অলিম্পিকে আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা মার্গারেট অ্যাবট। সেই প্যারিস অলিম্পিকের ৫৫ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়, তখনও জেনে যেতে পারেননি যে তিনি অলিম্পিকে সোনাজয়ী! আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি স্বীকৃতি দিয়েছিল আরও অনেক পরে।
অলিম্পিকে আমেরিকার
প্রথম সোনাজয়ী মহিলা
জন্মেছিলেন কলকাতায়
নির্মলকুমার সাহা
চার্লস অ্যাবট ছিলেন আমেরিকান ব্যবসায়ী। একসময় আমেরিকার ব্যবসার পাট চুকিয়ে পরিবার নিয়ে শিকাগো থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। এই শহরেই শুরু করেছিলেন নতুন করে ব্যবসা। কলকাতাতেই ১৮৭৮ সালের ১৫ জুন জন্ম তাঁর মেয়ে মার্গারেটের। কিন্তু মার্গারেটের শৈশবেই হঠাৎ মারা যান চার্লস। স্বামীর মৃত্যুর পর কলকাতায় আর থাকতে চাননি চার্লসের স্ত্রী মেরি। সন্তানদের নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন শিকাগোয়। বিয়ের আগে থেকেই মেরি গল্ফ খেলতেন। অন্য একটি নেশাও ছিল, লেখালেখি। কলকাতা থেকে শিকাগোয় ফিরে গিয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওই লেখালেখিকেই। ওখানকার পত্রপত্রিকায় গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখতেন। ‘Chicago Tribune’ ও অন্য কিছু সংবাদপত্রে লিখতেন, বুক রিভিউ করতেন। পরে ‘Chicago Tribune’-এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকও হয়েছিলেন। পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছিলেন গল্ফ খেলাও। মেয়ে মার্গারেটকেও নিয়ে এসেছিলেন গল্ফে। মা-মেয়ে একসঙ্গে গল্ফ খেলতে যেতেন সি বি ম্যাকডোনাল্ডস গল্ফ ক্লাবে। সেখানে ওঁদের কোচ ছিলেন এডওয়ার্ড ফ্রস্ট। পরে ওই কলকাতা-জাত মার্গারেট অ্যাবটই অলিম্পিকে আমেরিকার হয়ে গল্ফে সোনা জিতেছিলেন, ১৯০০ সালে। অলিম্পিকে তিনিই আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা।
উল্লেখ করার মতো ব্যাপার, ওই প্যারিস অলিম্পিকে কলকাতা-জাত আরও একজন পদক জিতেছিলেন। তিনি নর্মান প্রিচার্ড। যিনি অলিম্পিকে পদকজয়ী প্রথম ভারতীয়। নর্মান প্রিচার্ড সেই অলিম্পিকে অ্যাথলেটিক্সে জোড়া রুপো জিতেছিলেন। ২০০ মিটার দৌড় ও ২০০ মিটার হার্ডলস (এখন অলিম্পিকে এই ইভেন্টটি নেই)।
১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরে মহিলাদের কোনও খেলা ছিল না। অলিম্পিকে মহিলাদের প্রবেশ ১৯০০ সালে প্যারিসে। ওই একই সময়ে প্যারিসে চলেছিল তৃতীয় বিশ্ব প্রদর্শনী (Exposition Universelle)। সব মিলিয়ে সেই প্যারিস অলিম্পিকে সাংগঠনিক ব্যর্থতা চূড়ান্ত আকার নিয়েছিল। নানা কারণে সেবার অলিম্পিকে সব খেলা একই সময়ে করা যায়নি। সেই প্যারিস অলিম্পিক চলেছিল পাঁচ মাস ধরে। আলাদা আলাদা সময়ে আলাদা আলাদা খেলা। তার মধ্যে আবার বেশ কিছু খেলা মূল অলিম্পিকের তালিকায় ছিল না। যা ছিল ‘প্রদর্শনী’ হিসেবে চিহ্নিত। ফলে অনেক খেলোয়াড়ই জানতেন না, তাঁরা অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছেন, নাকি সেই প্রদর্শনীতে। অনেকে বহু বছর পর জেনেছিলেন, তাঁরা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন বা অলিম্পিক পদক জিতেছিলেন। আবার কয়েকজন তো তা জেনেও যেতে পারেননি। সেই স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই তাঁদের জীবনাবসান হয়েছিল। ওইরকমই একজন অলিম্পিকে আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা মার্গারেট অ্যাবট। সেই প্যারিস অলিম্পিকের ৫৫ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়, তখনও জেনে যেতে পারেননি যে তিনি অলিম্পিকে সোনাজয়ী!
