ববি মরো যখন অ্যাথলেটিক্স করতেন, নিয়ম করে রাতে ঘুমোতেন ১১ ঘণ্টা। প্রশিক্ষণ নেওয়া বা অনুশীলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। বলতেন, ‘ঘুমটাই আমার আসল শক্তি। রাতের এই টানা ঘুমই আমার সফল্যের চাবিকাঠি।’
‘মিস্টার ক্লিন’
ঘুমোতেন
১১ ঘণ্টা!
নির্মলকুমার সাহা
(১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে ট্রিপল সোনা জিতেছিলেন আমেরিকান স্প্রিন্টার ববি মরো। ৩০ মে, শনিবার বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় জীবনাবসান হল তাঁর, সান বেনিতোতে নিজের বাড়িতেই। তুলো এবং গাজর চাষের প্রতি তাঁর ছিল গভীর ভালবাসা। সান বেনিতোতেই ছিল ওঁদের পারিবারিক তুলো ও গাজর চাষের ক্ষেত। ৪ বছর আগে আজকালে প্রকাশিত ববি মরোকে নিয়ে একটি লেখা। তাঁর জীবনাবসানের পরও মনে হল লেখাটি অপ্রাসঙ্গিক নয়।)
১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে ১০০ মিটার দৌড়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। হিটের দ্বিতীয় রাউন্ডেই ২ আমেরিকান অলিম্পিক রেকর্ডের সমান সময় (১০.৫ সেকেন্ড) করেছিলেন। একজন ববি মরো। আরেকজন ইরা মার্চিসন। দুটি সেমিফাইনালেও ওঁরা ২ জনই প্রথম হয়েছিলেন। মরো আবার অলিম্পিক রেকর্ডের সমান সময় করেন, ১০.৫ সেকেন্ড। মার্চিসনের সময় ছিল ১০.৭৯ সেকেন্ড। ফাইনালে মার্চিসন অবশ্য আর পেরে ওঠেননি। আবার অলিম্পিক রেকর্ডের সমান সময় করে (১০.৫ সেকেন্ড) সোনা জিতেছিলেন ববি মরো। ওই একই সময়ে শেষ করে রুপো জিতেছিলেন আমেরিকারই ডব্লু থানে বেকার। ১০.৬ সেকেন্ডে শেষ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার হেক্টর হোগান এবং মার্চিসন। হোগান জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ পদক। মার্চিসন পেয়েছিলেন চতুর্থ স্থান।
সেবার মেলবোর্ন অলিম্পিকে আরও দুটি সোনা জিতেছিলেন ববি মরো। ১০০ মিটারের পাশাপাশি তাঁর গলায় উঠেছিল ২০০ মিটার ও ৪x১০০ মিটার রিলের সোনা। ২০০ মিটারে সোনা জেতার পথে ফাইনালে ছুঁয়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড (২০.৬ সেকেন্ড)। ৪x১০০ মিটার রিলেতে আমেরিকা দল গড়েছিল ৩৯.৫ সেকেন্ডের নতুন বিশ্বরেকর্ড। মরো ছিলেন ওই রিলে দলের শেষ রানার।
অলিম্পিকে ওই দুর্দান্ত সাফল্যের পর সে বছর পেয়েছিলেন স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের ‘স্পোর্টসম্যান অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার। ববি মরো যখন অ্যাথলেটিক্স করতেন, নিয়ম করে রাতে ঘুমোতেন ১১ ঘণ্টা। প্রশিক্ষণ নেওয়া বা অনুশীলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। বলতেন, ‘ঘুমটাই আমার আসল শক্তি। রাতের এই টানা ঘুমই আমার সফল্যের চাবিকাঠি।’ সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। কখনও কোনও বিতর্কের ধারেকাছেও থাকতেন না। অ্যাথলেটিক্স জীবনে যখন সাফল্যের শীর্ষে, আমেরিকায় ওঁকে ‘মিস্টার ক্লিন’ বলা হত।
জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৫ অক্টোবর টেক্সাসের হার্লিংজেনে। পরিবারের ছিল সান বেনিতোতে তুলো ও গাজর চাষের ক্ষেত। ওটাই ওঁদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক ব্যবসা। সেখানেই কেটেছে শৈশব। খেলাধুলোর জন্য মাঝের অল্প কিছু সময় বাদ দিলে আবার ওখানে এসেই স্থায়ী হয়েছেন ববি মরো।
সান বেনিতো হাই স্কুলে যখন ভর্তি হন, পরিকল্পনা ছিল হাই স্কুলের পর্ব চুকে গেলেই বান্ধবী জো আনকে বিয়ে করে সংসার আর পারিবারিক চাষের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু স্কুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন খেলাধুলোর সঙ্গে। স্প্রিন্টার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার আগে সান বেনিতো হাই স্কুল দলের হয়ে আমেরিকান ফুটবল খেলতেন। ওঁকে আমেরিকান ফুটবল খেলতে দেখেই একদিন সান বেনিতো হাই স্কুলের অ্যাথলেটিক্স কোচ জেক ওয়াটসন অন্যরকম পরামর্শ দেন। বলেন, আমেরিকান ফুটবল ছেড়ে স্প্রিন্টে মন দিতে। তিনি কোচিং করাবেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে ওয়াটসনের কথায় স্প্রিন্টে মন দেন ববি মরো। পরে যখন আবিলেন ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন, ততোদিনে আমেরিকান ফুটবল ছেড়ে পাকাপাকি চলে এসেছেন অ্যাথলেটিক্সে। তখন অ্যাথলেটিক্সে ববি মরোর ক্লাব ছিল ফ্রাটার সোদালিস।
সান বেনিতো হাই স্কুল থেকেই উত্থান ববি মরোর। সেটা মনে রেখে ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ ওঁর অলিম্পিক সোনা জয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৬ সালে এক বিশাল অনুষ্ঠান করে। ববি মরোর নামে ১১ হাজার আসনের একটি নতুন স্টেডিয়াম গড়া হয়। যার উদ্বোধন হয় ববি মরোর হাতেই।
১৯৫৮ সালে অ্যাথলেটিক্স থেকে অবসর নিয়ে পারিবারিক চাষের কাজেই নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। যখন অ্যাথলেটিক্স করতেন, তখনও সময় পেলেই চলে যেতেন নিজেদের সেই চাষের ক্ষেতে। চাষের প্রতি ওঁর এতটাই ভালবাসা ছিল যে নিজেও হাত লাগাতেন। মেলবোর্ন অলিম্পিকের কয়েক মাস পরের একটা ছবিতে দেখা গিয়েছে, সোনাজয়ী নায়ক গাজর ক্ষেতে নিজে ট্র্যাকটর চালাচ্ছেন। ১৯৬০ সালে অবসর ভেঙে অল্প সময়ের জন্য ট্র্যাকে ফিরেছিলেন। চেষ্টা করেছিলেন ১৯৬০ সালেও আমেরিকার অলিম্পিক দলে ঢোকার। সেটা আর পারেননি। ফলে দ্বিতীয়বার অবসর নিয়ে পুরোপুরি ঢুবে গিয়েছিলেন পারিবারিক ব্যবসায়। অলিম্পিকে সোনাজয়ী হিসেবে সেলিব্রিটি তকমা লেগে যাওয়ায় অন্য কিছু কাজের সঙ্গে জড়াতে হলেও, নিজের ভালবাসার তুলো ও গাজর চাষের কাজের ক্ষতি কখনও করেননি।
No comments:
Post a Comment