ভেঙে পড়া বাইপ্লেনের ভেতর থেকে এলিজাবেথকে যখন বের করে আনা হয় সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর বেঁচে নেই! ভেবেছিলেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জায়গা হবে মরদেহ রাখার ঠাণ্ডা ঘরে। উদ্ধারকারীদের একজন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুলে নেন তাঁর গাড়ির পেছনে।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও
অলিম্পিকের সোনা!
নির্মলকুমার সাহা
(১৮৯৪ সালের ২৩ জুন প্যারিসে গঠিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি। ১৯৪৮ সাল থেকে সারা বিশ্বে ওই দিনটি পালিত হয়ে আসছে ‘অলিম্পিক ডে’ হিসেবে। আজ এই বিশেষ দিনে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে অলিম্পিকের প্রথম সোনাজয়ীকে স্মরণ।)
বাইপ্লেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন এলিজাবেথ রবিনসন। অনুশীলন শেষে অন্যরা সাঁতার কাটতে গেলেও ওঁর যাওয়া হয়নি। শারীরিক কিছু সমস্যার জন্য কোচ বারণ করেছিলেন। সেটা ১৯৩১ সালের ২৮ জুনের ঘটনা। সেদিন এলিজাবেথ ঠিক করেন আকাশে উড়বেন। ওঁর এক তুতো দাদা উইলসন পালমারের বাইপ্লেন ছিল। কিছুদিন আগে বিমান চালানোর লাইসেন্সও পেয়েছেন। মাঝেমধ্যে দাদার সঙ্গে সেই বাইপ্লেনে আকাশে উড়তেন। সেদিনও এলিজাবেথ ডেকে আনেন সেই তুতো দাদাকে। তারপর দু’জনে সেই বাইপ্লেনে চেপে আকাশ ভ্রমণে যান। কিন্তু কিছুটা ওঠার পরই যান্ত্রিক বিভ্রাট। ভেঙে পড়ে সেই বাইপ্লেন। ছুটে আসেন আশপাশের লোকজন। তাঁরা ভেঙে পড়া বাইপ্লেনের ভেতর থেকে এলিজাবেথকে যখন বের করে আনেন, ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর বেঁচে নেই! সবাই ভেবেছিলেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জায়গা হবে মরদেহ রাখার ঠাণ্ডা ঘরে। ওই উদ্ধারকারীদের একজন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুলে নেন তাঁর গাড়ির পেছনে। কাছাকাছি এক ছোট হাসপাতালে (স্থানীয়রা যাকে ‘Poor Hospital’ বলতেন) পৌঁছে গাড়ি থেকে নামানোর পরও প্রাথমিকভাবে সবার মনে হয়েছিল, মৃত! কিন্তু ডাক্তার দেখে জানান, সজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকলেও তখনও প্রাণ আছে। ১১ সপ্তাহ হাসপাতালে সজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলেন এলিজাবেথ। শরীরের নানান অংশে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর হুইলচেয়ারে বসানো হয়। সেই থেকে প্রায় ২ বছর ওই হুইলচেয়ারই ছিল সঙ্গী। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেন।
কে এই এলিজাবেথ রবিনসন?
আধুনিক অলিম্পিক শুরু ১৮৯৬ সালে। প্রথম আসরে ছিল শুধুই পুরুষদের খেলা। মহিলাদের অলিম্পিকে প্রবেশ ১৯০০ সালের দ্বিতীয় আসর থেকে। কিন্তু অলিম্পিকে মহিলাদের অ্যাথলেটিক্স শুরু আরও ২৮ বছর পর, ১৯২৮ সালে আমস্টারডামে। এই দুর্ঘটনার ৩ বছর আগে সেই অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছিলেন এলিজাবেথ রবিনসন। যিনি পরিচিত বেটি রবিনসন নামেও। তিনি তখন স্কুলছাত্রী (Thornton Township High School)। ৩১ জুলাই সোনা জিতেছিলেন বয়স ১৭ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে সবচেয়ে কম বয়সে (১৬ বছর ৩৪৩ দিন) সোনা জেতার রেকর্ডটা এখনও তাঁর নামের পাশে। অলিম্পিকের ইতিহাসে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ের প্রথম সোনার পদকটি গলায় তুলতে তিনি সময় নিয়েছিলেন ১২.২ সেকেন্ড। আমস্টারডাম অলিম্পিকে ওই সোনার সঙ্গে একটি রুপোও জিতেছিলেন তিনি। সেটি ৪x১০০ মিটার রিলের। যখন নিজের দেশে পরের অলিম্পিকে (১৯৩২, লস এঞ্জেলস) আরও ভাল ফলের আশায় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই ওই দুর্ঘটনা। লস এঞ্জেলসে যখন অলিম্পিক চলছে, তখন তিনি হুইলচেয়ারে! আদৌ কি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন, এই আলোচনায় সবাই তখন ব্যস্ত। এলিজাবেথ কিন্তু হুইলচেয়ারে বসেই অলিম্পিকে আবার সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।
