Thursday, June 11, 2020

চিরশ্রেষ্ঠ সমুদ্র অভিযাত্রী




প্রথম ভারতীয় হিসেবে সাঁতরে পার হয়েছিলেন ইংলিশ চ্যানেল। পাঁচ মহাদেশের সাত সমুদ্র সাঁতরে পার হওয়ার নজিরও রয়েছে তাঁর। ‘‌গিনেস বুক অফ রেকর্ডস’‌-‌এ দুঃসাহসিক মিহির সেনের পরিচয় দেওয়া আছে ‘‌বিশ্বের চিরশ্রেষ্ঠ দূরপাল্লার সাঁতারু’‌।



চিরশ্রেষ্ঠ সমুদ্র
অভিযাত্রী


নির্মলকুমার সাহা


(‌আজ ১১ জুন। ১৯৯৭ সালের এই দিনেই জীবনাবসান হয়েছিল চিরশ্রেষ্ঠ সমুদ্র অভিযাত্রী মিহির সেনের। আজ মৃত্যু দিনে তাঁকে স্মরণ, একটি পুরনো লেখায়।)‌

সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে এখনও তাঁর নাম ঊজ্জ্বল। তিনি মিহির সেন। প্রথম ভারতীয় হিসেবে যিনি সাঁতরে পার হয়েছিলেন ইংলিশ চ্যানেল। পাঁচ মহাদেশের সাত সমুদ্র সাঁতরে পার হওয়ার নজিরও রয়েছে তাঁর। ‘‌গিনেস বুক অফ রেকর্ডস’‌-‌এ দুঃসাহসিক মিহির সেনের পরিচয় দেওয়া আছে ‘‌বিশ্বের চিরশ্রেষ্ঠ দূরপাল্লার সাঁতারু’‌।
মিহির সেনের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর পুরুলিয়ার ছোট এক গ্রামে। বাবা ডাঃ রমেশ সেন, মা লীলাবতী। বাবা চিকিৎসক হলেও ওখানে বিশেষ আয় ছিল না। গ্রামের গরীব রুগিদের বিনা পয়সায় দেখতেই চলে যেত অনেকটা সময়। এদিকে জন্মের পর থেকেই মিহির রুগ্ন, অসুস্থ। একসময় মা-‌বাবা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন গ্রামে থেকে ওই রুগ্ন ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন কিনা!‌ ফলে সিদ্ধান্ত নেন গ্রাম ছাড়ার। পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামের পরিচিত ‘‌ডাক্তার বাবু’‌ চলে যান কটকে। সেখানেই লেখাপড়া, বেড়ে ওটা। ছেলের ভবিষ্যৎ ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য মা লীলাবতী কটকে যাওয়ার পর বাড়ির সামনের ঘরে খুলে ফেলেছিলেন একটি ছোট দোকানও। যেখানে বিক্রি করতেন মুরগির ডিম ও দুধ। কটকেই স্কুলের পড়া শেষ করার পর উৎকল ইউনিভার্সিটি থেকে ল পাস করেন মিহির। এরপর পরিকল্পনা করেন ব্রিটেনে আইন নিয়ে উচ্চ শিক্ষার। কিন্তু ছেলেকে ব্রিটেনে পাঠানোর মতো আর্থিক অবস্থা মা-‌বাবার ছিল না। বিজু পটনায়েক তখন ওড়িশার তরুণ নেতা। তাঁর কাছে যান মিহির। প্রথমে সাড়া না পেলেও ৬ মাস পর বিজু পটনায়েক কিছুটা সাহায্য করেন। এভাবেই ব্রিটেনে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়া মিহিরের।
সেখানে গিয়েও অসহায় অবস্থা। খরচ চালাবেন কীভাবে?‌ প্রথমে এক রেল স্টেশনে রাতে মালবাহকের কাজ শুরু করেন। কিন্তু কয়েকদিন পর তাঁকে ওখান থেকে বিতাড়িত হতে হয়। খবর পান ভারতীয় হাই কমিশনে এদেশ থেকে যাওয়া ছাত্রদের কাজ দেওয়া হয়। সেখানে ঢুকে পড়েন। চলতে থাকে সেই কাজ ও ব্যারিস্টারি পড়া। ওই সময়ই জলের নেশায় পড়ে যান। ঠিক করেন সাঁতার শিখে ইংলিশ চ্যানেল পার হবেন। ব্যাপারটা যে সহজ নয়, তা বুঝতে পারেন চ্যানেলের জলে নেমে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮, চার বছরে ব্যর্থ হন ৭ বার। চ্যানেলের টানে তিনি এতটাই বঁুদ হয়ে পড়েছিলেন যে