Saturday, June 6, 2020

নিরক্ষর এক দাবাড়ুর গল্প





বই, অঙ্ক, বুদ্ধি, লেখাপড়া—এত কিছু মিলে যখন দাবা, একজন নিরক্ষর মানুষ কি হয়ে উঠতে পারেন বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়?‌ এক শব্দে উত্তর হতে পারে, ‌‘‌অসম্ভব’‌‌। কিন্তু ওই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পেরেছিলেন মালিক মির সুলতান খান।



নিরক্ষর এক
দাবাড়ুর গল্প 


নির্মলকুমার সাহা


বই ছাড়া দাবা, ভাবাই যায় না। দাবা মানেই অজস্র বই।‌ অঙ্ক আর অঙ্ক। যুগের পর যুগ এরকমই চলে আসছে। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কম্পিউটার। বই, অঙ্ক, বুদ্ধি, লেখাপড়া—এত কিছু মিলে যখন দাবা, একজন নিরক্ষর মানুষ কি হয়ে উঠতে পারেন বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়?‌ এক শব্দে উত্তর হতে পারে, ‌‘‌অসম্ভব’‌‌। কিন্তু ওই অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পেরেছিলেন অবিভক্ত ভারতের একজন। তিনি মালিক মির সুলতান খান। নাম যাই হোক, তিনি মালিক, মির বা সুলতান, কোনওটাই ছিলেন না। ছিলেন দরিদ্র পরিবারের এক সন্তান।
অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের সরগুড়া জেলার মিঠা গ্রাম। যা এখন পাকিস্তানে। ওই গ্রামেই থাকতেন এক ধর্মীয় নেতা নিজামুদ্দিন। তাঁর দশম পুত্র সুলতানের জন্ম ১৯০৫ সালে। কোন মাসে?‌ কত তারিখে?‌ তা অবশ্য সুলতান খান কখনও বলতে পারেননি। নিজামুদ্দিন এতটাই গরীব ছিলেন যে সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারেননি। একটু-‌আধটু দাবা খেলা জানতেন নিজামুদ্দিন। ছেলেদের লেখাপড়া শেখাতে না পারলেও ভারতীয় পদ্ধতিতে দাবা খেলা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত দাবায় ওই ভারতীয় পদ্ধতিই সুলতানের সম্বল ছিল।
স্যর উমর হায়াত খান দাবাপ্রেমী ছিলেন। দাবা খেলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। একদিন সুলতান খানের খেলা দেখে মুগ্ধ হন। তাঁর মনে হয়, কিছুটা সহযোগিতা পেলে সুলতান বড় দাবা খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারবেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯২৮ সালে সর্বভারতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন সুলতান। একবছর পরই উমর হায়াত খান পঞ্চম জর্জের এ ডি সি হন। তিনি সুলতানকে ব্রিটেনে নিয়ে যান তাঁর কর্মচারী হিসেবে। ১৯২৯ সালের ২৬ এপ্রিল সুলতান খান ব্রিটেনে যান। ব্রিটেনে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই দাবার আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন শিখে ফেলেন। শুধু তাই নয়, সেই ১৯২৯ সালেই ব্রিটিশ দাবায় চ্যাম্পিয়ন হন সুলতান। ১৯২৯-‌এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৩৩-‌এর শেষ দিক পর্যন্ত ব্রিটেনে ছিলেন। তাও আবার টানা নয়। উমর হায়াত খানের সঙ্গে ১৯২৯-‌এর নভেম্বর থেকে ১৯৩০ সালের মে পর্যন্ত ভারতে এসে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু ওই অল্প কয়েকবছরেই ব্রিটেনে সুলতানের সাফল্য মনে রাখার মতো। ব্রিটিশ দাবায় চারবার খেলে তিনবার চ্যাম্পিয়ন। ১৯২৯, ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে। ভারতে চলে আসায় ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ দাবায় খেলতে পারেননি। মাত্র একবারই ১৯৩১ সালে খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি।