মার্গারেট অলিম্পিকে সোনা জিতেছিলেন গল্ফের নাইন হোল ইভেন্টে ৪৭ পয়েন্ট করে। ৪ অক্টোবর ওই ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন মার্গারেটের মা মেরি পার্কিন্স ইভস অ্যাবটও। মেয়ের সঙ্গে লড়াইয়ে মা অবশ্য পেরে ওঠেননি। তিনি পেয়েছিলেন সপ্তম স্থান। কিন্তু অলিম্পিকে মা ও মেয়ের একই সঙ্গে একই ইভেন্টে অংশ নেওয়াটা নজির হয়ে রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছিলেন যথাক্রমে পৌলিন উইটিয়ার ও ডারিয়া প্রাট। ওই দু’জনও আমেরিকার।
অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার জন্য নয়, মা ও মেয়ে প্যারিসে গিয়েছিলেন একবছর আগেই, ১৮৯৯ সালে। মার্গারেট প্যারিসে গিয়েছিলেন ওখানকার দু’জন (Edgar Degas and Auguste Rodin) বিখ্যাত শিল্পীর কাছে Art and Sculpture শেখার জন্য। সঙ্গে ছিলেন মা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ওখানে বসে উপন্যাস, গল্প লিখবেন। পাশাপাশি ভ্রমণ নিয়ে গবেষণা করবেন। শিকাগোয় থাকার সময় দু’জনই কিছু গল্ফ প্রতিযোগিতায় সাফল্য পেয়েছিলেন। ভালই গল্ফ খেলতেন। তাই প্যারিসে গিয়েও গল্ফ খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মা-মেয়ে। প্যারিস অলিম্পিকের আমেরিকার সরকারি দলে মা-মেয়ের নাম ছিল না। প্যারিসে যে ক্লাবে ওঁরা গল্ফ অনুশীলন করতেন, সেখান থেকেই জানতে পেরেছিলেন একটি আন্তর্জাতিক গল্ফ প্রতিযোগিতা হবে। দু’জনই ওই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিলেন। শুধু ওঁরা কেন, সবাই জানতেন একটি আন্তর্জাতিক গল্ফ প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। আমেরিকা ও ফ্রান্স, দুই দেশের মাত্র ১০ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিলেন। যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন কারও কাছেই ওই গল্ফ প্রতিযোগিতার গুরুত্ব স্পষ্ট ছিল না। বিশেষ করে ফ্রান্সের মহিলাদের কাছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মার্গারেট অ্যাবট বলেছিলেন, ‘আমার চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা অনেক সহজ হয়েছিল, কারণ ফরাসি মেয়েরা টুর্নামেন্টটাকে কোনও গুরুত্বই দেয়নি। ওরা খেলতে এসেছিল হাই হিল জুতো, টাইট স্কার্ট পরে, সাজগোজ করে। মনে হচ্ছিল বেড়াতে এসেছে।’
১৯০২ সালে মা ও মেয়ে আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন। সেই বছরই মার্গারেট বিয়ে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিনলি পিটার ডুনেকে। ডুবে যান ঘরসংসারে। প্যারিসের সেই গল্ফ চ্যাম্পিয়নশিপ অলিম্পিকের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ১৯৫৫ সালের ১০ জুন মার্গারেটের জীবনবসান হয়। অর্থাৎ মার্গারেট জেনেই যেতে পারেননি যে তিনি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন, তিনিই অলিম্পিকে আমেরিকার প্রথম সোনাজয়ী মহিলা। তাঁর মৃত্যুর পরও পরিবারের লোকদের ‘সোনার খবর’ পেতে লেগে গিয়েছিল আরও অনেক বছর। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ওই গল্ফ প্রতিযোগিতাকে অলিম্পিকের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতিই দিয়েছিল মার্গারেট অ্যাবটের মৃত্যুর অনেক পর। তারপরও ওই খবর পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছিল না মার্গারেটের উত্তরসূরিদের কাছে। তাঁদের খোঁজই পাওয়া যাচ্ছিল না। এর বড় কারণ সেবার অলিম্পিকে আমেরিকা যে দল পাঠিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই তাতে মার্গারেট এবং মেরির নাম ছিল না। ফলে আমেরিকার অলিম্পিক সংস্থায় ওঁদের ঠিকানা ছিল না।
ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডার প্রফেসর পাওলা ওয়েলচ অলিম্পিকে আমেরিকার মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সাফল্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খোঁজা শুরু করেন মার্গারেট অ্যাবটের উত্তরসূরিদের। ১০ বছর চেষ্টার পর তিনি মার্গারেটের এক পুত্র ফিলিপ ডুনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। Screenwriter, Film director, Producer হিসেবে হলিউডে তখন যথেষ্ট পরিচিত নাম ফিলিপ ডুনে। তবু তাঁকে খুঁজে পেতে এত দেরি কেন? আসলে তিনি চলচ্চিত্র জগৎ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। খেলার জগতের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্কই ছিল না। ক্রীড়া জগতের লোকেরাও জানতেন না যে তিনি মার্গারেট অ্যাবটের পুত্র। তাছাড়া তাঁরা প্রয়োজন মনেও করেননি যে খবরটা মার্গারেট অ্যাবটের পরিবারের লোকেদের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। যাই হোক, পাওলা ওয়েলচ সেই কাজটি করতে পেরেছিলেন। মার্গারেট জেনে যেতে পারেননি। কিন্তু ফিলিপ ডুনে মারা (মৃত্যু ২ জুন, ১৯৯২) যাওয়ার বছর তিনেক আগে জানতে পেরেছিলেন তাঁর মা-র ‘সোনার খবর’। যে খবর ফোনে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন পাওলা ওয়েলচ।
No comments:
Post a Comment