Saturday, June 13, 2020

‘‌নো মুস্তাক, নো টেস্ট’‌ ইডেনে হেনস্থা করা হয়েছিল দলীপকে!‌




টেস্টে সর্বোচ্চ ১৭৩ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন ১৯৩০ সালে লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ওটাই ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দলীপের প্রথম টেস্ট। উল্লেখ্য, রণজিও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন। তবে রণজির ওটা ছিল জীবনেরও প্রথম টেস্ট।



‘‌নো মুস্তাক, নো টেস্ট’‌
ইডেনে হেনস্থা করা
হয়েছিল দলীপকে!‌


নির্মলকুমার সাহা


তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্রিকেটার, তখনই নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, ‘‌গত দু-‌বছরের সবচেয়ে সম্ভাবনাপূর্ণ ব্যাটসম্যান দলীপ সিংজি। এটা এই তরুণ ভারতীয়র প্রতি অশোভন ও অবান্তরও যে প্রতি ক্ষেত্রেই তার খেলা নিয়ে আলোচনায় রণজির নাম টেনে আনা হয়।’‌
গুজরাটের কাথিয়াবাড় অঞ্চলের নবনগরে সরোদর গ্রামে দলীপ সিংজির জন্ম, ১৯০৫ সালের ১৩ জুন। এমন একটি রাজ পরিবারে দলীপের জন্ম, যেখানে সব খেলার আগে ছিল ক্রিকেট। ওই পরিবারেরই রণজি সিংজি ক্রিকেট খেলে বিশ্ববন্দিত। প্রতি বছরই ইংল্যান্ড থেকে রণজি নিজের দেশে যখন আসতেন, সঙ্গে থাকতেন সে দেশের অনেক ক্রিকেটার-‌বন্ধুও। সরোদরে গ্রামের বাড়িতেও সেই ব্রিটিশ বন্ধুদের নিয়ে কয়েকদিনের জন্য যেতেন। গ্রামের বাড়ির সামনের মাঠে তাঁবু টাঙানো হত। বসত ক্রিকেটের আসর। দলীপের দাদা হিম্মত সিংজির একটা পুরনো লেখা থেকে জানা যায়, গ্রামের মাঠের সেই ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নিতেন ইংল্যান্ডের নামী টেস্ট তারকারাও। যেমন আর্চি ম্যাকলরেন, উইলফ্রেড রোডস, সি বি ফ্রাই, লর্ড হক।
দলীপ ছিলেন ৪ ভাইয়ের মধ্যে ছোট। ভাইদের মধ্যে দলীপের ক্রিকেটপ্রেমই ছিল বেশি। রণজির কাছেই দলীপের ক্রিকেটে হাতেখড়ি। রণজির লেখাতেই রয়েছে, ‘‌দলীপের বয়স যখন আট বছর, তখন আমি ওকে কোচিং দেওয়া শুরু করি। তেরো বছর বয়স পর্যন্ত ও আমার কোচিংয়ে ছিল। তখনই লক্ষ্য করেছিলাম, নিখুঁত রক্ষণাত্মক ব্যাটমস্যান হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনা ওর রয়েছে।’‌ ‌
১৯১৯-‌এর এপ্রিলে দলীপ চলে যান ইংল্যান্ডে। তার আগেই এদেশে ক্রিকেট সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে যান। রাজকোটে রাজকুমার কলেজের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্কুলে। রাজকুমার কলেজেই নর্থ উইং বনাম সাউথ উইংয়ের একটি ম্যাচে মাত্র ১৩ বছর বয়সে শতরান করেন। খেলাটি যে ছোটদের ছিল, তা নয়। কলেজের বড়দের বিরুদ্ধে খেলেই শতরান করেছিলেন দলীপ। ইংল্যান্ডে গিয়েও স্কুল পর্যায়ের খেলায় শুরুতেই কয়েকটি শতরান হাঁকান।
১৯২১ সালে কেলটেনহামের হয়ে কলেজ ক্রিকেটের প্রথম বছরে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৩১। আর ১৭ গড়ে পেয়েছিলেন ৩৯ টি উইকেট। পরপর তিন বছর কলেজ দলে ছিলেন অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। এরপর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ। সেখানেও ক্রিকেটার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তারপর ধাপে ধাপে সাসেক্স হয়ে ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেট দলে ঢুকে পড়া। ইংল্যান্ডের হয়ে ১২ টি টেস্টের ১৯ ইনিংসে দলীপের রান ৯৯৫। গড় ৫৮.‌৫২। শতরান ৩। টেস্টে সর্বোচ্চ ১৭৩ রানের ইনিংসটি খেলেছিলেন ১৯৩০ সালে লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ওটাই ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দলীপের প্রথম টেস্ট। উল্লেখ্য, রণজিও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন। তবে রণজির ওটা ছিল জীবনেরও প্রথম টেস্ট। দলীপের সংক্ষিপ্ত অথচ ঊজ্জ্বল ক্রিকেট জীবনের প্রথম টেস্টটা অবশ্য মনে রাখার মতো নয়। ১৯২৯ সালে এজবাস্টনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে রান করেছিলেন মাত্র ১২ ও ১। তা যাই হোক, লর্ডসে দলীপের ওই ১৭৩ রানের ইনিংসটি মাঠে বসে দেখেছিলেন রণজি। নেভিল কার্ডাস লিখেছেন, "...he hit too soon and was caught Bradman, bowled Grimmet. His uncle (Ranji) was present, watching from a box. Duleep, after removing his pads, went into the presence. And Ranji greeted him with a severe ‘‌My boy, that was a very careless stroke‌‌’‌.‌‌‌" 