তিনটি দাবা অলিম্পিয়াডে (‌১৯৩০, ১৯৩১, ১৯৩৩)‌ খেলেছেন ব্রিটেনের হয়ে। তিনটিতেই ছিলেন একনম্বর বোর্ডের খেলোয়াড়। ১৯৩০ সালে হামবুর্গে ১৪ রাউন্ডে করেছিলেন ১১ পয়েন্ট। শুধু দাবা অলিম্পিয়াড নয়, ওই সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাবায়ও ব্রিটেনের হয়ে খেলেছেন। তখন আন্তার্জাতিক কোনও প্রতিযোগিতাতেই প্রথম চারের বাইরে যাননি। ১৯৩০ সালেই হেস্টিংসে আন্তর্জাতিক দাবায় হারান প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কাপাব্লাঙ্কাকে। ‘‌মর্নিং পোস্ট’‌-‌এ সুলতানের খেলার প্রশংসা করে লেখা হয়েছিল, ‘‌রনজি অফ চেস’‌। কাপাব্লাঙ্কা পরে লিখেছিলেন, ‘‌ভারতীয় নিয়মে ভারতসেরা ছিল সুলতান। ইউরোপে এসে দাবার আন্তর্জাতিক নিয়ম শিখে অল্পদিনেই যে সাফল্য পেয়েছিল, তাতে ওকে জিনিয়াস ছাড়া অন্য কিছু বলা সম্ভব নয়’‌। সুলতান খান-‌কাপাব্লাঙ্কার সেই খেলাটি দাবা ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৩১ সালে প্রাগে দাবা অলিম্পিয়াডে তখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আলেকজান্ডার আলেখিনের সঙ্গে ড্র। ১৯৩১-‌এ হেস্টিংসে ও ১৯৩২-‌এ বার্নে ড্র করেন ম্যাক্স ইউয়ের সঙ্গে। হল্যান্ডের এই তারকা পরে ১৯৩৫ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে সুলতান হারান আমেরিকার বিখ্যাত খেলোয়াড় ফ্রাঙ্ক জেমস মার্শালকে।
এত সাফল্যের পরও সুলতানের আন্তর্জাতিক দাবা জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ সুলতান পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন উমর হায়াত খানের ওপর। ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকাপাকি ভারতে ফিরে আসেন উমর হায়াত খান। ফলে ফিরে আসতে হয় সুলতানকেও। শেষ হয়ে যায় সুলতানের আন্তর্জাতিক দাবা জীবনও। এখানেই একটি বড় প্রশ্ন, উমর হায়াত খান কি সত্যিই সুলতানের দাবা খেলা পছন্দ করতেন?‌ সত্যি কি তিনি চাইতেন, সুলতান দাবা খেলে আরও প্রতিষ্ঠা পান?‌ তাই যদি হবে, তাহলে তো তিনি সুলতানকে ব্রিটেনে রেখেই আসতে পারতেন। তখনকার নানা পত্রপত্রিকায় সুলতান খানকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিছু লেখায় উমর হায়াত খানের ‘‌গৃহভৃত্য’‌ হিসেবেই সুলতান চিহ্নিত হয়েছেন। যেমন আমেরিকার বিখ্যাত দাবাড়ু রুবেন ফাইন লিখেছেন, ‘‌১৯৩৩ সালে দাবা অলিম্পিয়াডের পর উমর হায়াত খান তাঁর বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমাদের। সেখানে গিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। একজন গৃহভৃত্যের যা কাজ সবই সুলতান খানকে দিয়ে করাচ্ছিলেন উমর হায়াত খান। আমাদের খাবার দেওয়া, টেবিল পরিষ্কারের কাজও করতে হচ্ছিল সুলতানকে। অত উঁচু পর্যায়ের একজন খেলোয়াড়কে ওই অবস্থায় দেখে ব্যথিত হয়েছিলাম। সুলতানের সাফল্যের সামান্য স্বীকৃতিও উমর হায়াত খান দেননি!‌’‌
‌‌ভারতে ফিরে আসার পর বেশিদিন দাবা খেলেননি সুলতান। ১৯৩৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তখনকার ভারত চ্যাম্পিয়ন ভি কে খাদিলকারের সঙ্গে ১০ গেমের একটি সিরিজে অংশ নেন। প্রথম গেমটি ড্র। বাকি ৯টিতেই জেতেন সুলতান। ওই জয়ের পরই অবসর নেন। সুলতান খান অত বড় খেলোয়াড় হয়েও ছেলেদের দাবায় আনেননি।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম। শেষ জীবনও কেটেছে প্রবল দারিদ্র‌্যের মধ্যেই। দেশে ফিরে আসার পর উমর হায়াত খান একখণ্ড চাষের জমি দিয়েছিলেন সুলতানকে। ওখানে চাষ করেই বাকি জীবন কাটাতে হয়। তখন সবসময়ের সঙ্গী ছিল হুক্কা। সকাল থেকে রাত, বাড়ির সামনে গাছতলায় বসে হুক্কা টানতেন। একসময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। ওই অবস্থায়ও টেনে যেতেন হুক্কা। চিকিৎসা করার টাকা ছিল না। প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ওই সরগুড়ায়, ১৯৬৬ সালের ২৫ এপ্রিল।