ব্যারিস্টারি পাস করে ভারতে চলে এসে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করার পরও সেই জলের নেশা থেকে বের হতে পারেননি। তাই প্রতি বছরই চলে যেতেন ইংলিশ চ্যানেলর টানে। আরও একবার চেষ্টা করতে। ব্যর্থতার সাতবারই তিনি চেষ্টা করেছিলেন ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে আসার। এরপর ঠিক করেন ইংল্যান্ডে থেকে ফ্রান্সে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। সেই চেষ্টায় সফলও হন। ১৯৫৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার হন। সময় লাগে ১৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট।
শুধু ইংলিশ চ্যানেল জয়ের ক্ষেত্রে নয়, অভিযান সাঁতারের আরও অনেক ব্যাপারেও ভারতে তিনি পথপ্রদর্শক। শ্রীলঙ্কা থেকে ভারত, বিপদসঙ্কুল পক প্রণালী তিনিই প্রথম সাঁতার কেটে পার হয়েছিলেন, ১৯৬৬ সালের ৫-‌৬ এপ্রিল। সময় লেগেছিল ২৫ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। পক প্রণালীতে সাঁতার কাটা যায়, মিহির সেনের আগে কোনও মানু্ষ ভাবতেই পারেননি। ওই ১৯৬৬ সালটা সমুদ্র অভিযানের ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় বছর। যাঁর নায়ক ছিলেন মিহির সেন। পক প্রণালীর পর জিব্রাল্টার। এশিয়ার প্রথম মানুষ হিসেবে মিহির জিব্রাল্টার পার হয়েছিলেন ওই বছর ২৪ আগস্ট। সময় ৮ ঘণ্টা ১ মিনিট। এর ১৯ দিন পর, ১২ সেপ্টেম্বর পার হয়েছিলেন দারদানেল প্রণালী। বিশ্বে তিনিই প্রথম। সময় লেগেছিল ১৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। রাশিয়ার ব্ল্যাক সি থেকে ইস্তানবুলের গোল্ডেন হর্ন, যার নাম বসফরাস প্রণালী। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ২১ সেপ্টেম্বর পেরিয়ে যান সেটাও। সময় ৪ ঘণ্টা। ওখানেই থেমে যাননি। এবার পানামা চ্যানেল। ২৯-‌৩১ অক্টোবর, ৩৪ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে জয় করেছিলেন পানামা চ্যানেল। এই চ্যানেল জয়ের ক্ষেত্রে মিহির সেন বিশ্বের তৃতীয় মানুষ। আমেরিকার বাইরে তিনিই প্রথম।
এই সব সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন নানা পুরস্কার, সম্মান। উল্লেখযোগ্য হল ১৯৫৯ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৬৭-‌তে পদ্মভূষণ।
সমুদ্র অভিযানের এরকম একজন সফল নায়ককে শেষ জীবনটা কাটাতে হয়েছে জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে। কারণ অনেকটাই রাজনৈতিক। যার চাপে তাঁর ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষ ১০ বছর কেটেছে কখনও হাসপাতালে, আবার কখনও বাড়ির বিছানায় শুয়ে। অ্যালজাইমার্স ও পার্কিনসনে আক্রান্ত ছিলেন। সল্টলেকের আনন্দলোক হাসপাতালে জীবনাবসান ১৯৯৭ সালের ১১ জুন, রাতে।

No comments:

Post a Comment

আজ বাঙালির অলিম্পিক অভিযান শুরুর শতবর্ষ পূর্তি, বিস্মৃত পি সি ব্যানার্জি

 ‌ বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (‌বি ও এ)‌ আছে, রাজ্য অ্যাথেলটিক্স সংস্থা আছে। জন্ম শতবর্ষে কোনও অনুষ্ঠান করে প্রথম বাঙালি অলিম্পিয়ানকে শ্রদ...