Thursday, June 18, 2020

চাষ বন্ধ,‌ করোনার প্রভাবে দারিদ্র‌্য বেড়েছে বিশ্বকাপারের





পেটের জ্বালায়, সংসার চালাতে এখনও নিয়ম করে চাষ করতে যেতে হয়। ‘‌বিশ্বকাপার’‌ এই পরিচয়টা দিয়ে তিনি এখনও গর্ববোধ করেন। কিন্তু তাতে পেট ভরে না। এক ডজন লোকের সংসার ঠিকঠাক টানতে পারেন না।


চাষ বন্ধ,‌ করোনার প্রভাবে
দারিদ্র‌্য বেড়েছে বিশ্বকাপারের 


নির্মলকুমার সাহা


বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। বছর খানেক আগে একবার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। তবু পেটের জ্বালায়, সংসার চালাতে এখনও নিয়ম করে চাষ করতে যেতে হয়। ‘‌বিশ্বকাপার’‌ এই পরিচয়টা দিয়ে তিনি এখনও গর্ববোধ করেন। কিন্তু তাতে পেট ভরে না। এক ডজন লোকের সংসার ঠিকঠাক টানতে পারেন না। ছত্তিশগড়ের রায়গড় জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শিথরা থেকে ফোনে ভিনসেন্ট লাকরা বলছিলেন, ‘‌স্ত্রী, ছেলে, মেয়েদের নিয়ে ১২ জনের সংসার। বিশ্বকাপার হিসেবে সরকারের কাছ থেকে সামান্য পেনশন পাই। তাতে কী করে এত বড় সংসারটা চলবে?‌ নিজের অল্প কিছু জমি আছে। ছেলেদের নিয়ে সেখানে চাষ করে কোনও মতে সংসার চালাই।’‌ কিন্তু ওই ‘‌কোনও মতে’‌ও এখন আর চলছে না। কারণ করোনা আতঙ্ক। সারা দেশের সঙ্গে যার প্রভাব পড়েছে ওই প্রত্যন্ত গ্রামেও।
আতঙ্ক থাকলেও কয়েকদিন আগে পর্যন্তও শিথরা গ্রামে একজনও করোনা পজিটিভ ছিলেন না। শিথরা গ্রামে দরিদ্র উপজাতিদের বাস। একসময় চাষই ভরসা ছিল গ্রামের মানুষের। কিন্তু তাতে এখন আর অধিকাংশ পরিবারেরই চলছে না। ভারতীয় হকি দলের প্রাক্তন ফরোয়ার্ড ভিনসেন্ট জানালেন, ‘‌কয়েক বছর আগে থেকেই পরিস্থিতি বদলেছে। এখন গ্রামের অনেক ছেলেকেই বাইরে কাজ করতে যেতে হচ্ছে। অন্য রাজ্যেও। করোনার জন্য তারা এখন ফিরে এসেছে। ওরা ফিরে আসার পর আমাদের গ্রামেও করোনায় আক্রান্ত পাওয়া গেছে। লকডাউনের জন্য একসময় ক্ষেতে যাওয়া বন্ধ ছিল। পরে মাঝেমধ্যে যাচ্ছিলাম। এখন গ্রামে করোনা আক্রান্ত পাওয়ায় তো ভয়ে বেরোতেই পারছি না। সবাই বারণ করছে। কী হবে জানি না!‌ কী করে সংসার চলবে বুঝতে পারছি না!‌’‌ তিনি অবশ্য শুধু নিজের পরিবার নয়, গ্রামের অন্যদের নিয়েও চিন্তিত। বললেন, ‘‌আমাদের গ্রাম গরীব মানুষে ভরা। সবারই এক অবস্থা।’‌
১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ হকিতে ভারতীয় দলে ৪ জন আদিবাসী খেলোয়াড় ছিলেন। গোপাল ভেঙ্গরা, জন কারকেট্টা, সিলভানাস ডুংডুং এবং ভিনসেন্ট লাকরা। তার আগে একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যক আদিবাসী খেলোয়াড় কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতীয় হকি দলের হয়ে খেলেননি। ‌ভিনসেন্ট বললেন, ‘‌ওই বিশ্বকাপের অনেক আগেই ভারতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছি। বিভিন্ন টেস্ট সিরিজে ভারতের হয়ে খেলেছি। লক্ষ্য ছিল অলিম্পিকে ভারতের হয়ে খেলা। ১৯৭৬ সালে অলিম্পিকের দলে ঢোকার খুব চেষ্টা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত পারিনি। অলিম্পিকটা আমার কাছে স্বপ্নই থেকে গেছে। তাই আমার হকি জীবনের সেরা ঘটনা আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপে খেলাটাই।’‌
আগে দেখেছি দারিদ্র‌্যের মাঝেও তিনি সবসময় হাসিখুশি। করোনার জেরে এখন সেই দারিদ্র‌্য আরও বেড়েছে। বয়সের ভার কিছুটা ক্লান্ত করেছে। আর আছে করোনা আতঙ্ক। এসবের মাঝেও দেখলাম পুরনো গল্প করার অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি। বললেন, ‘‌যা হওয়ার হবে। সারাক্ষণ ওসব নিয়ে চিন্তা করলে তো অসুস্থই হয়ে পড়তে হবে। তাই কথা বলে, গল্প করে নিজেকে হালকা রাখার চেষ্টা করি।’‌ আগে ওঁর কাছ থেকে অনেকবার শুনেছি, আবার শোনালেন, ‘‌সুনীল দত্ত হকির ভক্ত ছিলেন। হকি খেলা নিয়মিত দেখতেন। হকির সব খবর রাখতেন। তিনি আমাকে খুব ভালবাসতেন। আমার সংসারের খারাপ অবস্থার কথা তিনি জানতেন। আমাকে বলেছিলেন, মুম্বইয়ে চলে যেতে। ওখানে গিয়ে যাতে ভালভাবে থাকতে পারি, সেই ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। শুধু গ্রামের টানেই যাইনি। জন্ম থেকে এই গ্রামে। এই গ্রামের মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমার নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে মন সায় দেয়নি।’‌
গ্রাম নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ নেই। পাশাপাশি দুঃখও রয়েছে। বললেন, ‘ছোটবেলায় আমরা দলে দলে হকির টানে মাঠে যেতাম। এখন আর গ্রামের ছেলেরা হকি খেলে না। আমার ছেলেদেরও তো হকি খেলাতে পারিনি!‌’‌

No comments:

Post a Comment

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...