সুলতান খান তখন বেঁচে। আমেরিকা থেকে ইসমাইল স্লোয়ান গিয়েছিলেন মিঠা গ্রামে সুলতানকে নিয়ে একটি লেখার জন্য। তাঁর সেই লেখা পড়ে জানা যায় দারিদ্র‌্য, যক্ষ্মা, হুক্কার মাঝেও সুলতানের মন থেকে দাবা তখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। কোনও লোক দেখলেই দাবা খেলতে চাইতেন। দাবা খেলতে চেয়েছিলেন ইসমাইল স্লোয়ানের সঙ্গেও।
সুলতান যে বছর মারা যান, সেই ১৯৬৬ সালেই প্রকাশিত হয় টেরেঙ্ক টিলার সম্পাদিত ‘‌Chess Treasury Of The Air‌’‌ বইটি। তাতে ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট দাবা খেলোয়াড় হ্যারি গোলোমবেক লিখেছেন, ‘‌১৯২৯ সালের গ্রীষ্মে সুলতান খান যখন প্রথম ইউরোপে আসে ‌পড়তে বা লিখতে পারা তো দূরের ব্যাপার, ইউরোপের কোনও ভাষায় (‌পড়ুন ইংরেজি)‌ কথাও বলতে জানত না। .‌.‌.‌.‌ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার সময় আমরা একই বোর্ডিং হাউসে ছিলাম। ওখানে আমরা দু’‌জনই শুধু দাবা খেলোয়াড়। ভাষা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আকারে-‌ইঙ্গিতে আমাদের মত বিনিময় হত। আর দাবা খেলতে গিয়ে তো ঘুঁটির চালই আসল ব্যাপার। ভাষা সেখানে কোনও সমস্যা নয়। কোনও বড় সমস্যা হলে দোভাষীর সাহায্য নিতাম। তখনই আবিস্কার করেছিলাম, সুলতান খান লেখাপড়া জানে না। .‌.‌.‌.‌ ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত রসিকতাবোধ ছিল। সবেতেই খুব জোরে হেসে উঠত।’‌
ইসমাইল স্লোয়ানের লেখা পড়ে মনে হয় প্রবল দারিদ্র‌্য, অসুস্থতার মধ্যেও ওই হাসি তিনি ধরে রেখেছিলেন শেষ বয়সেও।
তখনও গ্র‌্যান্ড মাস্টার টাইটেল দেওয়া শুরু হয়নি। তাই সুলতান খানের নামের আগে ‘‌জি এম’‌ লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে কী?‌ দাবা বিশ্বে তাঁর খেলা কখনও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। প্রায় তিনদশক আগে চেন্নাইয়ের বেসান্ত নগরের এক বাড়ির টেবিলে একটি বই দেখেছিলাম। বইটির নাম:‌ মির সুলতান খান। লেখক:‌ আর এন কোলস। প্রকাশকাল:‌ ১৯৭৭। বিষয়:‌ সুলতান খানের কিছুটা পরিচিতি ও তাঁর উল্লেখযোগ্য ৬৪টি খেলার ছক-‌সহ বিশ্লেষণ। এক নিরক্ষর দাবাড়ুর খেলা যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি, তা সেদিন বোঝা গিয়েছিল বিশ্বনাথন আনন্দের টেবিলে রাখা ওই বইটি দেখেই। পরে আরও অনেক ঘটনায়ও সেটা বোঝা গিয়েছে। ২০০৪ সালে ওই বইটি আরও বর্ধিত আকারে ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত হয়। নাম:‌ দি বেস্ট গেমস অফ মির সুলতান খান।
কয়েকদিন পর মে মাসের গোড়ায় প্রকাশিত হতে চলেছে মির সুলতান খানকে নিয়ে আরও একটি বই। যার লেখক ব্রিটেনের গ্র‌্যান্ড মাস্টার ড্যানিয়েল কিং। যে বইয়ের প্রচ্ছদেই সুলতান খানকে ‘‌ভৃত্য’‌ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (‌‌এই লেখার সঙ্গে সেই বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিও দেওয়া হল)‌। প্রায় তিনদশক আগে বেসান্ত নগরের বাড়িতে যাঁর টেবিলে আর এন কোলসের লেখা ‘‌মির সুলতান খান’‌ বইটি দেখেছিলাম সেই বিশ্বনাথন আনন্দ লিখেছেন ড্যানিয়েল কিংয়ের এই বইয়ের ভূমিকা। এতেই প্রমাণিত দাবা দুনিয়ায় মির সুলতান খান এখনও একইরকম প্রাসঙ্গিক। 

জন্ম:‌ ১৯০৫।
মৃত্যু:‌ ২৫ এপ্রিল ১৯৬৬।‌‌‌‌‌

No comments:

Post a Comment

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...