দলীপের ‌‌ঊজ্জ্বল ক্রিকেট জীবনকে সংক্ষিপ্ত করেছিল অসুস্থতা। টেস্ট অভিষেকের ২ বছর আগেই ১৯২৭ সালে তিনি প্রথম অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্লুরিসিতে আক্রান্ত হন। যদিও ওই বছরের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। কেমব্রিজের হয়ে ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে ১০১ এবং মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে ৪৩ ও অপরাজিত ২৫৪। ওই মরশুমে মাত্র ৫ টি ইনিংস খেলে ৪৩৪ রান করেন। গড় ১০৮.‌৫। তারপরই অসুস্থতা। এরপরই চিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য চলে যেতে হয়েছিল সুইৎজারল্যান্ডে। ক্রিকেটে ফিরেছিলেন পরের মরশুমের কিছু খেলা হয়ে যাওয়ার পর। এবং ছিলেন রানের মধ্যেই। সাসেক্সের হয়ে ১৯ ইনিংসে ১০৮২ রান। গড় ৬০.‌১১। মাঝেমধ্যে অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি খেলে চলেছিলেন। ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলার ডাকও পান তারই মধ্যে। ১৯২৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। 
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ‌দলীপের সর্বোচ্চ রান ৩৩৩। ১৯৩০ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে সাসেক্সের হয়ে নর্দামটনশায়ারের বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় (‌৩৩০ মিনিট)‌ ওই রান করেছিলেন। দীর্ঘ ৭৩ বছর ওটা ছিল  কাউন্টিতে সাসেক্সের কোনও ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ২০০৩ সালে ওই রেকর্ড ভেঙে ৩৩৫ করেন মারে গুডউইন। ১৯৩২ সালেও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দলীপের রানের গড় ছিল ৫২.‌১৭। কিন্তু ওখানেই শেষ। চিকিৎসকের নির্দেশে বিদায় জানাতে হয় ক্রিকেটকে। শেষ টেস্ট ১৯৩১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। বৃস্টিতে ভেস্তে যাওয়া সেই টেস্টে একটি ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে দলীপ করেছিলেন ৬৩ রান।
১৯৩১ সালের শেষ দিকে কিছুদিনের জন্য দলীপ যখন ভারতে আসেন তখনও অমর সিং পরিচিত বোলার নন। কিন্তু দলীপের নজরে পড়ে যান। ১৯৩২ সালে ভারতের প্রথম ইংল্যান্ড সফরের জন্য দল নির্বাচন কমিটিতে ‘‌কো-‌অপ্ট’‌ করে রাখা হয়েছিল দলীপকে। তাঁর মনে হয়েছিল, ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় অমর সিং সাফল্য পাবেন। দলীপের প্রস্তাবেই ১৯৩২ সালে ভারতের প্রথম ইংল্যান্ড সফরের দলে ঢুকেছিলেন অমর সিং। দলীপ যে তখন ভুল করেননি, তা পরে প্রমাণিত হয়েছিল। ওই সফরে ভারতের বিরুদ্ধে সাসেক্সের হয়ে খেলেওছিলেন দলীপ। তবে সাফল্য পাননি। অধিনায়ক দলীপ করেছিলেন মাত্র ৭ রান।
আরও পরে ভারতের জাতীয় দল নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। তিনি চেয়ারম্যান থাকার সময়েই তো কলকাতায় পোস্টার পড়েছিল ‘‌নো মুস্তাক, নো টেস্ট’‌। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পরেপরেই লিন্ডসে হ্যাসেটের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস দল ভারত সফরে এসেছিল ‘‌বেসরকারি টেস্ট’‌ খেলতে। যে দলের সহ-‌অধিনায়ক ছিলেন কিথ মিলার। কলকাতা ‘‌টেস্ট’‌-‌এ দলে ছিলেন না মুস্তাক আলি। যার ফলে ‘‌টেস্ট’‌ শুরুর দু’‌দিন আগে ইডেনে কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমীরা হেনস্থা করেছিলেন দলীপকে। চাপে পড়ে মুস্তাক আলিকে দলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আত্মজীবনী ‘‌Cricket Delightful‌‌’‌-‌এ মুস্তাক আলি ওই ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, "‌I was really ashamed and extremely aggrieved at the way they behaved with that great cricketer and a very fine gentleman too. Duleepsinhji was pushed and pulled, even though I had intervened unavailangly, until he had given an assurance that he would try his best to have Mushtaq in the team for the 'Test' due to begin the day after."
ইংল্যান্ড থেকে পাকাপাকি দেশে ফেরার পর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ভারতের রাষ্ট্রদূতও হয়েছিলেন। সফল ক্রিকেটার দলীপ রাষ্ট্রদূত হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আরও পরে সৌরাষ্ট্রের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা কখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ১৯৫৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ঘুমের মধ্যেই মুম্বইয়ে জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পর ওঁর নামে দলীপ ট্রফি চালু হয় ১৯৬১-‌৬২ মরশুম থেকে।
আজ জন্মদিনে দলীপসিংজিকে প্রণাম।  ‌

জন্ম:‌ ১৩ জুন, ১৯০৫
মৃত্যু:‌ ৫ ডিসেম্বর, ১৯৫৯

No comments:

Post a Comment

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...