা। স্টেলার বাবার চাকরি চলে যায়। স্টেলা তখন চাকরি করতেন নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল রেলরোডে। প্রায় একই সময়ে স্টেলার সেই চাকরিও চলে যায়। ওঁদের পরিবার তখন গভীর আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি। যা অবস্থা, তাতে স্টেলার বিকল্প কোনও চাকরির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তা না হলে সংসার চলবে না। ওখানকার ক্রীড়াকর্তারা ক্লিভল্যান্ড রিক্রিয়েশন বিভাগে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তাতে দেখা দেয় অন্য সমস্যা। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী খেলাধুলো বা রিক্রিয়েশন সংক্রান্ত কোনও দপ্তরে চাকরি করলে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া যাবে না। ঠিক তখনই পোলিশ দূতাবাস থেকে স্টেলাকে চাকরির অফার দেওয়া হয়। ওই চাকরিতে যোগ দিয়ে স্টেলা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন নিজের জন্মভূমি পোলান্ডের হয়ে।
১৯৩২ সালে লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে ১০০ মিটারে বিশ্বরেকর্ডের সমান সময় (১১.‌৯ সেকেন্ড)‌‌ করে সোনা জিতেছিলেন। রুপো জিতেছিলেন কানাডার হাইল্ড স্ট্রাইক। তাঁরও সময় ছিল ১১.‌৯ সেকেন্ড। স্টেলা সোনা জেতার পর সরকারিভাবে কেউ কোনও অভিযোগ করেননি। কিন্তু কানাডার কিছু কর্মকর্তা সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন।‌ নিজেরা বলাবলি করেছিলেন, আদৌ স্টেলা কি মহিলা?
লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে স্টেলা আরও একটা ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন। সেটা হল ডিসকাস থ্রো। তাতে ৯ প্রতিযোগীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থান পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১০০ মিটারের ফাইনাল ও ডিসকাস থ্রো একইদিনে হয়েছিল।
১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকেও ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন স্টেলা। জিতেছিলেন রুপো (‌১১.‌৭ সেকেন্ড)‌। ওখানে স্টেলার বিরুদ্ধে নয়, অভিযোগ উঠেছিল সোনাজয়ী আমেরিকার হেলেন স্টিফেন্সের (‌১১.‌৫ সেকেন্ড)‌ বিরুদ্ধে। অভিযোগ তুলেছিলেন স্টেলার দেশ পোলান্ডের এক সাংবাদিক। সেই অভিযোগ অবশ্য টেকেনি। সংগঠক জার্মানির কর্মকর্তারা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেক্স টেস্ট হয়েছে। তাতে প্রমাণিত হেলেন মহিলাই। বিতর্ক ওখানেই থেমে গিয়েছিল।
যাই হোক বার্লিন থেকে আমেরিকায় ফিরে আসেন স্টেলা। ভেবেছিলেন পরের অলিম্পিকেও অংশ নেবেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তো পরপর দুটো অলিম্পিক হতেই পারেনি। অলিম্পিকে আর অংশ নেওয়া না হলেও স্টেলা থেকে গিয়েছিলেন খেলার জগতেই। অলিম্পিকের একটি করে সোনা ও রুপো ছাড়াও ছাড়াও স্টেলার গলায় উঠেছিল মহিলাদের বিশ্ব গেমসের ৪ টি সোনা ও ২ টি রুপোর পদক। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছিলেন ২ টি সোনা। খেলাধুলো থেকে অবসর নেওয়ার পর আমেরিকায় থাকা পোলিশদের নানা সংস্থার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তাদের খেলাধুলোর দিকটা বলতে গেলে একাই সামলাতেন। নানা রকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। নানা ভাবে উঠতি পোলিশ খেলোয়াড়দের সাহায্য করতেন। ছোটদের কোচিং করাতেন। ঠিক করে ফেলেছিলেন আর পোলান্ডে ফিরবেন না। আমেরিকায় থেকেই পোলান্ডের খেলোয়াড়দের সাহায্য করবেন। একসময় বারবার আবেদন করেও আমেরিকার নাগরিকত্ব পাচ্ছিলেন না। গড়িমসির কারণ অবশ্যই ১৯৩২ সালের অলিম্পিকে শেষ সময়ে আমেরিকা দল থেকে সরে দাঁড়ানো। অবশেষে ১৯৪৭ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। বিয়ে করেন আমেরিকার নামী বক্সার নীল ওলসনকে। সেই সম্পর্ক অবশ্য ৮ সপ্তাহের বেশি টেকেনি। সরকারিভাবে কখনও বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও, ওঁরা আর একসঙ্গে থাকেননি। স্টেলা থাকতেন ক্লিভল্যান্ডের ছোট বাড়িতে মা ভেরোনিকার সঙ্গে।
আর ঘরসংসার করা না হলেও খেলাধুলো নিয়ে দিব্যি জীবন কেটে যাচ্ছিল স্টেলার। তাঁর আবেগ ও ভালোবাসা ছিল খেলাধুলো এবং পোলান্ড ঘিরেই। আর পোলান্ডের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে বলতেন, ‘‌The Polish Flyer.’‌ কিন্তু শেষ পরিণতি?‌ 
১৯৮০ সালের ৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। পোলান্ডের জাতীয় মহিলা বাস্কেটবল দল তখন আমেরিকায়। পরের সপ্তাহে তাদের সঙ্গে কেন্ট স্টেটের প্রীতি ম্যাচ। সেখানে পোলিশ দলের সংবর্ধনা। যার অনেকটা দায়িত্বই ছিল স্টেলার। এছাড়া ওই খেলার দিন স্টেলাকে নাগরিক সংবর্ধনা জানানোর ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন শহরের মেয়র George Voinovich. ‌‌ঠিক ছিল ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্টেলার হাতে মেয়র তুলে দেবেন শহরের সাম্মানিক চাবি। ৪ ডিসেম্বর ডিনারের পর বেশ রাতেই ৮৪ বছর বয়সী মা-‌কে বাড়িতে রেখে পোলিশ খেলোয়াড়দের জন্য উত্তরীয় ও স্মারক কিনতে গিয়েছিলেন এক শপিং কমপ্লেক্সে। পার্কিং লটে তাঁর গাড়ি রাখা ছিল। কেনাকাটার শেষে পার্কিং লটে গাড়ি নিতে এসেই চোর ও ছিনতাইবাজদের মুখোমুখি পড়ে যান স্টেলা। একজন স্টেলার দিকে এগিয়ে আসতেই ধস্তাধস্তি শুরু। অন্য একজনের হাতে ছিল বন্দুক। সেটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে যান স্টেলা। এমন সময়ই গুলি এসে লাগে পেটের নিচের অংশে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর অপারেশন টেবিলে মারা যান স্টেলা। মৃত্যুর পর ময়না তদন্ত হয়। তাতে জানা যায়, ‘‌Woman with intersex variation’‌!‌

জন্ম:‌ ৩ এপ্রিল ১৯১১
মৃত্যু:‌ ৪ ডিসেম্বর ১৯৮০

No comments:

Post a Comment

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...