শুধু স্বপ্ন দেখা নয়। সেই স্বপ্নকে বাস্তবও করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে তাঁর গলায় আবার উঠেছিল সোনার পদক। তবে সেটা ১০০ মিটারের নয়, ৪x১০০ মিটার রিলের। বার্লিন অলিম্পিকে তিনি যেতে পারবেন কিনা, তা নিয়েই তো তৈরি হয়েছিল সংশয়। ওই দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচারের পর তাঁর একটা পা সামান্য ছোট হয়ে গিয়েছিল। ছিল পায়ের আরও কিছু সমস্যা। যেমন হাঁটু মুড়তে বা ভাঁজ করতে পারতেন না। কী করে নেবেন স্প্রিন্টের স্টার্ট? কী করে দৌড়বেন ১০০ মিটার? পায়ের জন্য স্প্রিন্টের স্টার্ট নেওয়ায় সমস্যা সত্ত্বেও তখনও কিন্তু তিনি দুর্দান্ত দৌড়তেন। আগের সেই গতিও অনেকটাই ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু স্টার্টিংয়ের সমস্যার জন্য তাঁকে ১০০ মিটারে নামাতে পারেনি আমেরিকা। রেখেছিল রিলে দলে, তিন নম্বর রানার হিসেবে।
বার্লিনে মহিলাদের ৪x১০০ মিটার রিলেতে ফেবারিট ছিল সংগঠক জার্মানি। হিটে জার্মানির রিলে দল বিশ্বরেকর্ড (৪৬.৫ সেকেন্ড) গড়েছিল। কিন্তু ফাইনালে তাদের শেষ রানার ব্যাটন নেওয়ার সময় ফেলে দেন। ফলে বাতিল হয়ে যায় জার্মানি। সোনা জেতে আমেরিকা, ৪৬.৯ সেকেন্ডে।
এলিজাবেথ বা বেটি রবিনসনের অ্যাথলেটিক্সে আসাটাও গল্পের মতো এবং আমস্টারডাম অলিম্পিকের কয়েকমাস আগে। এলিজাবেথকে স্কুলে যেতে হত ট্রেনে। বাড়ি থেকে ট্রেনের সময়ানুযায়ী বেরোতেন। একদিন সামান্য দেরি হয়ে যায়। অনেকটা দূর থেকেই দেখতে পান প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে। শুরু হয় দৌড়। যে করেই হোক ট্রেনে উঠতেই হবে। ওই ট্রেনে তখন বসেছিলেন এলিজাবেথের স্কুলের বায়োলজি শিক্ষক চার্লস প্রাইস। যিনি একসময় অ্যাথলিট ছিলেন। বায়োলজি পড়ানোর পাশাপাশি ওই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলোও তিনিই দেখতেন। চার্লস প্রাইস ধরেই নিয়েছিলেন এলিজাবেথ ট্রেনটা ধরতে পারবেন না। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দৌড়ে এসে ট্রেন ছাড়ার মুখে উঠে পড়েন এলিজাবেথ। ট্রেন ধরার জন্য এলিজাবেথের ওই দৌড় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান চার্লস প্রাইস। স্কুলে পৌঁছে তিনি ওঁকে পরামর্শ দেন অ্যাথলেটিক্স করার। বলেন, ছুটির পর মাঠে চলে আসতে। এভাবেই অ্যাথলেটিক্স শুরু বেটি রবিনসনের।
আমস্টারডাম অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেওয়ার আগে তিনি মাত্র দুটি স্বীকৃত প্রতিযোগিতায় দৌড়ে অংশ নিয়েছিলেন। ওই বছর ৩০ মার্চ একটা ইনডোর মিটে প্রথম অংশ নেন, ৬০ গজের দৌড়ে। ওটাই ছিল সরকারিভাবে কোনও স্বীকৃত প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রথম অংশ নেওয়া। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন হেলেন ফিলকে। দ্বিতীয় এলিজাবেথ। দ্বিতীয় দৌড়টা ছিল আউটডোরে, ১০০ মিটারের। প্রথম স্থান পেয়েছিলেন এলিজাবেথ। তারপরই লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে অংশ নেওয়া।
বার্লিন অলিম্পিকের পরই প্রতিযোগিতামূলক অ্যাথলেটিক্স থেকে অবসর নেন। তবে তারপরও অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কর্মকর্তা হিসেবে। অনেক প্রতিযোগিতায় তাঁকে টাইমকিপার ও জাজ হিসেবেও দেখা গিয়েছে।
জন্ম ১৯১১ সালের ২৩ আগস্ট ইলিনয়ের রিভারডেলে। ১৯৩৯ সালে বিয়ে করেন (স্বামী Richard Schwartz)। তারপর ঘরসংসারে মন দেন। দীর্ঘদিন একই সঙ্গে ক্যান্সার ও অ্যালজাইমার্সে ভোগার পর এলিজাবেথ বা বেটি রবিনসনের জীবনাবসান ১৯৯৯ সালের ১৮ মে।
No comments:
Post a Comment